ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী
আরও অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করুন। প্রধানমন্ত্রী জনাব এম. মনসুর আলী আরও অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের উদ্দেশ্যে আন্তরিকতা ও শৃঙ্খলার সহিত কঠোর পরিশ্রম করার জন্য মেরিন একাডেমীর বিদায়ী ক্যাডেটদের প্রতি আহ্বান। জানাইয়াছেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে জলদিয়ায় মেরিন একাডেমীর প্রাঙ্গণে অফিসার, প্রকৌশলী, ক্যাডেট ও নটিক্যালদের দশম দলের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করিতেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজিকার এই শান্ত সমুজ্জল সকালে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক নৌবহরের অফিসারদের একমাত্র বিদ্যাপীঠ এই মেরিন একাডেমিল সুশৃঙ্খল ক্যাডেটদের বিদায়ী কুচকাওয়াজ ও বুদ্ধিদীপ্ত মার্চ পাস্ট অবলােকন করিয়া আমি যারপরনাই আনন্দিত। আমি জানিয়া খুশি হইয়াছি যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে ১৩৩ জন ক্যাডেটসহ অন্যাবধি মােট ১৪৯ জন ক্যাডেট এই একাডেমী হইতে পাস করিয়াছেন। আজ আপনারা দশম দল ক্যাডেটদের যে বিদায়ী কুচকাওয়াজ অবলােকন করিয়াছেন তাহাতে ১৭ জন নটিক্যাল ক্যাডেট এবং ১৮ জন প্রকৌশলী ক্যাডেট সমন্বয়ে মােট ৩৬ জন ক্যাডেট অফিসার আছেন। আমি জানিয়া আরও আনন্দিত হইয়াছি যে, আমাদের বাণিজ্যিক বহহুরের অধিকাংশ অফিসারই এই একাডেমীর প্রাক্তন ক্যাডেট।
এই প্রাক্তন ক্যাডেটদের মধ্যে অনেকেই জাহাজের ক্যাপেটেন এবং প্রধান প্রকৌশলী পদে অধিষ্ঠিত। আরও আনন্দের বিষয় যে, এই একাডেমীর একজন প্রাক্তন ক্যাডেট অফিসার বর্তমানে এই একাডেমীর নটিক্যাল ও প্রকৌশলী বিভাগের প্রধান পদে আসীন। আমি মনে করি, আমাদের সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যেদিন একাডেমীর প্রাক্তন ক্যাডেটরা এই একাডেমীর কর্ণধার হিসাবে কম্যাওডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হইবেন।
সুধীমণ্ডলী, বাংলাদেশের ভৌগােলিক অবস্থান অনুসারে বহির্বিশ্বের সাথে তার আমদানী রপ্তানী ব্যবসার শতকরা প্রায় একশত ভাগ সমুদ্রপথে চালাইতে হয়। বলা প্রাসঙ্গিক যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচলিত সাধারণ প্রথানুসারে আমাদের সমুদয় আমদানীরপ্তানী পণ্যের ৪০ ভাগ আমাদের স্বীয় বাণিজ্যিক বহর কর্তৃক পরিবাহিত হওয়া উচিত এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় আনুপাতিকভাবে সঙ্কোচ করা উচিত। এদিকে দৃষ্টি রাখিয়া আমরা আমাদের জাতীয় শিপিং লাইন ‘বাঙলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন বিগত ১৯৭২ সনে গঠন করি। আমাদের বর্তমান চাহিদা ও আর্থিক ক্ষমতার দিকে দৃষ্টি রাখিয়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন শুকনাে মালবাহী জাহাজ, ব্যাঙ্ক কেরিয়ার এবং তৈলবাহী জাহাজ সংগ্রহ করিয়া একটি পরিমিত বাণিজ্যিক বহর গঠন করার পরিকল্পনা হাতে লইয়াছে। এ যাবৎ বাংলাদশে শিপিং কর্পোরেশন ১৩টি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করিয়াছে। জাহাজ সংগ্রহ করার জন্য যথেষ্ট মূলধনের প্রয়ােজন এবং সরকার ও কর্পোরেশন সহজ শর্তাবলীতে ঋণ সংগ্রহের ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাইয়া যাইতেছেন। ( কথার বলে যে, শুধু শুধুই যন্ত্র বাজেনা, যন্ত্র বাজ্যইতে যন্ত্রীর প্রয়ােজন। আজকালকার এই প্রবল প্রতিযােগিতার যুগে সুষ্ঠুভাবে জাহাজ পরিচালনা করিতে আমাদের প্রয়ােজন এমন একদল অফিসার যাহারা হইবেন দেশপ্রেমিক জাতির জন্য নিবেদিত ধ্যান, কঠোর পরিশ্রমী এবং সর্বোপরি সুশৃংখল। একমাত্র মেরি একাডেমীই আমাদের এ ধরনের অফিসার গড়িয়া দিতে পারে। এজন্য মেরিন একাডেমীর গুরুত্ব এত বেশী এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার সজাগ আছেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস পরেই সরকার একাডেমীতে প্রশিক্ষণ চালু করেন। এই একাডেমীকে আন্তর্জাতিক নির্ধারিত মানে উন্নীত করার জন্য সরকার বন্ধুদেশসমূহ হইতে সাহায্য-সহযােগিতা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন।
এব্যাপারে বন্ধুদেশ বৃটেন হতে প্রাপ্ত সাহায্যের কথা উল্লেখ না করিলে অবিচার করা হইবে। প্রায় এক বৎসর পূর্বে জাহাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ যুক্তরাজ্যের নাগরিক ক্যাপটেন এপাস লেটী এই একাডেমীতে কমান্ডডেন্ট হিসাবে যােগদান করেন। গত বৎসর একজন ‘নটিক্যাল শিক্ষক ও একজন স্বেচ্ছায়-শ্ৰমদানকারী শিক্ষক এই একাডেমীতে যােগদান করেন। আমরা আশা করিতেছি যে ব্রিটেন হইতে একজন প্রকৌশলী শিক্ষক আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি এই একাডেমীতে যােগদান করিবেন। এসব ছাড়াও যুক্তরাজা সরকার বৃটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে একাডেমেিক পর্যাপ্ত পরিমাণ পুস্তক দান করেন। ভবিষ্যতে আরও অধিক পরিমাণ সাহায্যসহযােগিতা যুক্তরাজ্য সরকারের নিকট হইতে পাওয়ার আশা আছে। বৃটিশ হাইকমিশনারের মাধ্যমে তাঁহাদের এরূপ সাহায্য-সহযােগিতার জন্য বৃটেনের সরকার ও জনগণকে আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি। সুধীমণ্ডলী বাণিজ্যিক বহুত্বের ক্যাডেট অফিসারদের মাস্টার, মেট ও প্রকৌশলীর উচ্চমানের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য অদ্যাবধি বাংলাদেশে কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থা নাই। যার দরুন আমাদের ছেলেরা প্রয়ােজনীয় কাল সমুদ্রে চাকুরী করার পর পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য অথবা ভারতে গমন করে। স্বভাবতঃই পরীক্ষার্থীদের নানারূপ অসুবিধা ছাড়াও আমাদের কষ্টটাজিত বৈদেশিক মুদ্রার বহুল পরিমাণ ব্যয় হয়। এই অসুবিধা দূরীকরণের জন্য উক্ত পরীক্ষা বাংলাদেশে গ্রহণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্য সরকারের ব্যবসা ও শিল্প বিভাগের সহযােগিতার জন্য যােগাযােগ করা হইয়াছে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইলে ভবিষ্যতে পরীক্ষার্থীরা আনুষঙ্গিক শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক হয়রানি হইতে রেহাই পাইবে এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজ হ্রাস পাইবে।
১৯৭৪ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ডকইয়ার্ড ও শিপইয়ার্ডে প্রকৌশলী শিক্ষাবিদ ক্যাডেটদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের সমস্যাদি পর্যবেক্ষণ করিয়া সরকারের নিকট ও সমস্যাদি সমাধানের সুপারিশ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশ বর্তমানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সক্রিয় বিবেচনাধীন রহিয়াছে। কমিটির এই সুপারিশ বাস্তবাযিত হইলে মেরিন প্রকৌশলীদের ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হইবে।
প্রিয বিদায়ী ক্যাডেটগণ, কমান্ডডেন্টের নিকট হইতে তােমাদের একাডেমীর প্রশিক্ষণকালীন। কার্য বিবরণী শুনিয়া এবং আজ স্বচক্ষে যাহা দেখিয়াছি তাহাতে আমি সন্তুষ্ট। এই একাডেমীর প্রশিক্ষণের পর একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করার সুযােগ তােমরা পাইয়াছ। তােমাদের মনে রাখা উচিত, এখানকার প্রশিক্ষণ কর্মসূচী শেষ করার পর প্রকৃতপক্ষে তােমাদের মূল প্রশিক্ষণ শুরু হইল। তােমাদের আরও কষ্ট স্বীকার করার অভ্যাস করিতে হইবে। কারণ, তােমাদের বদলে কাজ করার জন্য অন্য কাউকে পাইবে না। তােমার পেশাতে অধিকতর জ্ঞান অর্জন কর। যত বেশী জানিবে তত বেশী তুমি নিজেকে সাহায্য করিতে পারিবে এবং দেশের সেবা করিতে পারিবে। আমরা আমাদের জাতীয় বাণিজ্যিক বহরকে শক্তিশালী করিতে চাই। আর তােমরা হইলে, আমাদের ঈপিমত বাণিজ্যিক বহরের প্রাণকেন্দ্র। আমাদের বাণিজিক্য বহরের ভবিষ্যৎ তােমাদের প্রচেষ্টা, পরিশ্রম ও কর্মদক্ষতার উপর নির্ভর করিবে। তােমাদের পেশার মাধ্যমে নানাদেশ ভ্রমণ ও নানাজাতির লোেকদের সহিত মেলামেশার পর্যাপ্ত সুযােগ পাইবে। তােমরা যাহাতে অন্য দেশের লােকদের সামাজিক রীতি, সংস্কৃতি ও তাহাদের বংশানুক্রমিক প্রথা সম্বন্ধে সহনশীল হইতে পার ও সেগুলির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিতে পার তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হইবে যাহাতে অন্যান্য দেশের লােকেরা প্রতিদানে তােমাদের দেশের সুনাম করে। তােমাদের আচরণ ও ব্যবহার এমন উচ্চমানের হওয়া উচিত যে, তােমাদের মধ্যে অন্যরা তােমাদের দেশের ভাবমূর্তিকে দেখিতে পায়। এই প্রকারে তােমরা দেশের বেসরকারী দূত হিসাবে কাজ করিতে পার। আমি আশা করিব, তােমাদের উপর এই অর্পিত দায়িত্ব পালনে তােমরা সব সময় কৃতকার্য হইবে।
একাডেমীর জুনিয়ার ক্যাডেটদের প্রতি আমার উপদেশ, তােমরা একাডেমীতে প্রাপ্ত সুযােগসুবিধাদি পুরাপুরিভাবে সদ্ব্যবহার করিবে এবং আশা করিব যে, তােমরা তােমাদের পূর্ববর্তী ক্যাডেট ভাইদের চেয়ে উন্নততর প্রশিক্ষণ লাভ করিবে ও অধিকতর সম্মান লাভ করিবে।
পরিশেষে আমি একাডেমীর কমান্ডডেন্ট এবং অন্যান্য প্রশিক্ষকদের তাঁহাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দুই বৎসরেরও কম সময়ের মধ্যে এই যুবকদের এত উচ্চমানে উন্নীত করার জন্য অভিনন্দন জানাইতেছি। আপনাদের এই আত্মনিবেদিত সেবা ও পরিশ্রম নিশ্চয়ই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ইঙ্গিত সােনার বাংলা গড়িয়া তুলিতে সহায়ক হইবে। আপনাদের সবাইকে জানাই আমি আন্তরিক ধন্যবাদ। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ জুন ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত