সম্পাদকীয়: বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় চিন্তা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ছয় মাসের অধিক কাল অতিক্রান্ত হইয়াছে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং তাহার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইয়াছে, সেই সম্পর্কে ভারতবর্ষের জনসাধারণের একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্মিয়াছে। সেই সঙ্গে ব্যাপক শরণার্থী সমস্যা শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে পৌঁছিতে পারে, তাহারও একটা আভাস পাওয়া গিয়াছে। একথা এখন সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদী হইবে, এবং ভারত সরকার এবং ভারতের জনসাধারণ এই সংগ্রামের প্রতিক্রিয়ায় যে সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, তাহাও দীর্ঘদিন ধরিয়া বহন করিতে হইবে। অতএব সরকারী এবং বেসরকারী উভয় স্তরেই এই দুরূহ দায়িত্ব পালনের মত সাহসিকতা সৃষ্টির প্রয়ােজনীয়তা রহিয়াছে।
একথা অস্বীকার করিয়া লাভ নাই যে বাংলাদেশের গণ আন্দোলনের প্রকৃতি এবং বিবর্তন সম্পর্কে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক মহলের খুব একটা স্পষ্ট ধারণা কতিপয় বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম ব্যতীত অন্য কাহারও ছিল না। অতএব প্রথম যখন বাংলাদেশে বিস্ফোরণ ঘটিল, তখন ভারতবর্ষের সর্বত্র একটা হতচকিত ভাব লক্ষ্য করা গিয়াছিল এবং প্রধানমন্ত্রী গান্ধী যখন অতিদ্রুত এই সম্পর্কে কতকগুলি ব্যবস্থা গ্রহণ করিলেন, তখনও আমাদের সরকারী যন্ত্র তাহার সহিত তাল মিলাইয়া চলিতে পারে নাই। এবং সেই ইতঃস্তত ভাব এখনও কিয়ৎ পরিমাণে বজায় আছে। ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহ অবশ্য শ্রীমতী গান্ধীর গৃহীত ব্যবস্থাদি একবাক্যে সমর্থন দিয়া আরাে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবীও জানাইয়াছে, কিন্তু এই সমর্থনে আবেগের প্রাবল্য যতখানি ছিল, যুক্তিনির্ভর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ততখানি ছিল না, যে কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আরও কার্যকরী সাহায্য প্রদান সম্পর্কে কোন গ্রহণযােগ্য পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত কোন দলই দিতে পারে নাই। শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা বর্তমানে ভারতীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বকে একেবারে বিমূঢ় করিয়া ফেলিয়াছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এই সংস্কট হইতে মুক্ত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকায় আমাদের জাতীয় জীবনে এক ধরণের হতাশার সঞ্চার হইয়াছে। যথার্থ এবং কার্যকরী মনােভাব লইয়া ভারতের সরকারী এবং বেসরকারী নেতৃত্ব যদি এই সমস্যার মােকাবিলায় অগ্রসর না হন, তবে এই হতাশা বিস্তৃত হইয়া পৰ্য্যাপ্ত ক্ষতির কারণ ঘটাইবে।
অতএব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শরণার্থী সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে ভারত সরকারের মনােভাব এবং পরিকল্পনা কি, তাহা এখনই ঘঘাষিত হওয়া প্রয়ােজন। সরকারের তরফ হইতে জনসাধারণকে সুস্পষ্টভাবে জানাইয়া দেওয়া দরকার যে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রয়ােজন হইলে ভারত সরকার দীর্ঘ মেয়াদী দায়িত্ব গ্রহণে প্রস্তুত এবং তজ্জন্য দেশবাসীকে পর্যাপ্ত ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে। আন্তর্জাতিক মানব সমাজের পক্ষ হইতে বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর দায় আমরা গ্রহণ করিয়াছি এবং সেই দায় আমরা বহন করিব। কিন্তু তদপেক্ষা বৃহত্তর দায়িত্ব আমাদের রহিয়াছে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি। শুধুমাত্র শরণার্থী সমস্যার সমাধানের জন্যই যে আমরা বাংলাদেশের এই সংগ্রামে সাহায্য করিব তাহা নয়, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সগ্রামের সৈনিকদের সাহায্য করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য, নইলে স্বাধীন ভারতের গত ২৪ বৎসরের গণতন্ত্রের সাধনা অর্থহীন হইয়া পড়িবে। আমাদের একথা মনে রাখিতে হইবে যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর এই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষ তাহার রাষ্ট্রাদর্শের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালনের সুযােগ পাইয়াছে। এই সুযােগ ব্যর্থ হইলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সম্মান এবং প্রতিকৃতি ক্ষুন্ন হইবে। তাই যে কোন মূল্যে সেই দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রতিটি ভারতবাসীকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে।
সূত্র: যুগশক্তি, ৮ অক্টোবর ১৯৭১