You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.09 | বিপন্ন মানবতা | যুগশক্তি - সংগ্রামের নোটবুক

বিপন্ন মানবতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ তৃতীয় সপ্তাহে পদার্পণ করিল। ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী এবং পদাতিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণ চালাইয়া ছয় লক্ষধিক বাঙালীকে নিহত করিয়াছে। নিহতদের মধ্যে নারী এবং শিশুর সংখ্যাই অধিক। কোন বিদেশী দখলধারী সৈন্যবাহিনীও বিজিত দেশের অসামরিক অধিবাসীদের প্রতি যেটুকু করুণা প্রদর্শন থাকে, পাকিস্তানী ঐক্যের ধুয়াধারী বৰ্বর পাঞ্জাবী সামরিক বাহিনী তাহাও দেখায় নাই। এই ছয়লক্ষ রক্তাক্ত শবের শ্মশানে দাঁড়াইয়া পাকিস্তান রেডিও তারস্বরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলিয়া প্রচার করিতেছে এবং মুক্তিফৌজের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে ভারতীয়দের চক্রান্ত বলিয়া অভিহিত করিতেছে।।
মানবতার ইতিহাসে সবচাইতে কলঙ্কপূর্ণ নরমেধ যজ্ঞের আসামী হইয়াও ইয়াহিয়া খান এবং তাহার বৰ্বর সরকার যে এখন পর্যন্ত শয়তানী চালাইয়া যাইতে সক্ষম রহিয়াছে, তাহার জন্য বিশ্বের শক্তিমান রাষ্ট্রসমূহের অক্ষমতাই দায়ী। বাংলাদেশের এই বর্বর অভিযান সুরু হইতেই ভারত সরকার বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের নিকট আবেদন জানাইয়া এই মানবতাবিরােধী হত্যাকাণ্ড রােধে সচেষ্ট হইতে বলিয়াছেন। ‘ রাশিয়া ব্যতীত অন্য কোন বৃহৎ শক্তিই তাহাতে যথাযথ কর্ণপাত করে নাই। আমেরিকা এবং গ্রেট বৃটেন অত্যন্ত মােলায়েম ভাষায় এই ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াই কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছেন। বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের একমাত্র বন্ধু বলিয়া যাহারা নিত্য আস্ফালন করিয়া থাকেন, সেই কমুনিষ্ট চীন আবার ভণ্ডামির মুখােসটুকুও খুলিয়া ফেলিয়া পাকিস্তানকে সরাসরি সমর্থন দিয়াছে।।
সৰ্ব্বাপেক্ষা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। ভারতের আবেদনের জবাবে সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট সরাসরি আন্তর্জাতিক রেডক্রশের সঙ্গে যােগাযােগ করিতে বলিয়াছেন। অথচ উত্তর ভিয়েৎনামের আমেরিকান বন্দীদের মুক্তির জন্য আমেরিকার আবেদনে কিন্তু তিনি নিজেই আন্তর্জাতিক রেডক্রশের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের দায়িত্বটা পালন করিয়াছিলেন। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি যে মানবিকতার দাবীর মােকাবিলা করিতে সক্ষম নয়, ইহার এত বড় প্রমাণ ইতিপূর্বে পাওয়া যায় নাই। বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনৈতিক চালবাজির চরিতার্থতা সাধনই যদি এই সংস্থাটির একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, এবং বৃহৎ শক্তিগগাষ্ঠীর সহিত সম্পর্ক রহিত বিপন্ন নিরপরাধ সাড়ে সাত কোটি মানুষ যদি একেবারে নিশ্চিহ্ন হইবার মুখে পড়িয়াও।

রাষ্ট্রসঙ্রে কোনরূপ সমর্থন না পায়, তবে ইহার অস্তিত্বের কোনও সার্থকতা সাধারণ মানুষ খুঁজিয়া পাইবে না। আজকের বিশ্ব রাজনীতির পাশা খেলায় মানবতার দাবী যে একটি মুখের বলি মাত্র, বৃহৎ শক্তিগােষ্ঠীর স্বার্থসাধনের জন্য তাহার সংজ্ঞা এবং প্রয়ােগ যে পরিবর্তন সাপেক্ষ, নিজেদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষকে তাহা উপলব্ধি করিতে হইতেছে। কিন্তু বিশ্বে চিন্তাশীল মানুষ সকলেই রাজনীতির দাস নন, এবং প্রতিনিয়তই এই পাশবিক ঘটনাকে তাহারা সােচ্চার ধিক্কার জানাইতেছেন। কূটনৈতিক মহল যতই বাকসংযম অবলম্বন করুন না কেন, নিরপেক্ষ সাধারণ মানুষ মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত এই জঘন্য অপরাধের মােকাবিলায় রুখিয়া দাঁড়াইতে বাংলাদেশের অধিবাসীদের নৈতিক বল যােগাইতেছেন। সেই জন্যই এতবড় শক্তিধর একটি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে প্রায় নিরস্ত্র মুক্তিবাহিনী বীরত্বের সঙ্গে বুঝিয়া একটির পর একটি জয়মাল্য অর্জন করিতেছেন। আজ হউক কাল হউক, এই যুদ্ধের ফয়সালা মুক্তিফৌজের অনুকূলেই হইবে- এই সত্য কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না। কিন্তু যাহারা রাজনীতির আবর্তে পড়িয়া বিপন্ন মানবতার এই আহ্বানে যথা সময়ে সাড়া দিতে পারিলেন না, ইতিহাসের দরবারে তাহারা চিরদিনই অপরাধী থাকিয়া যাইবেন।

সূত্র: যুগশক্তি, ৯ এপ্রিল ১৯৭১