গ্রামে গ্রামে সমবায় ক্ষেতে খামারে ছড়িয়ে পড়:
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ: পুরােদেশে নতুন সমাজ গড়তে হবে
বাঙালি জাতির জনক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরাতন ঘুণেধরা পচা সমাজকে ভেঙ্গে চুরে নতুনদেশে এক নতুন সমাজ গড়ে তােলার সৌহদৃঢ় ঘােষণা করেছেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ঔপনিবেশক আর পাকিস্তান আমলের সমাজব্যবসথা স্বাধীন বাংলাদেশে চলতে পারে না। নতুন করে ঢেলে সাজাতে তা হলেই দেশে মঙ্গল হতে পারে, না হলে আসবে না।
গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে তিনটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পঞ্চম স্বাধীনতা দিবসে ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়ােজিত বিশাল সভায় ভাষণ দানকালে অযুত জনতার তুমুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্যে জাতীয় দলের বঙ্গবন্ধু একথা ঘােষণা করেন। দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম জনসভা।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দেশে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলার লক্ষ্যে কতকগুলাে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও ঘােষণা দেন। তিনি বলেন, এখন সমস্ত মহকুমা জেলায় রূপান্তরিত হবে এবং জেলা ও থানা পর্যায়ে সরকারী কর্মচারী, জাতীয় দল, কৃষক শ্রমিক ও যুদ্ধ প্রতিনিধি সমন্বয়ে প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠিত হবে। তিনি ব্যক্তি মালিকানা অব্যাহত রেখে দেশের প্রতিট গ্রামে একটি করে বহুমুখী সমবায় স্থাপনের কথাও বলেন।
প্রতি গ্রামে সমবায়
তিনি বলেন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্যে দেশের ৬৫ হাজার গ্রামে পরিকল্পাধীনে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে এটা করে বহুমুখী সমবায় স্থাপন করা হবে। কৃষিযােগ্য সব জমি এই সমবায়ের আওতায় আনা হবে। কারাে জমি নিয়ে নেয়া হবে না, যার জমি তারই থাকবে। তবে গ্রামের সমস্ত কর্মক্ষম ব্যক্তি ও ভূমিহীন কৃষকরাও এই সমবায়ের সদস্য হতে পারবেন এবং শ্রমের বিনিময়ে উৎপাদনের ভাগ পাবেন। সরকার এসব সমবায়কে ঋণ, সার, বীজ, পাম্প, সাহায্য দেবেন। পর্যায়ক্রমে বর্তমান ইউনিয়ন কাউন্সিল থাকবে না, সমবায় সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
বঙ্গবন্ধু বর্তমানে প্রচলিত বিচার পদ্ধতির দীর্ঘসূত্রতার উল্লেখ করে জানান যে, এর পরিবর্তন করা হবে। এবং জনগণকে দ্রুত দেশের, শৃংখলা ফিরিয়ে আনা ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাের জন্যে আমি এই পদ্ধতি প্রবর্তন করেছি। আমি শােষকের নয়, শােষিতের গণতন্ত্র চাই। | তিনি শিক্ষিত সমাজকে চরিত্র সংশােধনের জন্যে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমার কৃষক, শ্রমিকরা দুর্নীতিবাজ নয়। যারা ঘুষ খায়, মজুতদারি করে, বিদেশী এজেন্ট হয় তারা শিক্ষিত সমাজেরই অংশ এবং শতকরা পাঁচজনের অন্তর্ভুক্ত। তিনি শিক্ষিত সমাজ ও সরকারী কর্মচারীদের সফল উন্নসিকতা পরিত্যাগ করে দেশের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে যথাযােগ্য সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানান।
পররাষ্ট্র নীতি
বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ সহবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বাসী। আমরা কাকে সাথে শত্রুতা চাই না। সকলের বন্ধুত্ব চাই। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে প্যালেস্টাইনীদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাদের পরশে থাকব। বঙ্গবন্ধু বন্ধু ও অস্ত্র প্রতিযােগিতা পরিত্যাগ করে এর জন্য বরাদ্ধ অর্থ বিশ্বের গরীব দুঃস্থ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আহবান জানান। তিনি পাকিস্তানের প্রশ্নে বলেন বাংলাদেশের প্রাপ্ত সম্পদ ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার সাথে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তিনি পাকি প্রধানমন্ত্রি ভুট্টোকে বাগাড়ম্বর ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘর সামলানাের উপদেশ দেন।
দুর্নীতিবাজ কারা?
রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তীব্র গণসংগ্রাম শুরু করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আজকে দুর্নীতিবাজ যে কাজে ফাকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। সে স্মাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্লাক মার্কেটিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে হাের্ড (মজুত) করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে তারাও দুর্নীতিবাজ যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারাও দুর্নীতিবাজ এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, সরকারী আইন করে কোন দিন দুর্নীতিবাজদের দমন করা সম্ভব নয়, জনগণের সমর্থন ছাড়া। আজকে আমার একমাত্র অনুরােধ আপনাদের কাছে সেটা হল এই আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়, জেহাদ করতে হবে, যুদ্ধ করতে হবে শত্রুর বিরুদ্ধে। আজকে আমি বলতে চাই বাংলার জনগণকে, এক মাত্র কাজ হবে, দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করা।
সূত্র: সংবাদ, ২৭ মার্চ ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত