You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশের রাজনীতি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের রাজনীতি মধ্যেই কয়েক শত জাতীয় শত্রু খতম করা হয়। পাক সামরিক দস্যুদের একখানি লঞ্চ আক্রমণ করা হয় এবং প্রায় তিরিশজন সামরিক দস্যকে খতম করা হয়, দুজন। পুলিশ সহ দু’ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটি স্পীডবোেট দখল করা হয়…। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতীয় শত্রু’ ছাড়াও জন্মলগ্ন থেকেই শিকদারের দলের। ‘শ্রেণীশত্রু খতমের কাজ অব্যাহত ছিল গ্রামাঞ্চলে অনেক জোতদার-মহাজন, ধনিকবণিক, প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য দলের রাজনীতিক এদের খতমের’ শিকার। হয়। স্থানে স্থানে নিরীহ জনগণও এদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের শিকার হয়। সারাদেশে তারা একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপরও ১৯৭৪ সাল থেকে সমস্যাকীর্ণ বাংলাদেশে হতাশ ও বিপ্লবাকাক্ষী তরুণ সমাজ আকৃষ্ট হয়ে সর্বহারা পাটিকে বিকাশমান করে তােলে। কয়েকটি স্থানে তাদের শক্তিশালী অবস্থান/ঘাটি সৃষ্টি হয়। পুরনাে প্রায় সকল কমিউনিস্টদের তারা সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতক’ বলে চিহ্নিত করে। শিকদারের ‘সন্ত্রাসবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ অনেকেরই পছন্দ নয়। কিন্তু তা মােকাবেলায় সরকারি কার্যক্রম বিশেষ করে রক্ষীবাহিনীর দমনাভিযানও সর্বদা আইনানুগ রীতি মেনে। চলেনি তাই চূড়ান্ত বিচারে মানুষের সহানুভূতি শিকদারের দিকেই প্রকাশ পায়। ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ নীতিও এক্ষেত্রে কার্যকরী হতে দেখা যায়। চুয়াত্তরের শেষার্ধে মুজিব সেনাবাহিনীকে নক্সালদের মূলােৎপাটনের নির্দেশ দেন। কিন্তু মেজর ফারুক এ-নির্দেশ পালনে উৎসাহী না হয়ে বরং এদের কাউকে ধরতে পারলেও ছেড়ে দিয়েই অধিক আনন্দ পেতেন। সিরাজুল আলম খানের ‘আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে ‘১৭ মার্চ ১৯৭৪ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আক্রমনের ঘটনার পর জাসদের যে ‘পার্টি। থিসিস’ উত্থাপিত হয় তাতে ‘রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াশ্রেণীর উচ্ছেদ এবং তার পরিবর্তে সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন করার কথা বলা হয় (নজরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪) এবং সে-ধারাতেই ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ ঘটে।এ দু’টি ঘটনা ও সামগ্রিক আন্দোলন-সংগঠন সম্পর্কে ১৯৭৯ সালের মার্চে ৪৪।

পৃষ্ঠার একটি আত্মসমালােচনা দলিল জাসদ থেকে প্রকাশ করা হয়। এর পূর্বে ১৯৭৮ সালের প্রথমার্ধে মাহবুবুর রব সাদী নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেন ১২৩ পৃষ্ঠার। বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব (আন্ত পার্টি মতাদর্শগত সংগ্রাম বিষয়ক)’ রচনা। তারও আগে ১৯৭৬ সালে সিরাজুল আলম খান লেখেন ‘আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে প্রবন্ধ।জনাব খানের রচনাটি সম্ভবত ১৭ মার্চ ও ৭ নভেম্বরের ব্যর্থ আন্দোলনের পর এ ধরনের প্রথম উদ্যোগ। সে-কারণে আশা করা হয়েছিল, অতীত আন্দোলনের একটি অনুপুঙ্খ মূল্যায়ন এতে স্থান পাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জনাব খান অতীত নিয়ে এক বর্ণও আলােচনা না করে রায় দিয়ে বসেন যে, “আগােছাল, এলােপাতাড়ি, গোঁজামিল, দায়সারা কাজ দিয়ে বিপ্লব হয় না’ (ঐ, পৃষ্ঠা ৭)। শুধু তাই নয়, প্রবন্ধের মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়, রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়শ্রেণীকে উচ্ছেদ নয়, বরং কীভাবে বুর্জোয়াশ্রেণীর সাথে মিলে বা তার অধীনে (প্রথম পর্যায়) মন্ত্রী হয়ে ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা যায়। জাসদের জন্য এ সম্পূর্ণ অভাবিতপূর্ব নতুন ধরনের বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক প্রস্তাব -যা তিনি জেলে বসে উদ্ভাবন করেন।জনাব খান উক্ত প্রবন্ধে তিন ধরনের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরেন। প্রথমটি হল, যখন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ আগ্রাসন বিদ্যমান তখন দরকার হবে এই শক্তি ও তার সহায়তাকারী দেশীয় শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণের ও সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী দল, গােষ্ঠী, শক্তি ও ব্যক্তির মাের্চা। দ্বিতীয়টি হল, যখন সাম্রাজ্যবাদী প্রত্যক্ষ আগ্রাসন অনুপস্থিত কিন্তু পরােক্ষ প্রভাব বর্তমান ও বুর্জোয়ারা।সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে জনাব খান বা জাসদের ব্যাখ্যা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্মত। ব্যাখ্যার অনুরূপ নয়। সাম্রাজ্যবাদ বলতে জনাব খান বুঝেন যে-কোনাে ধরনের বিদেশী প্রভাব’। এ প্রবন্ধে তিনি সাম্রাজ্যবাদ বলতে সাম্রাজ্যবাদ, সংশোধনবাদ ও সম্প্রসারণবাদকেও বুঝিয়েছেন। (পৃষ্ঠা ১০ ও ১৬)ক্ষমতাসীন। তৃতীয়টি হল, যখন হিটলার, মসােলিনী, বাতিস্তা, রেজা শাহ, ফ্রাঙ্কোর মতাে ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষতাসীন তখন প্রয়ােজন তাদের তাদের সহায়তাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সকল বিরােধীদল, সংস্থা, গােষ্ঠী, শক্তি ও ব্যক্তির গণমাের্চা।আমাদের দেশের জন্যে জনাব খান দ্বিতীয় ধরনেরটি প্রযােজ্য মনে করেন এবং এ অবস্থায় কর্তব্য হল, ‘তিনটি পর্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন’ (ঐ, পৃষ্ঠা ৮)।

প্রথম পর্যায়-সর্বহারাশ্রেণীটি দুর্বল অর্থাৎ সংগঠিত নয়, তখন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য শ্রেণীর প্রতিনিধিরা মূলত প্রধান শক্তি। দ্বিতীয় পর্যায়সর্বহারাশ্রেণী প্রথম পর্যায় থেকে অনেকখানি শক্তিশালী ও অন্যান্য শ্রেণীর অংশীদারিত্ব মােটামুটি সমান। তৃতীয় পর্যায়-সর্বহারাশ্রেণী সরকারের মধ্যে বৃহত্তম অংশের নিয়ন্ত্রক, কিন্তু অন্যান্য শ্রেণীও অংশীদার। (ঐ, পৃষ্ঠা ৮)।জনাব খান আরও যােগ করেন যে, ‘মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের এই তিনটি পর্যায়ের মধ্যে কোনাে চীনের প্রাচীর নেই। তবে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের আন্দোলন ও অংশগ্রহণ একটা মৌলিক ও অবশ্যকরণীয় বিষয়। (ঐ, পৃষ্ঠা ৮)।দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ করেই ‘সর্বহারাশ্রেণীর তেজটা পরিহার করে সর্বশ্রেণী সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের আন্দোলনে অংশগ্রহণকে জনাব খান “অবশ্যকরণীয়’ বিবেচনা করছেন। কারণ ইতােমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে যে, (জাতীয়) বুর্জোয়ারও যথেষ্ট সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতা আছে। তাই বুর্জোয়ার সাথে কেবল সগ্রামই নয়, ঐক্যেরও প্রশ্ন আছে। তিনি মনে করেন :ঐক্য ও সংগ্রাম-উভয়ই দ্বন্দ্বের প্রকাশ-এ কথা মনে রেখে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। সর্বহারাশ্রেণী বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনকে বুর্জোয়াদের সহযােগিতায় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সর্বহারার শক্তিভিতকে গড়ে তােলার কাজে লাগাবে। আবার বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যবাদঘেষা নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সর্বহারার শক্তিভিত গড়ে তােলার সপক্ষে আনতে হবে।এই যে প্রতি মুহূর্ত, প্রতিদিনকার ও প্রতিঘটনার সঙ্গে ঐক্য ও সংগ্রামের সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের প্রক্রিয়া তাকে সুকৌশলে পরিচালনা করতে হবে-গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করার জন্য প্রতিনিয়ত দাবি জানিয়ে অথবা গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করে… (ঐ, পৃষ্ঠা ৯)। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থান করে এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে সর্বহারার শক্তিভিত গড়ে তােলার এই যে, কৌশলগত আন্দোলন – এরই নাম বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, এই যে, কর্মসূচি এরই নাম বিপ্লবী গণতান্ত্রিক কর্মসূচি।

বিপ্লবী গণতন্ত্রের এই কৌশলের রূপ ও কাঠামাে হল গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন বা গঠনের জন্য আন্দোলন… (ঐ, পৃষ্ঠা ৯)।প্রস্তাবিত এ সরকার গণতান্ত্রিক, কারণ আরও বেশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ সগ্রাম; এ সরকারটি জাতীয়, কারণ ‘বিদেশী শক্তি ও প্রভাবের বিরুদ্ধে সকল শ্রেণীর সম্মিলিত জাতীয় প্রচেষ্টা এর অন্তর্ভুক্ত’ আর ‘এ সরকারের অর্থনৈতিক কর্মসূচি হল সকল শ্রেণীর কাছে গ্রহণীয় গণমুখী অর্থনীতি (ঐ, পৃষ্ঠা ৭-৮)।জনাব খান আরও জানান, তার প্রস্তাবিত এই দুরূহ আন্দোলনটির সফলতা নির্ভর করে সর্বহারাশ্রেণীর দল কর্তৃক সঠিকভাবে প্রণীত একটি সাম্রাজ্যবাদবিরােধী কর্মসূচির মধ্যে। অতঃপর তিনি সকল শ্রেণীর কাছে গ্রহণযােগ্য’ ৮ দফার ‘অজাতশত্রু’ এক ‘সাধারণ’ কর্মসূচি প্রস্তাব করে বলেন, এই কর্মসূচি সম্পর্কে আপস রক্ষা না হওয়া পর্যন্ত সরকারে অংশগ্রহণের প্রশ্নই আসেনা। আর আপসরফা হলে বুর্জোয়াদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা যায় ও এক্ষেত্রে সর্বহারার দলকে উক্ত সরকারের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়গুলাের দায়িত্ব গ্রহণ করা দরকার’ (এছাড়া আরও গণতন্ত্র ও গণমুখী অর্থনীতি চালুর সহায়তার জন্য শ্রম কল্যাণ, ভূমি প্রশাসন ও সমবায়, শিক্ষা ও পরিকল্পনা দপ্তর গ্রহণের চেষ্টা করা দরকার) এবং এই দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলে, যে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে হবে-তিনটি শিরােনামে ৩০ দফা বিশিষ্ট সেরূপ একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও তিনি তার প্রবন্ধে সংযােজিত করেন (ঐ, পৃষ্ঠা ১১-১৪)।মন্ত্রণালয় ভাগাভাগির এ সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াদের সাথে সরকার গঠনের আশু সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই জনাব খান এ প্রবন্ধ লেখেন। একই সাথে তিনি ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়াদের লক্ষ্য করে একটি ‘অল পাজিটিভ’ সূত্র আবিষ্কার করেন যা হল, সর্বহারার দল একদিকে যেমন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়ার ‘আপসকামিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে ও তার সাম্রাজ্যবাদবিরােধিতাকে অব্যাহত রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চাপ দিবে তেমনি ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসকামিতার বিরুদ্ধে অনুরূপভাবে সমালােচনা ও সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে এবং সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকাকে বহাল রাখার জন্য চাপ দেবে।

অর্থাৎ বুর্জোয়ার উভয় অংশের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী মনােভাবের সুফলতাকে জনগণের স্বার্থে কাজে লাগানাের চেষ্টা করা হবে। ফলে, প্রস্তাবিত গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারে অংশগ্রহণ করলেও ক্ষতাসীন বুর্জোয়ারা সর্বহারাশ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী দলকে ‘কেবল বিরােধিতার পর্যায়ভুক্ত করতে পারবে না, আবার ক্ষমতার বাইরে অবস্থানকারী বুর্জোয়ারা সর্বহারাশ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী দলকে শাসকগােষ্ঠীর দালাল’ বলেও চিহ্নিত করতে পারবে না (ঐ, পৃষ্ঠা ১০-১১)। সুতরাং উভয় কলঙ্ক থেকেই রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা!শুরুতেই উল্লিখিত হয়েছে যে, আলােচ্য প্রবন্ধে জনাব খান রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াশ্রেণীর উচ্ছেদের বিপরীতে বুর্জোয়াশ্রেণীর সাথে মিলে বা অধীনে থেকে (তিন শ্রেণীর) সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। তার ভাষায় যেহেতু বিদেশী প্রভাব (সাম্রাজ্যবাদ) প্রতিটি শ্রেণীরই কোননা-না-কোনােভাবেস্বার্থহানি করে, সে-কারণে সকল শ্রেণীই একটি সাধারণ যােগসূত্র খুঁজে বের করার জন্য সচেষ্ট হয়। যেহেতু কোনাে একক শ্রেণীর স্বার্থ নয়, সেহেতু সকল শ্রেণীর সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। আবার সকল শ্রেণীর সমন্বয়ে গােটা জাতি এ সংগ্রামে নিয়ােজিত-তাই জাতীয় ঐক্য গড়তে হবে (ঐ, পৃষ্ঠা ১০)।সকল শ্রেণীর সমন্বয়ে’ (জাতীয়) ‘ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাবিত এই সংগ্রামের নেতৃত্বের প্রশ্নে জনাব খান মনে করেন যে, কোন্ শ্রেণী কতখানি সার্থকতার সাথে এই সংগ্রামকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম, তার ওপরই নির্ভর করে, কার হবে নেতৃত্ব।’ তার আরও অভিমত হল, তত্ত্বগতভাবে সর্বহারাশ্রেণী ছাড়া অন্য কেউ এর সফল পরিণতিতে পৌছাতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে। বিশেষ করে আমাদের দেশে সর্বহারাশ্রেণী ততখানি সংগঠিত ও সচেতন না বিধায় তাকে ঐক্যফ্রন্ট’ করতে হয় অন্যান্য শ্রেণীর সঙ্গে (ঐ, পৃষ্ঠা ১০)।

ধরা যাক, জনাব খানের নতুন ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় বিপ্লবী গণতান্ত্রিক কর্মসূচি বাস্তাবায়নে জাসদ সম্মত হল। কিন্তু কেউ যদি সুদীর্ঘ চার বছরের ‘যে আন্দোলনে কর্নেল তাহেরসহ হাজার হাজার কর্মী জীবন দিল, অসংখ্য কর্মী ও নেতা আজও কারার অন্তরালে, জীবনধারণের প্রয়ােজনে কোনাে কোনাে কারারুদ্ধ কর্মীর কুলবধূ বেশ্যায় পরিণত হয়েছে সে-আন্দোলনের কী কী ভুল ছিল? ভুলের কারণ কী? ভুল থেকে কী শিক্ষা গ্রহণ করা হল তা-জিজ্ঞাসা করে তবে এর কী উত্তর হবে? কিংবা বর্তমান’ (১৯৭৬) ক্ষমতাসীন ‘সেনাবাস নির্ভর সরকারের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে, তবে নির্বাচিত মুজিব সরকারকে উৎখাতের সংগ্রাম কেন করা হয়েছিল?এ প্রশ্নের আগাম উত্তর হিসেবে তিনি (ব্র্যাকেটের মধ্যে ) বলেন ‘মনে রাখতে হবে যে, যদি ক্ষমতাসীন বুর্জোয়ারা সম্পূর্ণভাবে সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসে পরিণত হয় এবং কোনাে গণতন্ত্রাভিমুখী কার্যকলাপ চালু রাখতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে সে বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করতে হবে (ঐ, পৃষ্ঠা ১০)।

কিন্তু ইতিহাস জনাব খানের মুজিব সরকারের চরিত্র বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি মুজিবের চেয়ে অধিক সাম্রাজ্যবাদবিরােধী কোনাে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। (এমনকি, ১৯৯৬-২০০০ কাল পর্বের শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারও নয়)। কর্নেল তাহেরও বুঝেছিলেন যে, “জাতির পিতাকে হত্যা করার ব্যাপারে কোনাে বিদেশী শক্তি (জনাব খানের ভাষায় সাম্রাজ্যবাদ) জড়িত।যাহােক, জনাব খানের এই নয়া তত্ত্বের কল্যাণেই সম্ভবত: জাসদ ক্রমে তার ‘বিপ্লবীপনা বাদ দিয়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলে রূপান্তরিত হয়ে সংসদীয়২| মাও সেতুং ১৯৩৪ সালে লেখা নয়া গণতন্ত্র পুস্তিকায় বলেছেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবসর্বহারার নেতৃত্ব ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। (আত্মসমালােচনা দলিল ‘৭৯, পৃষ্ঠা ১৩-১৪)। মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৫-৯৬গণতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তার ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্ব আজও টিকিয়ে রেখেছে এবং দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব সামরিক-স্বৈরাচার এরশাদের আমলে ‘শুয়ারের খােয়ারে’ গৃহপালিত বিরােধীদলীয় নেতা ও শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের মন্ত্রী (পশু/নৌ) হয়েছিলেন। আর শাজাহান সিরাজ হয়েছেন (এবং ছিলেন) বেগম খালেদার মৌলবাদী জোট সরকারের মন্ত্রী (পরিবেশ/নৌ)।জনাব খান এখন বছরের অধিকাংশ সময় বিদেশী প্রভাবের মূল কেন্দ্র স্বপ্নের অ্যামেরিকায় প্রবাসে থাকেন এবং বিপ্লব ভুলে (সে সমাজতান্ত্রিকই হােক আর জাতীয় গণতান্ত্রিকই’ হােক) মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর গবেষণা করে ও গ্রন্থ লিখে সময় কাটান। তিনি বছরের যে সামান্য সময় বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন, তার অধিকাংশই ব্যয় করেন পাঁচতারা হােটেলে (সােনার গাঁ/শেরাটনে) রব-সিরাজ বা অন্যান্য সাবেক ‘বিপ্লবী’ পরিবেষ্টিত হয়ে আড্ডা দিয়ে। লক্ষণীয়, এত কাল পরও ‘বিপ্লব স্পন্দিত হয়ে রাখা শত্রু ও দীঘল কেশ শােভিত হয়ে মার্ক্সের অবয়ব ধারণ করে এবং অকৃতদার থেকে তিনি বিপ্লবী ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, যাকে আজকাল ভগবান রজনিশের মতাে দেখায়। সুতরাং আর কী চাই?

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান