দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত ও লৌহের কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হইতেছে
রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শিল্পমন্ত্রী জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত ও লৌহের কারখানা প্রতিষ্ঠায় জন্য বিশেষ উদ্যোগে নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিকট গুরুত্ব আরােপ করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে।
ভারতসহ পৃথিবীর ১৬টি দেশে আকরিক লৌহ পাওয়া যায়। আমদানীকৃত এই আকরিক লােহার ভিত্তিতে দেশে একটি পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত ও লােহার কারখানা প্রতিষ্ঠা করা যায়। জাপানে আকরিক লৌহ না থাকিলেও আমদানীকৃত লৌহের ভিত্তিতে জাপান ইস্পাত শিল্পে বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করিয়াছে। বাংলাদেশ সরকারও জাপানের আদর্শে ইস্পাত শিল্প গড়িয়া তুলিতে চান।
বার্ষিক দেড় কোটি টন উৎপাদন ক্ষমতা বিশিষ্ট এই কারখানা স্থাপন করিতে প্রায় দশ বছর সময় লাগিবে। ইহার জন্য দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন প্রয়ােজন হইবে।
ইস্পাত শিল্প দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। সে দেশ ইস্পাত শিল্প উন্নত, সে দেশের জনসাধারণ তেমনি উন্নত ও সমৃদ্ধ।
এই প্রশ্ন বিবেচনা করিয়া নেতৃবৃন্দ দেশে ইস্পাত কারখানা গড়িয়া তােলার জন্য সর্বাত্মক। প্রচেষ্টা চালাইবার সিদ্ধান্ত নিয়াছেন। বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র এই ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাহায্য করিবে বলিয়া আশা করা হইতেছে। অবশ্য একটি মহান রাষ্ট্র এই প্রস্তাব কার্যকরী করিবে বলিয়া আশা হইতেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পশ্চিম জার্মানি, রাশিয়া ও জাপান ইস্পাত শিল্পে বিপুল অগ্রগতি সাধন করিয়াছে। ভারত ও নয়াচীনের ইস্পাত শিল্পে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সাধিত হইয়াছে। ভারত, রাশিয়া, ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা ফিনল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, লাইবেরিয়া ও নাইজেরিয়া আকরিক লৌহ রফতানী করে।
বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে আকরিক লৌহ আমদানীর ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলাদেশের জনগণ কঠোর পরিশ্রম করিয়া নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিলে ইস্পাত শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদীতে বিপুল অর্থ ও আকরিক লৌহ সরবরাহ লাভ করা সম্ভব হইবে বলিয়া বিশেষজ্ঞরা দৃঢ় আশা প্রকাশ করেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ ষ্টীল মিলস কর্পোরেশন ভারতের ষ্টীল অথরিটির উদ্যোগে একটি আয়রণ কারখানা স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়াছে। এই কারখানা পূর্ণাঙ্গ কারখানা করা হইবে; অথবা অন্য একটি বৃহদাকার পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত কারখানা স্থাপন করা হইবে। কর্ণফুলী নদীর পাড়ে এই বিরাট ইস্পাত কারখানা ঘড়িয়া তােলার উপযুক্ত স্থান বিবেচিত হইবে বলিয়া বিশেষজ্ঞরা অভিমত দেন। এই কারখানা স্থাপিত হইলে দেশের অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন সম্ভব হইবে। দেশে তখন বহু কল কারখানা গড়িয়া উঠিবে। ইঞ্জিনিয়ার শিল্পের বিরাট অগ্রগতি সাধন হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেতু নির্মাণের জন্য যন্ত্রপাতি ও ইস্পাত দ্রব্যাদি প্রস্তুত হইবে। কৃষির উন্নয়নের জন্য কল-কজা তৈয়ার হইবে। বস্তুত ইস্পাত শিল্প গড়িয়া উঠিলে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হইবে। বন্ধু ও সহযােগিতার ভিত্তিতে এই বিরাট ইস্পাত শিল্প গড়িয়া উঠিবে-বিশেষজ্ঞরা ইহা বিশ্বাস করেন। উল্লেখযােগ্য যে, দক্ষিণ কোরিয়া বার্ষিক ৮৫ লক্ষ উৎপাদন ক্ষমতাবিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত কারখানা নির্মাণ করিতেছে। দক্ষিণ কোরিয়া বাক বর্তমানে ৩৬ লক্ষ টন ইস্পাত উৎপাদন করে। উত্তর কোরিয়া ইস্পাত উৎপাদনের পরিমাণ ও দক্ষিণ কোরিয়ার উৎপাদনের চেয়ে কম নয়। উত্তর কোরিয়াও পূর্ণাঙ্গ ইস্পাত শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়াছে।
সাড়ে সাত কোটি লােকের দেশ বাংলাদেশ ইস্পাত শিল্পে পিছাইয়া থাকিতে পারে না। ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হইলে বাংলাদেশ বার্ষিক ৩শত থেকে ৫ শত কোটি টাকা পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাইতে পারিবে।
সূত্র: দৈনিক আজাদ, ৫ এপ্রিল ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত