You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.03 | বাংলাদেশ ও আমরা | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ ও আমরা

ছয় মাসের অধিক হইল পাকিস্তানের জঙ্গীশাসকচক্ৰ পূৰ্ব্ববঙ্গে বা বাংলাদেশে বেপরােয়া, অত্যাচার, নরহত্যা, জুলুম পাশবিকতা চালাইয়া যাইতেছে। বাংলাদেশবাসী মুক্তিপাগল মানুষ ও তাহাদের সম্মান, সংস্কৃতি ও দেশকে পাঠানী শােষকদের কবলমুক্ত করার জন্য মরণপনণি] চেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে; তাহারা সংকল্প করিয়াছে পাঠানদেরে বাংলাদেশে আর অত্যাচার অনাচার, শােষণ করিতে করিতে দেওয়া হইবেনা; বাংলাদেশের ভাগ্য বাংলাদেশের জনগণই নির্ণয় করিবে। গত ডিসেম্বর মাসেই বাংলাদেশবাসীরা প্রমাণ করিয়াছে বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ন্তা বাঙালীরাই হইবে, যাহারা পাঠানদের তল্পীবাহক বা তাবেদার নহে।
পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পরিষদে পূর্ববাংলার ১৫৩ টি আসনের মধ্যে ১৫১ টি এবং প্রাদেশিক আইন সভায় মােট ২৭৯ টি আসনের মধ্যে ২৬৮ টি দখল করিয়া জনগণের দল বা আওয়ামীলীগ পার্টি প্রমানণ] করিয়াছে পূব্ববাংলার ভাগ্য, পূর্ববাংলার সুখ সম্পদ সব কিছুই তাহাদের নিজস্ব প্রতিনিধিরা নিয়ন্ত্রণ করিবেন। | ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশের এহেন জাগরণ এবং একতার শক্তির প্রাবল্য দেখিয়া বেসামাল হইয়া গত মার্চ মাসের ২৫ তারিখ হইতে যাহা করিয়া যাইতেছে তাহাতে বিশ্ববাসী বিস্ময় বিমূঢ়। খান সেনারা যে সকল অপকৰ্ম্ম করিয়াছে, যে সকল অমানুষিক অপকৰ্ম্ম করিয়াছে, যে সকল অমানুষিক কাজকর্ম করিয়া যাইতেছে তাহা স্তব্ধ করার দায়িত্ব লইয়াছে বাংলাদেশের যুবসমাজ। পাঠানরা তাহাদের পাপাচার, পাশবিক ক্রিয়াকলাপ এসব চাপ দিবার জন্য মুখে ইসলামের দোহাই দিয়া বিশ্বের মুসলীম রাষ্ট্রগুলির ও বিশ্ববাসী মুসলমানদের সহানুভূতি কুড়াইবার ফন্দিতে লাগিয়াছে। তাহারা রেডিও মারফত এমন সব প্রচার কাৰ্য্য করিতেছে যেগুলির মূলে যুক্তি বা সত্যতা নাই।।
তাহাদেরই ভাড়াটিয়া একদল মৌলবী “জমাতে ইসলামী লেবেল লাগাইয়া প্রচার করিতেছেন একটা মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংস করার জন্য দুশমনরা চেষ্টা করিতেছে এবং সঙ্গে ও ইহা ও প্রচার করা হইতেছে “ইসলাম বিপন্ন”
প্রথমতঃ আমাদের দেখিতে হইবে ভারত সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র কিনা? ইহার উত্তর স্পষ্ট। ভারতের রাষ্ট্রনায়কেরা বরাবরই ঘােষণা করিয়া আসিতেছেন ভারত অন্য কোন রাষ্ট্রের এক ইঞ্চি জমিও চায়না। পৃথিবীর নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলিও ভারতের এই মহান আদর্শের কথা জানে। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের শাসকদল বাংলাদেশে যে সকল কাণ্ড কারখানা চালাইতেছেন, সেগুলি ইসলামীক কি? চোখ ও কানওয়ালা নিরপেক্ষ মুসলমান মাত্রেই জানেন বিশেষতঃ শরিয়তের অনুগামী ধর্মভীরু সকল মুসলমান দেখিতেছেন বাংলাদেশে জঙ্গীশাহীরা ইসলাম ও শরীয়তকে এমনকি মানবতাকে নির্মম ও বেপরােয়াভাবে অবমাননা করিয়া চলিয়াছেন। ইসলামের মহান ও মৌলিক আদর্শকে খানবাহিনীর লােকেরা কোন মর্যাদা দিতেছেন না। খানেরা কিভাবে মানবতাকে ইসলামকে, ন্যায় নীতিকে তুচ্ছ করিয়া বাঙালী মুসলমানদেরে পিপড়ার মত মারিয়াছে তাহা কি পুনরায় ব্যাখ্যার প্রয়ােজন আছে?
পাঠানী শােষণ শাসন থেকে মুক্ত হইয়া বাংলাদেশবাসীরা স্বতন্ত্র হইতে চাহিতেছে এবং পরিস্থিতি যে স্তরে পৌছিয়াছে তাহাতে স্পষ্টই বলা চলে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হইবেই। অধিবাসীদের শতকরা ৮০ জনই যখন মুসলমান তখন মুসলিম রাষ্ট্র হইবে। বর্তমান খানদের দ্বারা শাসিত অদূর ভাবীকালে বাঙালী বিশেষতঃ মুসলমানদের দ্বারাই শাসিত বা পরিচালিত হইবে। বাঙালী মুসলমানরা তাহাদের রাজ্য শাসন করিলে কি ইসলাম বিপন্ন হইবে? | যদি ধৰ্ম্ম দিয়া রাষ্ট্র গঠনের ফরমা রচনা হইত তাহা হইলে মরক্কো ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ৪১ টি মুসলিম রাষ্ট্র হইতাে না। একটা মুসলিম রাষ্ট্রই হইত। ইরান ও ইরাক পৃথক হইতাে না, সৌদী আরব ও য়্যামন আলাদা রাষ্ট্র হইত না।
পরিষ্কার কথায় ধর্ম দিয়া রাষ্ট্রে কাঠামাে তৈয়ার হয়না এ সত্যটুকু আমাদের সকলেরই বােঝা উচিত। সুতরাং পাঠানদের অঞ্চল মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানই” থাকিবে আর বাংলাদেশ বাঙালীদেরই মুসলিম রাষ্ট্র হইবে। এই রাষ্ট্রে ধর্ম নিরপেক্ষতাই প্রধান প্রধান স্থান লাভ করিবে। যাহার ফলে ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ আদর্শ অধিকতর সম্মানীত হইবে। বাংলাদেশের সকল অধিবাসী ধর্ম বর্ণ ভেদাভেদ না করিয়া নিজেদের দেশকে মহান করিতে পারিবে।।
ঐ দেশ ভারতের ও অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বন্ধুতের হিসাবেই সম্পর্ক বজায় রাখিয়া বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবেই চলিবে কাহারও তাবেদার রাষ্ট্র হিসাবে থাকিবেনা। সে দেশ সম্ভাবনাময়ী রাষ্ট্র হিসাবে তৃরিতে শক্তিশালী হইয়া উঠিবে। এবং সেটাও মুসলিম রাষ্ট্র হইবে ও তাহা বাঙালী মুসলমানদের নেতৃত্বেই শাসিত হইবে, অমুসলমানেরাও সে রাষ্ট্রে সমান মান মর্যাদা, অধিকার ও সুযােগ লাভ করিবেন।

সূত্র: আজাদ, ৩ নভেম্বর ১৯৭১