পাকিস্তান ও বাংলাদেশ
পাকিস্তান এই সার্বভৌম রাষ্ট্র হইতে পূর্বপাকিস্তান বাংলাদেশ নাম লইয়া হয়ত অদূর ভবিষ্যতে পৃথক হইয়া যাইবে। ইহাতে নূতনত্ব তেমন কিছু নাই। কারণ ধর্ম দ্বারা জাতীয়তা বা রাষ্ট্র হয় না, আরব রাষ্ট্রগুলিই তাহার প্রমাণ।
মরক্কো, টিউনিসিয়া, আলজিরিয়া, মিশর, সৌদী আরব, সিরিয়া এই সকল রাষ্ট্রের জনগণের মাতৃভাষা আরবী হইলেও এবং ধর্ম ইসলাম হওয়া সত্বেও মরক্কো হইতে এডেন পর্যন্ত আরব জগতে ২৩টি রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিয়াছে। আবার মুসলিম শাসিত ও মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া বৃহত্তম রাষ্ট্র, উহার জনসংখ্যা ১২ কোটির মত। এই হিসাবে পাকিস্তান বাংলাদেশ নাম দিয়া পৃথক হইলেও পশ্চিম পাকিস্তানের স্থান হয় ২য়।
সৌদী আরব, মিশর, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরান, ইরাক এই সকল রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩ কোটির নীচে। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তান (পাকিস্তান) পৃথিবীর ২য় মুসলিম রাষ্ট্র। অনেকেই অদূরদর্শী ভাবে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ পৃথক হইয়া গেলে পাকিস্তান ভাঙ্গিয়া যাইবে। ইহা আদৌ সত্য এবং যুক্তিসঙ্গত কথা নহে। | পাকিস্তান, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও উত্তর পশ্চিম সিসীমান্ত প্রদেশ লইয়া, সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে চলিতে পারে।
৪১ টি ছােট বড় মুসলিম রাষ্ট্রের ইতিহাস, পরিস্থিতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতার ইতিহাস এগুলির কথা গভীরভাবে তলাইলে ইহা প্রতিপন্ন হয় ধর্মের বাঁধনের দ্বারা ঐ সকল রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয় নাই ভাত, মাত [ভাষা] ও জাত এসবের বিচারে অর্থাৎ খাদ্য ভাষা এবং সংস্কৃতির ভিত্তিতেই ঐ সকল রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে।
যাহারা দেশবিভাগের গােড়ার কথা জানেন তাঁহারা যদি সুস্থ মনে তলাইয়া বিচার করেন তাহা হইলে দেখিতে ও বুঝিতে পারিবেন ১৫ বৎসর পূর্বে মন্ত্রী মিশন ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ফরমুলা বা পরিকল্পনা আজ বাস্তবরূপ লইতেছে, যাহা লইতে বাধ্য।
মৌলানা আজাদ পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ লইয়া “এ” গ্রুপ (পরটা-স্থান) মধ্য ভারত লইয়া “বি” গ্রুপ (আটা স্থান) এবং বাংলাদেশ ও আসাম লইয়া সি গ্রুপ (ভাত স্থান) গঠন করতঃ ভারতীয় ফেডারেশন গড়ার পরিকল্পনা রচনা করিয়াছিলেন। যাহা কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও অন্যান্য দল কর্তৃক স্বীকৃত হইয়াছিল। পরিশেষে ভারতের কোন মহান নেতার বােম্বাই-বক্তৃতায় ও আসামের গােপীনাথ বড়দলইর কাতর আবেদনে তাহা বানচাল হইয়া যায়।
আজ আসামের কথা বাদ দিলেও পূর্ব বাংলার ও পশ্চিম বাংলার ভাত, মাত ও জাতের বিচারে বাঙালীত্ব বা বাঙ্গালা ভাষা, খাদ্য ও সংস্কৃতি পাঠানী সংস্কৃতি ও পাঠানী ভাষার …. একীভূত থাকিতে পারে না। তাই পূর্ববাংলা ১২ বৎসর পূর্বে ভাষার ব্যাপারে পাকিস্তানের ভাষা বেষ্টনিকে আঘাত দিয়া বাংলা ভাষাকেই মাতৃভাষায় স্বীকৃতি আদায় করিয়া লয় শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ শত শত বাঙালী যুবকের সংগ্রামে এবং দ্বাদশ শহীদের আত্মদানে। সংস্কৃতির দিক দিয়া ও পূর্ববাংলাবাসীরা পাঠানী সংস্কৃতিতে মাথা ও কৃষ্টি নত করে নাই।
তারপর অর্থনীতি। গত ২৪ বৎসরে পূর্ব বাংলা কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী কর্তৃক আর্থিক দরিদ্রতাগ্রস্ত হইয়াছে তাহা না বলাই ভাল। চাকুরি, নকরি, উন্নয়ন এ সকল ব্যাপারে, পূর্ববাংলার উপর সীমাহীন অবিচার, অনাচার সাধিত হইয়াছে।
দুই যুগের ব্যথা, দুই যুগের বঞ্চনা; দুই যুগের অবহেলা আর উপেক্ষার ফলে পূর্ববাংলার বাঙালী মুসলমানেরাই প্রথম বিদ্রোহ ঘােষণা করে গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে। যাহার ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের দল পূর্ববাংলার ভাগ্য নির্ধারণের পরিপূর্ণ অধিকার লাভ করে। তাহারা যােষণা করে লেবেলে পাকিস্তান ও শরিয়ত আটিয়া দিয়া অন্তঃসারহীন বুভুক্ষু, বেকার উলঙ্গ পূর্ববাংলাবাসীদেরে মুসলিম [জি]জগিরে আর সম্মােহীত করা চলিবে না।।
যাহার পরিণতি আজিকার পূর্ববাংলার গণ-বিক্ষোভ, গণ-বিদ্রোহ ও মানুষের মত বাঁচার সংগ্রাম।
আমরা জানি, ইতিহাসের ছাত্র হিসাবেই জানি; এত প্রাণ, এত রক্তদান, এত আত্মদান এত মা বােনশিশুর ক্রন্দন, ফরিয়াদ ব্যর্থ হয় না, হইতে পারে না। মজলুমের হাহাকারে করুণ চিৎকারে আল্লার আরশ কাঁপিতেছে।
শীঘ্র হউক, বিলম্বে হউক আল্লাহ ন্যায়-দণ্ড লইয়া জালিমদের জালিমী হাত ভাঙ্গিয়া দিবেন।
পূৰ্ব্ববাংলার শুশান বা কবরগার পাশ দিয়াই সুবিচারের ফিরিস্তা বিচারের বাণী, বিচারের পরিণতি ও বাচাইবার ডালি লইয়াই নামিয়া আসিবেন ইহা কল্পনার কথা নহে—বাস্তবের আলােক বর্তিকা।
বাংলাদেশ আমাদের পরদেশ হইলেও প্রতিবেশী ভাইদের দেশ। আমরা আমাদের দেশে যেমন বাচিতে, বাড়িতে চাই তেমনি তাঁহারা বাঁচুক, বাড়ক তাহারা সুদিনের রাঙ্গা প্রভাতে হাসু হাসু হউক। ধ্বংসের মধ্য হইতেই তাহাদের নবজন্ম হউক।
অন্যভভাজী পূর্ববাংলাবাসীদের, বাংলা ভাষাভাষীদের বাংলাদেশ বাস্তবায়িত ও আত্মনিয়ন্ত্রিত হউক এবং পরাটাভােজী পাঠান-ভাইরা হিংসা দ্বেষ, শােষণ পেষণ ভুলিয়া নূতন দৃষ্টিভঙ্গীতে তাহাদের সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করুক ইহা আমরা কামনা করি। আমরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের যেমন পরিপন্থী হওয়া অন্যায় মনে করি, তেমনি পূর্ববাংলার জনগণের মহান বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানান ন্যায় মনে করি। আমাদের প্রতিবেশীর আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীর সাফল্য কামনা করি।
সূত্র: আজাদ, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১