শরণার্থীদের দুঃখ শিবির মাইলাম ও বালাট
‘বাচতে আইয়া মইলাম’ মাইলাম শরণার্থী শিবিরের শরণার্থীদের মুখে মুখে একই কথা শােনা যাচ্ছে। মেঘালয়ে অবস্থিত মাইলাম ও বালাট শরণার্থী শিবির দুইটী বর্তমানে মৃত্যু শিবিরে পরিণত হয়েছে। দুদিন আগে হােক দুদিন পরে তােক এই দূর্গতি অনিবার্য ছিল। মাত্র ২৫ হাজার শরণার্থীর জন্য মাইলাম ক্যাম্পটীকে তৈরি করা হয়। কিন্তু এতে প্রায় জোর করেই ৪০ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া হয়। এতেই শরণার্থীদের দূদুর্দিশা চরমে পৌছে। এই চরম অবস্থার মধ্যেই আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত দেড় লক্ষেরও অধিক নতুন শরণার্থী এই শিবিরে এসে উপস্থিত হয় এবং আজ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ২০০০ শরণার্থীর আগমন অব্যাহত আছে।
খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় ও সিলেট সীমান্তের দুর্গম স্থানে অবস্থিত এই দুইটা শিবিরে ইচ্ছা থাকলেও সরকারের পক্ষে রাতারাতি শিবির নির্মাণ সম্ভব হয়ে উঠছে না। শিলং থেকে ২০ মাইল দূর মাইসিনরাম থেকে একটী ছােট কাঁচা রাস্তা এই সকল শিবির পর্যন্ত চলে গেছে। এই সকল শিবিরে সবরকমের সাহায্য বস্তু ৬০ মাইল দূরবর্তী শিলং শহর থেকেই পাঠাতে হয়। কিন্তু বর্ষায় মাইসিনরাম থেকে এই কাঁচা রাস্তাটিতে ভারী গাড়ী চলা দুরূহ বোব্যা]পার। এতে সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হওয়ার যােগাড়। এ ছাড়া মেঘালয় সরকারের যানবাহনের অসুবিধা আছেই। জানা যায় প্রথম থেকেই মেঘালয় সরকার ১১০ টা ট্রাকের জন্য রিকুইজিশন দেন। কিন্তু লাল ফিতার তারে সেটা কার্যকরী করা সম্ভব হয় নি। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪০ টী গাড়ীর জন্য কর্তৃপক্ষ জোর দিলেন, ততক্ষণে বর্ষায় রাস্তা অচল হয়ে উঠেছে। মাত্র গত ২৬ শে সেপ্টেম্বর হতে বিমান থেকে খাদ্যবস্তু নিক্ষেপন [7] শুরু হয়েছে। তাও রােজ মাত্র ৬০ টনের অতিরিক্ত নিক্ষেপ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। অথচ মাইলাম ও বালাট শিবিরে রােজকার চাহিদা হচ্ছে কম করেও ১২০০ কুইন্টোল। জীপে করে কিছু কিছু বহন করা হচ্ছে বটে কিন্তু তাও … কুইন্টোলের বেশি একটী জীপে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাস্তাটা ঠিক করার জন্যও এখনাে কোন ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে না।
রােজই শরণার্থীরা আসছে কিন্তু পরিমিত শিবির তৈরি হচ্ছে না। এই সুযােগে জমির মালিকরা কিছু সংখ্যক দুষ্ট প্রকৃতির শরণার্থী দালালের সাহায্যে হাত হিসেবে অস্বাভাবীক মূল্যে বাসস্থানের জন্য জমির মৌখিক বন্দোবস্ত দিতে সুরু করেছে। এই সকল স্থানে শিবির নির্মাণেরও স্থানাভাব দেখা দিয়েছে। সুতরাং অবিলম্বে এই সকল শরণার্থীকে স্থানান্তরীত করা একান্ত প্রয়ােজন হয়ে উঠেছে। স্থানীয় পার্বত্যবাসীরা প্রকাশ্যে খুব বিরুদ্ধাচরণ না করলেও সক্রিয়ভাবে কোন সহযােগীতায় এগিয়ে আসছে না।
রােজই কলেরা এবং পেটের ব্যানােতে ৭০ থেকে ৮০ জন লোেক প্রাণ হারাচ্ছে। বাঙ্গাললারের ৮ জন ডাক্তারসহ মাত্র ১২ জন ডাক্তার, ১০ জন কম্পাউণ্ডার ও ৮ জন নার্স কাজ করে যাচ্ছেন। প্রয়ােজনের তুলনায় এটা অতি নগণ্য। প্রতি হাজার জন শরণার্থীর জন্য একজন করে মেথর নিয়ােগ করা হয়েছে।
বালাট ক্যাম্পে তিন কিলােমিটার দূরে একটী পাহাড়ী ঝরনা থেকে পাইপ দিয়ে পানীয় জল আনা হয়। সে ঝরনাটীও শুকিয়ে যাবে। মাইলাম শিবিরে মাত্র ১৪টী টিউবওয়েল দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ১২টীই নষ্ট। যে ২টী এখনও চালু আছে তাও নষ্ট হওয়ার পথে।
এছাড়া কন্ট্রাকটর, সরকারী কর্মচারী এবং কিছু সংখ্যক শরণার্থীর দুষ্কৃতকারিতার জন্যও শরণার্থীদের দূর্দশা চরমে উঠেছে। সেলাইন এবং অন্যান্য ঔষধ পত্রাদি কালােবাজারে বিক্রির অপরাধে একজন শরণার্থী ডাক্তারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক বােতল সেলাইন ৪০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। কিছু সংখ্যক শরণার্থীদের কাছে সেলাইন ও ঔষধপত্রাদি মজুত রাখা অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এই সকল শিবিরের উদ্বাস্তুদেরকে কাছাড় এবং অন্যান্য স্থানে অবিলম্বে স্থানান্তরীত করার জন্য করিমগঞ্জ বাংলাদেশ ত্রাণ কমিটীর তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিকট দাবী জানানাে হয়েছে। এই স্থানান্তরীত করণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে মােটর গাড়ীর ব্যবস্থা করা, যথেষ্ট পরিমাণে ডাক্তার ও ঔষধপত্রাদির ব্যবস্থা করার জন্যও এই দাবীতে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র: দৃষ্টিপাত, ১৩ অক্টোবর ১৯৭১