বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশংকা
শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সংকটাবস্থার উদ্ভব
বিগত নয় মাস বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এবং বহুলােক ভারতে চলে আসার দরুন কৃষিকার্যের বিশেষ ক্ষতি সাধিত হয়। ফলে ধানের উৎপাদন অত্যন্ত কম হয় যা কিছু মজুত ছিল তাও পাকসেনারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়ে গেছে। এই অবস্থায় শরণার্থীদের ঘরে ফেরার চাপে বিশেষ করে সিলেট জেলায় খাদ্যাভাব অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। শরণার্থী যারা ফিরে যাচ্ছেন তাদেরকে মাত্র দুইদিনের রেশন দিয়ে বিদায় করা হচ্ছে। মেঘালয় থেকে যে সকল শরণার্থী যাচ্ছেন তাদের বেশীরভাগকে কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকারের হাতে খাদ্যবস্তু না থাকার জন্য এতদিন তারা শরণার্থীদের ৩ সের চাউল অথবা সম পরিমাণ গম দিয়ে বিদায় করছিলেন। বর্তমানে তাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ মহকুমার মেঘালয়াগত শরণার্থীদের মধ্যে খাদ্যাভাবে ৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে বলেও সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটী কেন্দ্রে শরণার্থীদের ছেড়ে দিয়ে আসা হচ্ছে। সেই সকল কেন্দ্রের বেশীর ভাগ স্থলেই আশ্রয় উপযােগী গৃহ না থাকায় শীতের রাতে শরণার্থীরা বিশেষ দুর্গতির সম্মুখীন হচ্ছেন। উপরন্তু শরণার্থীদের গৃহে পৌঁছানের জন্য বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে ট্রাক বাস না থাকায় সরকার বিশেষ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন।
যে সকল শরণার্থীরা গ্রামদেশে ফিরে যাচ্ছেন তাদের বেশীরভাগের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ফলে তারা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। নতুনভাবে তাদের বাড়ীঘর তৈরী করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ না থাকার দরুন ভস্মীভূত অথবা সম্পূর্ণ বিনষ্ট গৃহাদির জন্য পরিবার পিছু মাত্র ১০০ টাকা। বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যান্য সাহায্য বাবদ পরিবার পিছু আরাে ১৫০ টাকার মত টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে। কিন্তু এই সামান্য পরিমাণ অর্থ দিয়ে কোন প্রকারে গৃহনির্মাণ সম্পূর্ণ অবাস্তব। উপরন্তু এই বাড়ীঘর নির্মাণের জন্য বাঁশ, বেত, ছন প্রভৃতি কাঁচামালও সম্পূর্ণ দুষ্প্রাপ্য।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাহির থেকে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য না পেলে অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে উঠবে এতে সন্দেহ নেই।
গত ২২শে তারিখ ভারত সরকারের রিলিফ বিভাগের এডিঃ সেক্রেটারী কর্ণেল লুথরা সরেজমিন অবস্থা পৰ্যবেক্ষণ করার জন্য সিলেট যান। ডিষ্ট্রিক্ট এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান দেওয়ান ফরিদগাজী, এম সি এ, মসুদ চৌধুরী এম সি-এ, এ এইচ সাদাত খান এবং করিমগঞ্জ বাংলাদেশ ত্রাণ কমিটীর অন্যতম সম্পাদক এবং দৃষ্টিপাত সম্পাদক শ্রীভূপেন্দ্রকুমার সিংহ (মণি সিং) ও করিমগঞ্জের বিশিষ্ট সমাজসেবী শ্রীহরমােহন রায় উদ্ভূত সমস্যা নিয়া কর্ণেল লুথরার সংগে বিস্তারিত আলােচনা করেন। কর্ণেল লুথরা কয়েকটী ট্রাক, শরণার্থীদের জন্য রেশন, ঔষধ, কাপড় চোপড়, গৃহ নির্মাণ উপযােগী তাবু, পলিথিন প্রভৃতি অতি অচিরেই জেলা সদর সিলেটে পাঠিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন।
ফুড কপোরেশন অব ইণ্ডিয়া সিলেট জেলায় ৮৫ হাজার মন চাউল, তৈল, মসলা প্রভৃতি সহ আরও ৫০০ টন খাদ্যবস্তু পাঠাবেন বলে স্থীর হয়েছে। এখন পর্যন্ত অতি সামান্য পরিমাণ বস্তু সেখানে পৌঁছেছে। কিন্তু চাউল এক মণও না পৌঁছায় সংকট অবস্থার দেখা দিয়েছে।
ইণ্ডিয়ান অয়েল কোম্পানী কেরােসিন, পেট্রল, ডিজের প্রভৃতি দেয়ার ফলে এই সকল জিনিষের অভাব দূরীভূত হয়েছে।
অন্যান্য খাদ্যবস্তু মােটামুটিভাবে পাওয়া যাচ্ছে।
রাজনৈতিক কর্মীরা গ্রাম, ইউনিয়ন ও জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করে শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করার চেষ্টা নিচ্ছেন। কিন্তু অর্থ ও জিনিষপত্রের অভাবে তারা সুবিধা করে উঠতে পাচ্ছেন না।
সূত্র: দৃষ্টিপাত, ২৬ জানুয়ারী ১৯৭২