সরকার চেয়ে দেখুন
প্রান্তিক শহর করিমগঞ্জের জনজীবন আজ কম্পমান। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অঘটন আজ করিমগঞ্জ শহর তথা মহকুমার সর্বত্র একটা মরণচাপ সৃষ্টি করেছে।
অভূতপূৰ্ব্ব শরণার্থীর আগমনে মহকুমায় তিলধারণের স্থান নেই। মহকুমার স্কুল কলেজগুলি মুরগীর খাঁচার মত দু’মাস প্রায় শরণার্থীদের ভীড়ে গিজগিজ কচ্ছে। ৩১শে মে স্কুল কলেজগুলি খােলার কথা অথচ এই শরণার্থীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শহরের জনসংখ্যা থেকে শরণার্থীদের জনসংখ্যা অধিক হয়ে যাওয়ার ফলে স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে, অর্থনীতির দিক দিয়ে, দৈনন্দিন জীবন যাত্রার দিক দিয়ে একটা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। | মহকুমা অফিসার ও অন্যান্য হাকিম থেকে সুরু করে এখানকার ছােট বড় অফিসার বা কর্মচারী সকলেই দিবারাত্রে প্রশংসনীয় উদ্যমে শরণার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এতে করে মহকুমার দৈনন্দিন কাজ কর্ম সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়ে পড়েছে।
ওপার বাংলার জঙ্গী অত্যাচার এপারের জনমানসকে অভিভূত করে তােতুলেছে। তাই হাজার কষ্ট সত্বেও সবাই মুখ বুজে তাই সহ্য করে চলেছে। সবাই যে হেতু সহ্য করে যাচ্ছে সেই কারণেই তাদের উপর বােঝা চাপিয়ে দেয়া হবে সেটাত কথা নয়।
বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা শুধু করিমগঞ্জের সমস্যা নয়, কাছাড়ের সমস্যা নয়—এ সমস্যা সমগ্র প্রদেশের, সমগ্র ভারতের সমগ্র বিশ্বের সমস্যা। তাই এ সমস্যাকে নির্দিষ্ট স্থানের উপর চাপিয়ে দিলে চলবে
সমানভাবে সবাইকে তার অংশীদার হতে হবে। তাই আমাদের এ ভার লাঘব করতে আমরা কর্তৃপক্ষ তথা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
করিমগঞ্জের সমস্যা আজ শরণার্থী সমস্যাই নয়, আরাে বহুবিধ নয়া নয়া সমস্যা শহরবাসী তথা মহকুমাবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। নদীর ওপারে পররাষ্ট্র ও জকিগঞ্জে পাকসেনারা করিমগঞ্জ শহরের দিকে মুখ করে ৮টী কামান দাগিয়ে বসে শহরবাসীকে আতঙ্কিত করে তােলার চেষ্টা নিচ্ছে। তা ছাড়া তাদের রাষ্ট্রাভ্যন্তরে গুলির আওয়াজ, নিরীহ জনসাধারণের মৃত্যুর বার্তা, অগ্নিকাণ্ড লুঠতরাজ, পাশবিক অত্যাচার এপারের জনমনকে বিচলিত করে তুলেছে।
শুধু তাই নয় সেদিন সুতারকান্দিতে তিন কোম্পানী পাকসেনা ভারতরাষ্ট্রের এক কিলােমিটার স্থান দখল করে যে তাণ্ডব করে গেল তাতে কয়েকজন নিরীহ ভারতীয় নাগরিককে প্রাণ দিতে হল। সেজন্য দায়ী কে সেটাই আজকের দিনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে পাকিস্তানে অতি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত পদাতিক বাহিনী আজ মহড়ায় নেমেছে, যেখানে তারা বার বার ভারতসীমা অতিক্রম করে ভারতীয় নাগরিকদের হত্যা করে যাচ্ছে সেখানে ১৮/২০ জন বর্ডার সিকিউরিটী ফোর্সকে আদ্যিকালের গাদা বন্দুক দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা পরিহাসবৈত নয়। সুতারকান্দির ঘটনা একক ঘটনা নয়। এই সকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণ সরকারের উপর আস্থা হারাতে বসেছে। বাড়ীঘর ছেড়ে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলি থেকে দলে দলে লােক শহরের দিকে আসতে শুরু করেছে।
অথচ সরকারের এই নীতির ফলে শহরবাসীও আজ আতঙ্কগ্রস্থ। নিরাপত্তা বিহীন আশংকায় শহরের ব্যবসায়ী তথা নাগরিকেরা শহর ছেড়ে যাওয়ার জন্য সলা পরামর্শ সুরু করেছেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে এটা অত্যন্ত লজ্জার কথা। | পররাষ্ট্র আক্রমণের কোন সুপারীরিশ আমরা করি না। তবে নিজের রাষ্ট্রের এবং নাগরিকদের ধন-মনপ্রাণ রক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের। এ কর্তব্য পালনে যদি কোন প্রকারের বিচ্যুতি ঘটে তা হলে সরকার চালনার অধিকার তাদের থাকতে পারে না। উপরন্তু যথেষ্ট শক্তি থাকা সত্ত্বেও অকারণে নীরব দর্শকের মত আমরা প্রাণ হারাব সেটা কখনই হতে পারে না।
সূত্র: দৃষ্টিপাত, ২৬ মে ১৯৭১