পৌরসভার বকেয়া কর
পৌনঃপুনিক তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও পৌরকর পরিশােধে করদাতাদের পক্ষ হইতে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় নাই। পৌর কর্তৃপক্ষ তাই এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানাইয়াছেন, আগামীকাল মঙ্গলবার হইতে ক্রোকী পরােয়ানা জারি শুরু হইবে। পৌরসভার ক্ৰোকী পরােয়ানা জারিকারী স্কোয়াড় বাড়ি বাড়ি গিয়া বসিয়া তদন্ত করিবেন। সে তদন্তকালে যাদের কর অনাদায় বলিয়া প্রমাণ হইবে তাদের নামে ক্ৰোকী পরােয়ানা জারি করিয়া বকেয়া আদায় করা হইবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, ঢাকা পৌরসভার লাখ লাখ টাকা কর বাকী রহিয়াছে। এই বকেয়া পরিশােধ করার জন্য পৌরকর্তৃপক্ষ দুইবার সময় দিয়াছেন। শেষ বার প্রদত্ত সময়সীমা চলতি মাসের ১০ তারিখ উত্তীর্ণ হইয়াছে। কিন্তু তারপরও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় নাই। তাই পৌরকর্তৃপক্ষ দৃঢ় মনােভাব গ্রহণ করিয়াছেন।
এই মনােভাব গ্রহণের পিছনে যে যুক্তি আছে তাতে সন্দেহ নাই। তবু বিষয়টি সম্পর্কে আমরা দুইএকটি কথা বলা প্রয়ােজন বােধ করি। আমাদের ধারণা, প্রধানতঃ দুইটি কারণে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া পড়িয়াছে। যথা অক্ষমতা ও অনীহা। সময়মত কর পরিশােধ না করিলে করের বােঝা বৃদ্ধি পাইয়া শুধু ঘাড় মটকাইতেই উদ্যত হইবে না, অপদস্থ হওয়া বিচিত্র নয়, একথা জানিয়া, বুঝিয়াও অনেকে কর পরিশােধ করিতে পারিতেছেন না। চাল আনিব, ছেলে-মেয়ের স্কুলের বেতন শােধ করিব, না আগে কর দিব ভাবিতে ভাবিতে শেষ পর্যন্ত তাহাদের পক্ষে কর দেওয়া হইতেছে না। পক্ষান্তরে, কিছুসংখ্যক আছেন যারা ইচ্ছা করিলেই দিতে পারেন। নেহাত ইচ্ছার অভাব হেতুই তাহাদের কর পরিশােধ হইতেছে না। ইহা শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, নিন্দনীয়ও বটে। এতে শুধু যে পৌরসভার বিভিন্ন কাজ-কর্মের সুষ্ঠু গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহা নহে, নাগরিক দায়িত্ববােধও লাঞ্ছিত হয়। দেই, দিচ্ছি, দেব’ করিয়া কোন সচেতন নাগরিক সরকারী কর-ট্যাক্স-খাজনা বাকী ফেলিয়া রাখিতে পারেন না। তাই ইহাদের উপর ক্ৰোকী পরােয়ানার লাঞ্ছনা নামিয়া আসাই উচিত। এ কথা উপলব্ধি না করার মত নয়। কিন্তু করিয়াও বৃহত্তর করদাতাদের স্বার্থে, যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পরিশােধ করিতে পারিতেছেন না তাহাদের কথা ভাবিয়া আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একটি সুপারিশ করিতেছি। এবং তাহা প্রধানত: দুইটি কারণে। যথা অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং সময়। একে করদাতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আর্থিক অনটনগ্রস্ত তদুপরি আবার মাসের শেষ। এই সময় কর আদায়কল্পে ক্ৰোকী পরােয়ানা জারি করার পিছনে যে দর্শন নিহিত তাহা সফল হইতে পারে না। অস্থাবর সম্পত্তিতে পৌর অঙ্গন শুধু কণ্টকাকীর্ণই হইতে পারে। তাই আমাদের বক্তব্য হইল, ইতিপূর্বে সময় যখন দেওয়াই হইয়াছে তখন আগামী মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ক্রোকী পরােয়ানা জারি স্থগিত রাখা হউক। দুই, অনেকের অনেক দিনের কর বাকী। সুতরাং ১০ তারিখের পর যখন ক্ৰোকী পরােয়ানা জারি রু হইবে তখন যাদের উর্ধ্বে দুইটি কিস্তি বাকী তাদের যেন অব্যাহতি দিয়া চলতির সঙ্গে দুই কিস্তির বকেয়া ধীরে ধীরে শােধ করার সুযােগ দেওয়া হয়।
উপসংহারে করদাতাদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য এই যে, এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, সােজা কথায় কাজ হয় না। এই ধরনের মানসিকতার প্রমাণ দিয়া অনেক কিছু আমরা হারাইয়াছি। এর পরিবর্তন না হইলে আরও অনেক মূল্য দিতে হইবে। তাছাড়া আজ না-হােক কাল, একদিন-না-একদিন যা পরিশােধ করিতেই হইবে তাহা জমা করিয়া বােঝা ভারী করার কোন অর্থ নাই। দেশ বলিতে যখন ব্যক্তিবিশেষ না বুঝাইয়া দেশের মানুষ বুঝায় তখন প্রত্যেকেরই নিজ নিজ কর্তব্যনিষ্ঠার প্রমাণ দেওয়া উচিত। আশা করি, ভবিষ্যতে এর প্রমাণ দিতে আমরা অসমর্থ হইব না।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত