You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.01.12 | পাক-বন্দীদশা হইতে মুক্তি | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

পাক-বন্দীদশা হইতে মুক্তি

দীর্ঘ নয় মাস ১৪ দিন পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকগােষ্ঠীর কারাবাসে থাকার পর গত দুই জানুয়ারী রাত্রি ৩ ঘটিকার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করেন। রাওয়ালপিণ্ডি হইতে তখন তিনি পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের একখানা ভাড়া করা বিমানে এক অজানা পথে রওয়ানা হন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মিঃ ভুট্টো শেখ সাহেবকে রাওয়ালপিণ্ডি বিমানবন্দরে বিদায় সংবর্ধনা জানাইতে উপস্থিত ছিলেন। সমগ্র বিশ্বের কোটী কোটী মানুষের চরম উৎকণ্ঠার অবসান ঘটাইয়া ঐ বিমানখানা বেলা ১ ঘটিকায় লণ্ডন বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এই সংবাদ বৃটিশ রেডিও মারফতে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর উৎকণ্ঠিত মানুষ জানিতে পারে যে শেখ মুজিবুর রহমান সশরীরে এক মিত্র ভাবাপন্ন রাষ্ট্রে নিরাপদে পৌঁছিয়াছেন।
তিনি লণ্ডন বিমানবন্দরে বৃটিশ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক অভ্যর্থিত হন এবং একখানা অভিজাত হােটেলে চলিয়া যান। হােটেলে যাওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁহার সহিত টেলিফোনে কথাবার্তা বলেন। শ্রীমতী গান্ধী তাহাকে ভারত আগমনের জন্য অনুরােধ জানান। অতঃপর ঢাকা হইতে শেখ সাহেবের ১ম পুত্র শেখ কামাল পিতার সহিত টেলিফোনে কথাবার্তা বলেন। পুত্রের পাশে দণ্ডায়মান বেগম মুজিবুর স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনিয়া আনন্দে কাঁদিয়া ফেলেন এবং অজ্ঞান হইয়া পড়েন। ইহার পর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম শেখ সাহেবের সহিত টেলিফোনে আলাপ আলােচনা করেন।
শেখ সাহেব লণ্ডনে সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নের জবাব না দিলেও এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।

রাষ্ট্রপতি মুজিবের ভাষণ
কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়া মহান নায়ক বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের বন্ধু শেখ মুজবুর রহমান বলেন “আজ আমি আমার স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছি, এদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে যে ৩০ লক্ষ বাঙালী প্রাণদান করেছেন আমি তাদের আত্মার সদগতি কামনা করছি, যারা পুত্রহারা, স্বামীহারা ভাই-ভগ্নীহারা হয়েছেন আমি তাদের সমবেদনা জানাচ্ছি, সংগ্রামী ই, পি, আর, জাতীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীবৃন্দ, যুবকবৃন্দ, দেশের হিন্দু মুসলমান সৰ্বশ্রেণীর জনগণ যারা স্বাধীনতার সংগ্রামে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, উৎপীড়িত হয়েছেন, যারা
ঘড়বাড়ী, সম্পত্তি হারা হয়েছেন তাহাদের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আর সঙ্গে সঙ্গে মােবারকবাদ জানাচ্ছি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, তাঁহার সরকার, ভারতীয় জনসাধারণ ও জোয়ান ভাইদেরে, সােভিয়েট রাশিয়াকে, বৃটেন, ফ্রান্স, পােলা আমেরিকার জনগণ ও সারা বিশ্বের জনসাধারণকে যারা আমাদের সংগ্রামকে সাহায্য করেছেন ও সমর্থন জানাচ্ছেন। পাকিস্তানী আদালতে আমার বিচার হয়েছে বিচারের শেষদিনে আমি বলেছি বাঙালী বীরের জাতি—তােমরা আমাকে মারাে কোন ক্ষতি নেই আমি তােমাদের কাছে প্রাণ বাঁচানাের প্রার্থনা করার মতাে ভীরু নই, তবে আমাকে মারার পর আমার লাসটা (মৃতদেহ) বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবে। উপস্থিত অগণিত মানুষ ঘন-ঘন করতালি দিতে দিতে ও চোখের জল ফেলিতে থাকে। শেখ সাহেব বলেন বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, সার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমরা প্রাণের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করব, পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদের ধ্বংস করার ফন্দি যেন না করেন। আজ সারা দুনিয়ার রাষ্ট্রনায়কবৃন্দকে অনুরােধ করছি তারা যেন সত্বরই আমাদের স্বীকৃতি দেন, আমরা যেন রাষ্ট্র সংঘে আসন লাভ করতে পারি। দেশের সকলকে বলেছি আজ থেকে দেশে লুঠতরাজ, চুরি, ডাকাতি না হয়, কোন কর্মচারী যেন ঘুষ খান না, এবং জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলে জাতি ও দেশ গঠনে আত্মনিয়ােগ করুন। আজ আমাদের সৰ্ব্বপ্রথম ও প্রধান কর্তব্য হইবে দেশের মানুষের পেটের ভাত পিঠের কাপড় দেয়া, দরিদ্রতা দূর করা এবং সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়িয়া তােলা। আমাকে ছেড়ে দেওয়ার আগের দিন ভূট্টো আমাকে বলেছিলেন যে দুই দেশের মধ্যে এক বাঁধন দেওয়া চলে কি না—জবাবে আমি বলেছিলাম আমি কোথায় কোন দেশে ও কিভাবে আমি বলতে পারি না এমতাবস্থায় আমার পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব নয়। আজ বাংলাদেশের দাঁড়িয়ে আমি বলছি ভূট্টো সাহেব সুখে থাকো সে বাঁধন টুটে গেছে। অশ্রুবাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন যে, তাঁহার শরীর সুস্থ নহে আর অধিক বলা তাহার পক্ষে সম্ভবপর হইতেছে না। সুস্থ হইলেই পর তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিবেন, মিলবেন ও কাজ করবেন।

সূত্র: আজাদ, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২