প্রবল বর্ষণে স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত
বর্ষার প্রথিত বর্ষণ এসেছে অবাঞ্ছিতভাবে। মৌসুমের প্রথম প্রবল বর্ষণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকন বর্ষণের তােড়ে বিদ্যুতের তার ছিড়ে রাজধানীতে মারা গেছে ২ জন। এছাড়া বাড়ি ধ্বসে আহত হয়েছে আরও ১৩ জন। ৩ জনের অবস্থা গুরুতর।
সােমবার সন্ধ্যে ৬টা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় রাজধানীতে বৃষ্টি হয়েছে ৬ দশমিক ২৯ ইঞ্চি। সারা দেশে এটাই বৃষ্টিপাতের সর্বাপেক্ষা অধিক হার। সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে রাজশাহীতে। সােমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ২টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় এখানে বৃষ্টিপাতের হার ০.০৪ ইঞ্চি মাত্র।
গত চব্বিশ ঘটায় প্রবল বর্ষণে ঢাকার ফুটপাথ ও বস্তির জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। নাজিমুদ্দিন রােড নবাববাগিচা, বখশীবাজার লেন, গেন্ডারিয়া, ঢালকা নগর, নামােপাড়া, হাজারীবাগ প্রভৃতি এলাকার বস্তিগুলােতে বর্ষণের পানি ঢুকে বন্যার অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এসব বস্তির কোন কোন ঘরে জমাট পানির উচ্চতা প্রায় কোমর সমান। চকবাজার ইউনিয়ন বাকশাল ইউনিটের সভাপতি কাজেম আলী এক বিবৃতিতে বস্তিবাসীর দুর্দশার প্রতি কর্তৃপক্ষীয় মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, হােসেনী দালান মহল্লার বস্তিবাসীদের ঘরে ৩/৪ ফুট বৃষ্টির পানি ঢুকেছে। প্রবল বৃষ্টির জন্যে গরীব দুঃখী মানুষেরা জীবিকার অন্বেষণে বের হতে পারেনি। ছােট ছােট ছেলেমেয়ে নিয়ে এরা অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
প্রবল বৃষ্টির ফলে ফুটপাথবাসীরা আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন দালানের বারান্দায়। স্টেশনে টার্মিনালের প্লাটফরমে। এদের জীবিকার শুধুমাত্র বস্তি ও ফুটপাথবাসীদের দুর্ভোগ নয়। রাজধানীর রাজপথের বিভিন্ন জায়গায় কোমর পর্যন্ত পানি জমেছে। বঙ্গভবনের পাশের রাজপথে ছােট ছেলেমেয়েরা গতকাল সকালে সাঁতার কেটেছে। বাস গাড়ী চলেছে ঢেউ তুলে। | রাজধানীর জনজীবনের এই দুর্ভোগের কারণ এখানে পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে। বহু লেখালেখি, আবেদন নিবেদন ও অভিযােগের পরও এর জন্যে দায়িত্বশীল সংস্থার পানি নিষ্কাশনের কোন কার্যকর উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
দুর্ঘটনা
সােমবার রাত ও মঙ্গলবার সারা দিনে প্রবল বর্ষণের ফলে ঢাকায় যে দুর্ঘটনাগুলাে ঘটে তার মধ্যে সােমবার রাতে হাটখােলা রােডের ভগবতী ব্যানার্জী লেনের বিদ্যুতের তার প্রবল বর্ষণে ছিড়ে পড়ে। ছেড়া তারে জড়িয়ে তসিরুন নামে একজন ভিখারিনী ও তার দেড় বছরের মেয়ে শিরিমন মারা যায়। সূত্রাপুর পুলিশ এ খবর দিয়েছে। দমকল বিভাগের খবর মঙ্গলবার দুপুরে বর্ষণের ফলে ৭২/১ দক্ষিণ মৈশুন্ডীর একটি বাড়ি ধ্বসে একটি শিশু ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এখানে ৩ জন আহত হয়। তাদের হাসপাতালে পাঠানাে হয়েছে।
সকাল সাড়ে ছটার ফরাসগঞ্জ রেশন অফিসের সামনে একটি বাড়ি ধ্বসে পড়ে। রেশন কার্ডের জন্যে এখানে অপেক্ষারত ১০ ব্যক্তি আহত হয়। তিন জনকে হাসপাতালে পাঠানাে হয়েছে। এছাড়া সােমবার গভীর রাতে বৃষ্টির ফলে শর্ট সার্কিটে আগুনে ধরে চকবাজারের একটি তৈজসপত্রের দোকানেও কিছু ক্ষতি হয়।
সারাদেশে বৃষ্টি
আষাঢ় মাস শেষ হয়ে গেছে। এটা আউশের খড়া আসা এবং রােপ্য লাগানাের মওসুম। কিন্তু বর্ষার বর্ষণ হয়নি। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া যাচ্ছিল ফসলের ক্ষয়ক্ষতির খবর।
বৃষ্টি ছিল প্রাথিত। গত দুদিনে সারা দেশে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। আগামী ২৪ ঘন্টায় আরাে বৃষ্টি হবে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে।
আবহাওয়া দফতরের পরিচালকের সঙ্গে যােগযােগ করা হলে তিনি জানান, ১৫ই জুন থেকে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কোথাও কোথাও ছিটেফোঁটা ছাড়া বৃষ্টিপাত একদম হয়নি বললেই চলে।
তিনি এর কারণ হিসেবে জানান রতের ইউপির কাছে দীর্ঘদিন ধরে বায়ুর একটা নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়েছিল। বায়ু সমস্ত আর্দ্রতা এই নিম্নচাপকে ঘিরে বিরাজ করছিল। ফলে আমাদের এদিকে কোন বর্ষণ হয়নি। এই নিম্নচাপটি কদিন আগে সরে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এদিকেও বর্ষণ শুরু হয়েছে। তিনি জানান বাংলাদেশে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বর্ষা এলাে এক মাস পর। ১৪ই জুলাই থেকে।
গত বছর জুলাই মাসে ঢাকায় বৃষ্টিপাত হয়েছিলাে ২৮ দশমিক ৩০ ইঞ্চি চট্টগ্রামে ২৯ দশমিক ৬৮ ইঞ্চি, নােয়াখালীতে ৩৬ দশমিক ৩৫ ইঞ্চি, কুমিল্লায় ২২ দশমিক ৯৪ ইঞ্চি, রংপুরে ২৮ দশমিক ৪১ ইঞ্চি এবং ফরিদপুরে হয়েছিল ৪৪ দশমিক ০৬ ইঞ্চি। | সােমবার সন্ধ্যে ৬টা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় চট্টগ্রামে ১.১৯ ইঞ্চি, রাঙ্গামাটিতে ৩.০৭ ইঞ্চি সন্দ্বীপে ৩.২০ ইঞ্চি, হাতিয়ায় ৩.৭৮ ইঞ্চি রংপুরে ৩.৭২ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের খবর আবহাওয়া অফিস থেকে পায়ছে। সােমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৭ ঘন্টায় সিলেট, ময়মনসিংহ জামালপুর, নারায়নগঞ্জ, ফরিদপুর, ভােলা, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া ও বরিশালেও প্রবল বর্ষণ হয়েছে।
সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১৬ জুলাই ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত