সম্পাদকীয়: জালিমের জুলুম বন্ধ হউক
কালের গতি কেহ রােধ করিতে পারে না, দীর্ঘকাল কোন জাতিকে পদানত রাখা যায় না, আবার বিনা ত্যাগ বা সাধনায় কোন মহৎ ফল লাভ হয় না; সযত্নে লালিত পালিত মালদহের আমগাছে যখন মুকুল দেয় অনাদরে রক্ষিত মনিপুরের আমগাছেও তখন মুকুল হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত পৃথিবীর দিকে দিকে পরাধীন, পদানত নিপীড়িত মানবদেবতার ও অবজ্ঞাত রাষ্ট্রের জনগণের জয়ধ্বনি শােনা যাইতেছে। এশিয়া আফ্রিকার পরাধীন দেশগুলি একে একে স্বাধীনতা লাভ করিয়া আগাইয়া চলিতেছে। কঙ্গো হইতে আরম্ভ করিয়া হউক, আর মরক্কো হইতে আরম্ভ করিয়া মালয়েশিয়া পর্যন্ত হউক, সর্বত্রই জাগরণের শিহরণ, বাঁচিবার উন্মাদনা, আত্ম-প্রতিষ্ঠার প্রেরণা আপনাআপনিই আত্মপ্রকাশ করিতেছে।।
সত্য বটে, মুসলীম লীগের বুদ্ধিজীবী নেতারা স্বাধীনতা লাভের জন্য ত্যাগ, কারাবরণ এসব কিছুই করেন নাই, সত্য বটে মুসলীম লীগের হর্তাকত্তা বিধাতারা শুধু বুদ্ধি ও চালাকী দ্বারা, ইংরেজের ধুরন্ধরী দুয়ােসুয়াে নীতির ও মাউন্টবেটনী-চার্চিলী চক্রান্তে জাতীয় কংগ্রেসের ত্যাগ সাধনায়, আত্মদানে লব্ধ স্বাধীনতারূপী হরিণীর একটা অংশ লাভ করিয়াছিলেন; জিন্না-লিয়াকত আলী হইতে আরম্ভ করিয়া আবদুল রব নিস্তার ইব্রাহিম চুন্দীন্দ্রিগড় জাফরুল্লা, হেদায়েতুল্লা নাজিম ছােহরাওয়ার্দি এরা শুধু কথার ভাওতা দিয়া আরাম চেয়ারে বসিয়া, বিলাস-ব্যসনে ডুবিয়া থাকিয়া পাকিস্তানরূপী সােনার হাঁস পাইয়াছিলেন, মজা লুটিয়াছিলেন, পাক-রাষ্ট্রপতি, পাক প্রধানমন্ত্রী এসব বড় বড় তখমা লাভ করিয়াছিলেন, ইহারা স্বাধীনতা লাভের জন্য বিন্দুমাত্র ত্যাগ বা সাধনা করেন নাই।
কংগ্রেসের সদস্য বা সেবক হিসাবে পশ্চিম ভারতের খান আবদুল গফুর (গাফফার] খান, আতাউর বােখারী, ডাক্তার খান-সাহেব, ওবায়দুল্লা সিন্ধী, লালা দুনীচাদ, লালালজপত রায় প্রমুখ হাজার হাজার নিপীড়িত ভারত সন্তান, আর পূর্বভারতের খুদিরাম, সুৰ্য্যসেন তিতুমীর, আবদুল রসুল, আশরাফ উদ্দিন, মনিরুজ্জামান, ফজলুল হক, জালাল উদ্দিন হাসেমী, আহমদ আলী, আবদুর, মতীন, কামিনী দত্ত, ধীরেন্দ্র দত্ত, বসন্তকুমার দাস, ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী, ইব্রাহিম আলী, করুণাসিন্ধু আদি শত শত ত্যাগী নিপীড়িত দেশসেবীদের রক্তদানের কথা পাকিস্তানের স্বয়ম্ভ নেতারা ক্ষণেকের জন্য স্মরণ না করিয়া বরং আরাে কোণঠাসা করার চক্রান্ত করিয়া দীর্ঘ ২৪ বৎসর কাল সীমান্ত গান্ধীর প্রস্তাবিত আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীকে নস্যাৎ করার জন্য যেমন অমানুষিক বা পাশবিক অত্যাচার চালাইলেন, পূৰ্ব্ববাংলার নিপীড়িত, শােষিত মানবতার ন্যূনতম দাবী চাপা দেওয়ার জন্য মুজিবুর রহমান, মাহমুদ আলী, যতীন ভদ্র, ত্রৈলােক্য চক্রবর্তী, আশরাফ উদ্দিন, হামিদুর রহমান আদি শত শত বাঙালী যুবককে চরম নির্যাতন করিলেন, বৎসরের পর বৎসর জেলে পচাইলেন, নপুংসক করার সকল ব্যবস্থা করিলেন পাঞ্জাবী-পাঠানী সামন্ততন্ত্রের প্রাধান্য বাড়াইবার জন্য। পূর্ববাংলার ৮ কোটি মানুষকে দাসের, সেবকের জাতিতে পরিণত করার জন্য, পূর্ববাংলার বাঙালীদেরে রুজীকামলা, মাটীকামলা মাছ শিকারী, ভিক্ষুকে পরিণত করার জন্য। পূর্ববাংলার হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে হাজার হাজার বাঙালী ভারতের স্বাধীনতার জন্য জান, মান, সম্মান বিসর্জন দিয়াছিল হাসিমুখে, তাহাদের বগলদাবা দেওয়ার জন্য ফিল্ড মার্শাল আয়ুবখান, জেনারেল মুসাখান আর ঈদানীং জেনারেল এহিয়াখান, টিক্কাখান যাহা করিয়া চলিলেন সভ্য জগতের ইতিহাসে, ডিক্টেটর হিটলার মুসােলিনীর আচরণেও সে সবের স্থান নাই। ৮ কোটী বাঙালীকে পদানত রাখার জন্য জঙ্গী পাঠানী চক্রান্ত, ২ কোটী পাঠান তথা তাহাদের নেতা খান আবদুল গফুরখানকে তিলে তিলে হত্যা করার জন্য যুদ্ধবাজ পাঠানী শয়তান আজ সারা সভ্যজগৎকে স্তম্ভিত করিয়া দিতেছে।
মদের বােতলে শরিয়ত ও পাকিস্তান এই লেবেল লাগাইয়া আজ পাঠান শয়তান মুসলমানদেরে ধােকা দিয়া গণতন্ত্রী ইসলামকে কলঙ্কিত করিতেছে। পৃথিবীর ৪১টা মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র তিনটী মুসলিম রাষ্ট্র (যেগুলি আয়ুব-এহিয়া অনুবর্তী) পাঠানী শয়তানির দোসর, আর ৩৮টী মুসলিম দেশ পাকিস্তানী শাসকদের নীতি ও আদর্শের ঘাের বিরােধী।
সূত্র: আজাদ, ৭ এপ্রিল ১৯৭১