You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.22 | সম্পাদকীয়: প্রহরী সাবধান | দৃষ্টিপাত - সংগ্রামের নোটবুক

সম্পাদকীয়: প্রহরী সাবধান

অনেক অনেক রক্তপাত স্বস্তি পরিষদে মার্কিণী ষড়যন্ত্রের তুফান ডিঙিয়ে, ইয়াহিয়াশাহীর ন’ মাসের নৃশংস অত্যাচারের অমানিশা কাটিয়ে অবশেষে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হল, কিন্তু তারপর কি? এই চিন্তাই বিশ্বের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মাথায় ঘােঘুিরপাক খাচ্ছে।
জাতিসঙ্ঘে ভেটোর পর ভেটো দিয়ে কোন প্রকারে মার্কিণ ষড়যন্ত্রের মােকাবেলা করলেন সােভিয়েৎ ইউনিয়ন, আর বাংলাদেশে পাকবাহিনীর মােকাবেলায় রইলেন ভারতীয় সেনাবাহিনী।
সব চাল ভেস্তে যায় দেখে সােভিয়েত রাষ্ট্রপতি মিঃ পদগর্ণি সতর্কবাণী উপেক্ষা করে আমেরিকা ও চীন যেন জড়িয়ে পড়তে চাইলে এ উপমহাদেশের অশান্তিকে আরাে জোরদার করতে। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে বসে নিকসন এক অছিলায় মার্কিণ সপ্তম নৌবহর ‘এন্টারপ্রাইজকে সদলে পাঠিয়ে দিলেন বঙ্গোপসাগরে। ওদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনা ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে বলে আরেক দফা মিথ্যা অভিযােগে চৌ এন লাই বিপুল সৈন্য সমাবেশ করলেন চীন-ভারত সীমান্তে। কিন্তু নিকসন-চৌ-ইয়াহিয়ার এই মারাত্মক খেলা জমার আগেই তাদেরকে কোন সুযােগ না দিয়েই নিপুণ খেলােয়ারীর মত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ফস করে বেরিয়ে গেলেন।
সমরে মরীয়া হয়ে তারা দ্বিতীয় রাউণ্ডের জন্য পায়তারা সুরু করেছেন। ইয়াহিয়াকে সরান হয়ে গেল তার বদলে পা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন ভারত-বিদ্বেষী অত্যন্ত নীচ প্রকৃতির রাজনীতিবিদ জুলফিকর আলী ভুট্টো। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটা সমঝােতার চেষ্টার কথা তিনি ইতিমধ্যেই ঘােষণা করেছেন। এই সঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ গ্রহণের কথাও তিনি বলতে ভুল করেন নি। মুসলমান। জনসমাজকে বিক্ষুব্ধ করার হাতিয়ার হিসাবে তিনি প্রচার করতে সুরু করেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী তথা কথিত পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে নাকি অত্যাচারের পর অত্যাচার করে চলেছে। ভীমরতিগ্রস্থ নুরুল আমিনও ইতিপূর্বে যুদ্ধবিরতির জন্য ইয়াহিয়ার উপর দোষারােপ করে অভিযােগ এনেছেন তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের রাজাকররাই নাকি এ অবস্থার মােকাবেলা করতে সক্ষম ছিল। পিপলস পার্টি চীনের সংগে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সকলই একটা অশুভ ইঙ্গিত বৈ ত নয়। এ পরিস্থিতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলে যাচ্ছে। সঙ্কট সমাধানত দূরের কথা নতুন নতুন রূপে তা দেখা দিচ্ছে। সুতরাং ঘটনার ক্ষিপ্ত গতির দিকে চোখ রেখে অতি সন্তর্পণে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে তাই এটা
হয়ে উঠেছে যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ধ্বংসের ভগ্নস্তুপ থেকে বেড়িয়ে এসে পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে পারবেন না আন্তর্জাতিক কু-চক্রের শিকার হয়ে তাদেরকে আরাে রক্ত দান করতে হবে।
এই কু-চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তথা মুক্তিবাহিনী তথা বাংলাদেশের জনসাধারণকে সহনশীলতা অবলম্বন করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সংগে আগামী দিনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে সকলেই যদি আইন হাতে নিয়ে নিতে চেষ্টা করেন তা হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশংকাই দেখা দেবে। প্রতিশােধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে দমিত করে সেই দায়িত্ব সরকারের উপরই ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারকেও অত্যন্ত কৃড়িৎ গতিতে আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। দালাল শ্রেণীর লােকদেরকে বিচারাধীন নিয়ে আসতে হবে। ভূট্টো-সিয়া-চৌ চক্র নতুন দালাল সৃষ্টি করে যাতে অন্তর্দ্বন্দ্ব লাগাতে না পারে সেজন্য অতি তীক্ষ ও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কিছুদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে থাকতে হবে আর অপ্রিয় হলেও অতি প্রয়ােজনীয় কাজগুলি করে যেতে হবে। তার জন্য সেনাবাহিনীকে হয়ত সমালােচনার সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু উপায় নেই। আন্দোলনের খাতিরে অল্প সময়ের জন্য যে মুক্তিবাহিনীর সৃষ্টি হয়ে ছিল। তাকে স্থায়ী সৈন্যবাহিনীতে রূপান্তর করা নানা কারণে সম্ভব নয়। সংগ্রামের পর এবার তাদেরকে ঘরকন্না করার বিশ্রাম করার সুযােগ দিতে হবে। সমগ্র বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র বে-সামরিক জনগণের হাতে পড়েছে। অস্ত্রশস্ত্র যেমন সমাজ বিরােধীদের হাতে থাকা সম্ভব তেমনি পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। লােকদের কাছেও থাকা সম্ভব। বহিঃশত্রুরা গৃহযুদ্ধ বাধানাের এই সুযােগ স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করতে পারে। তাই অতি দ্রুত ও সতর্কতার সংগে এই সকল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা না গেলে নবজাত বাংলাদেশে অশান্তির আশংকা থেকে যাচ্ছে। সেজন্যও ভারতীয় সেনাদের সাহায্য অতি প্রয়ােজন।
বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বেশকিছু হয়ত সময় লাগবে। তার জন্য মদত জুগিয়ে যেতে হবে ভারতকেই। বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেল ভারত তার সামান্নান্য)মাত্র পূরণে সক্ষম। সােভিয়েত ইউনিয়ন এই পুনর্গঠনের কাজে সহযােগিতা করতে প্রস্তুত। যতদিন তারা বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি না দিচ্ছেন ততদিন এই সাহায্য হয়ত ভারত মাধ্যমেই চলবে। কিন্তু যেদিন বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করবে সেদিন সােভিয়েতের সংগে সরাসরিই আলাপ আলােচনা আদান প্রদান চলবে। ভারত অবশ্য বিবেচনায় এই পরিবেশকে স্বাগত জানাবে। কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের কথা।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশী প্রয়ােজন শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তার জন্য ভারত সরকারকেও তীক্ষ দৃষ্টি রেখে চলতে হবে। ভারতে সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা জাতীয় আভ্যন্তরীণ গােলযােগ সৃষ্টি করে চৌ নিকসন ভূট্টোর দল একটা নজীর খাড়া করার যে চেষ্টা করবেনা তা বলা যায় না। সুতরাং প্রহরী সাবধান।

সূত্র: দৃষ্টিপাত, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১