You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.22 | সম্পাদকীয়: বিশ্বের ঐতিহাসিক বিস্ময় | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সম্পাদকীয়: বিশ্বের ঐতিহাসিক বিস্ময়

সারা বিশ্ব আজ স্তম্ভিত, হতবাক। ধনতন্ত্রবাদী বেইমান মার্কিনী নিক্সন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, সম্প্রসারণবাদী চীনাচক্র আজ বজ্রাহত, অপরদিকে ভারতের মহীয়সী, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সমুন্নতশিরে বিশ্ববন্দিত, পৃথিবীর অসামান্য বিপ্লবীনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সারা বিশ্বে আলােড়িত, ভারতীয় সেনাদলের এবং মুক্তিবাহিনীর সাড়াশী আক্রমণে উদ্ধত জঙ্গীশাহী আজ বাংলাদেশে আত্মসমর্পিত করুণাভিখারী।
সংগ্রামের বর্ষপূর্তির পূৰ্বেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করিয়া লইল। অনমনীয় দৃঢ়তা, স্বাধীনতা স্পৃহা; নিরলস কর্মমুখরতা সম্বল করিয়া বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ তরুণ তরুণী ভারতীয় জোয়ানদের সহযােগিতায় তাহাদের পুণ্যমাতৃভূমিকে পাপাচারী পাকিস্তানের কবল হইতে মুক্ত করিল। এহিয়াগােষ্ঠীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইতে চলিল।
ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজবাদ, গণতন্ত্র এবং আত্মকর্তৃত্বের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ বিশ্বে তাহাদের যােগ্যস্থান দখল করিয়া লইল। যত শীঘ্র সম্ভব বঙ্গবন্ধু এহিয়াশাহী কারাগার হইতে মুক্ত হইয়া বাংলাদেশে আগমন করতঃ স্বাধীন বাংলাদেশের সাৰ্বভৌম সরকার গঠন করিলে উপমহাদেশ সত্বরই উপকৃত হইবে।
বাংলাদেশ পুনর্গঠন ব্যাপারে সে দেশের মন্ত্রীসভা অবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপে আগাইয়া চলিবেন এ বিশ্বাস সকলেরই রহিয়াছে।।
এহিয়াখানের খামখেয়ালীতে, জঙ্গীশাহীর অবাস্তব রাজনীতিতে ভারত পাকিস্তান উপমহাদেশের অবর্ণনীয় ক্ষতি হইল ; পাকিস্তান রূপী ১২ কোটী অধিবাসীর রাষ্ট্র মাত্র ৫ কোটী মানুষের একটা রাজ্যে রূপায়িত হইল। বিদেশী মহাপ্রভুদের সংকেতে পরিচালিত এহিয়া খান পাকিস্থান ধ্বংসের কারণ হইলেন।
বাংলাদেশে এহিয়াশাহীর অকথ্য অত্যাচার ও অনাচারের মূলে নাটের গুরু মার্কিন রাষ্ট্রপতি মিঃ নিক্সন যে ন্যাক্কারজনক রাজনীতির ও কপটতার ভূমিকা লইয়াছিলেন সভ্যজগৎ তাহাতে স্তম্ভিত।
সােভিয়েট রাশিয়া বাস্তবভাবে প্রমাণ দিল গণতন্ত্রের শত্রুদের সুখদ্রিা আর বেশী দিন চলিবে না। রাশিয়ার সাম্প্রতিক ভূমিকা ভারত ও বাংলাদেশবাসী এমন কি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশ্ববাসী চিরকাল স্মরণ রাখিবে।
এবার ভারতের সেনাবাহিনীর জল, স্থল ও বিমানশাখার জোয়ানরা যে কৃতিত্ব প্রদর্শন করিল অন্যেরা না হউক ভারতবাসী ও বাংলাদেশবাসীরা সুদীর্ঘকাল কৃতজ্ঞতার সহিত তাহাও স্মরণ করিবে।।
ভারতের জনগণমন অধিনায়িকা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ও তাহার সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দূরদর্শিতামূলক কূটনীতি, মানবতামূলকভাবে শরণার্থী সেবা-সাহায্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবী সমর্থনে বিজ্ঞজনােচিত ভূমিকা; বিশ্বরাজনীতির তথাকথিত মােড়লদের কপটতা বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। সর্বোপরি শ্রীমতী গান্ধীর অনমনীয় দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্ব বিশ্বের বিস্ময় হইয়া রহিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে সাতকোটী বাঙালীকে যেভাবে মুক্তি পাগল করিয়াছিলেন ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই। যাহার মন্ত্রে মাতিয়া কত পিতা তাহার কিশাের পুত্রকে, কত স্ত্রী স্বামীকে, কত মা তাহার একমাত্র সন্তানকে মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করাইয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিতে আগাইয়া দিয়াছিল সে সবের নজির ইতিহাসের পাতা জ্বলজ্বল করিয়া রাখিবে। বাঙালীদের মুক্তি সংগ্রাম ইতিহাসের বিস্ময়কর এবং স্মরণীয় ঘটনা হইয়া গেল।।
গত ১লা মার্চ হইতে আরম্ভ করিয়া দশমাস মধ্যে সম্পূর্ণ পরপদানত পূর্বপাকিস্তানকে বাংলাদেশ নামে রূপায়িত করতঃ স্বাধীন বাংলাদেশে পরিনণত করা বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়।
বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় হইতেছে ধনতন্ত্রের মারণযন্ত্রের গর্বে গরীয়ান মার্কিন ৭ম নৌবহরকে ইসরাইল আরব যুদ্ধের সময়ে ভূমধ্যসাগরে; ভিয়েতনামের যুদ্ধে শ্যাম উপসাগরে; এবং সাম্প্রতিক যুদ্ধে সিঙ্গাপুর হইতে ভারত মহাসাগরে তাড়াকারী বিশ্ববিশ্রুত সােভিয়েট নৌ-বহর বালাটীক [বালটিক] ফ্লিটের সদা সচকিত ভূমিকা। তৎসহ স্মরণীয় হইয়া থাকিবে “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হইলে আমেরিকার ওয়াশিংটন সহরেই তাহার সূচনা হইবে” বলিয়া সােভিয়েট রাশিয়ার পররাষ্ট্র দফতরের হুশিয়ারী।
স্বাধীন বাংলাদেশের ভাবীকালের ইতিহাসে কুখ্যাত ঘৃণ্যজীব বলিয়া যাহাদের নাম মুদ্রিত হইয়া থাকিবে। তাহারা হইতেছেন পাকিস্তানের কুখ্যাত ডিক্টেটার আগা মােহাম্মদ এহিয়াখান, লেঃ জেনারেল টিক্কাখান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, নুরুল আমিন, আবদুল মােনায়েম খান, ডাঃ মালিক, মাহমুদ আলী এরা।
আজ আমরা ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীসহ ভারত সরকারকে, ভারতের সর্বস্তরের সামরিক অৰ্দ্ধসামরিক বাহিনীকে, সােভিয়েট রাশিয়ার সরকার ও জনগণকে। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাসকল সহ বাংলাদেশবাসীদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সপ্রতিবেশিত্ব ধর্মনিরপেক্ষতা, একতা, সংহতি এবং মানবীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ মহান ভারতের মানবগােষ্ঠীকে, ভারত ও বাংলাদেশের পবিত্র …. প্রতি ধূলিকণাকে আমরা অন্তরের সহিত বিনম্র কৃতজ্ঞতা।

সূত্র: আজাদ, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১