বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ
(মৌং ইলিয়াছ আহমদ, ভাঙ্গা)
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট ভারতকে খণ্ডিত করে সৃষ্টি হয় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং সেই পাকিস্তানের কলােনীতে রূপান্তরীত হয় সােনার বাংলা। বাঙালীরা বাঙালীই রইল; তাদের প্রতি শােষণ আরও তীব্র হয়ে উঠল। সাংস্কৃতিক ও আর্থিক সকল ক্ষেত্রে চলল পাঠান পাঞ্জাবী পশ্চিমার প্রাধান্য। বাধ্য হয়ে বাঙালীরা আবার সংগ্রামে অবতীর্ণ হল। তারা সুনিপুণভাবে কার্যক্রম তৈরি করে রাস্তায় বেরিয়ে এল। তাদের ওপর চরম আঘাত হানতে চেয়েছিল আয়ুব খা। কিন্তু গদি থেকে সরে পড়লেন তিনি। জঙ্গীশাহী ইয়াহিয়া খ ক্ষমতা দখল করে জানালেন ফরমান, অতি শীঘ্র পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং জনগনেণির প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি সৈন্যদের নিয়ে ফিরে যাবেন ব্যারাকে। দিনক্ষণ স্থীর হল। ১৯৭১ ইংরেজীর ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইলেকশন। সর্বহারা পাকিস্তানীরা পদদলিত বাঙালীরা স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে নির্বাচনে নামলেন। প্লাটফরম তৈরি করল জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ। পুরােভাগে দাঁড়ালেন শেখ মুজিবুর রহমান। নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব পাকিস্তানের সবকটি আসনে আওয়ামী লীগের দখল। পূর্ব বাংলাবাসীদের এই সাফল্য সারা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিল।
তাদের জাতীয় চেতনাবােধে বিস্মিত হলেন ইয়াহিয়া খা। তিনি ছুটে এলেন ঢাকায়। শেখ মুজিবকে ভাবি প্রধানমন্ত্রী বলে অভিনন্দন জানালেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হল ঢাকায়। আসরে নামলেন। জুলফিকার আলি ভুট্টো। হুংকার ছাড়লেন পশ্চিমের কোন সদস্য ঢাকায় গেলে আগুন জ্বালাবেন তিনি সারা পশ্চিম পাকিস্তানে। ধূর্ত ইয়াইয়া স্থগিত রাখলেন অধিবেশন। আসলে ক্ষমতা মত্ত ইয়াহিয়া খাঁর গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচনের রায়কে নস্যাৎ করতঃ ক্ষমতা হস্তান্তর না করার এবং পাঠান পাঞ্জাবী চক্রের বাঙালীদের ওপর আধিপত্য ও প্রভাব বজায় রাখার যে ইহা এক অপকৌশল, তা আওয়ামীলীগ খুব ভালভাবে উপলব্ধি করল। ক্ষ্যাপা বাঙালীরা আর বসে থাকতে পারলনা। তারা স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের তােড় জোড়ে রেগে গেলেন। ইয়াইয়া খা ছুটে এলেন ঢাকায়। একদিকে দফায় দফায় শুরু হল মুজিবের সহিত পাক প্রেসিডেন্টের বৈঠক এবং অপর দিকে গােপনে চলল সামরিক অভিযানের সকল প্রস্তুতি ও মুজিবের গ্রেপ্তারের ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল। | ২৫ শে মার্চের রাতে সামরিক বাহিনীর শত্ৰু মানুষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খাঁর হাতে পুৰ্ব্ববাংলার সামরিক প্রশাসনের সমস্ত দায়ীত্ব তুলে দিয়ে রাত্রির অন্ধকারে প্রেসিডেন্ট উড়ে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সঙ্গে সঙ্গে চলল বাঙালী নিধন। ঢাকা চট্টগ্রাম কুমিল্লা সিলেট ও অন্যান্য বড় বড় শহরে ক্যান্টনমেন্টে শুরু হল সামরিক তৎপরতা, গর্জে উঠল কামান, মেশিনগান ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র। বন্দী হলেন সেই ভাবী প্রধান মন্ত্রী শেখ মুজিব। বাঙালীদের উপর অবিশ্রান্তগােলা বর্ষণ হতে লাগল। লাঞ্ছিতা ও নিখোঁজ হয় বহু হাজার বাঙালী মহিলা। শৃগাল কুকুরের মত মারা গেল প্রায় দশ লক্ষ লােক। ৮০ আশি লক্ষের মত হলেন গৃহহীন বাস্তুহারা। বাঙালী যে সব কিছু বিসর্জন দিতে পারে তবুও পারে না বিসর্জন বাঙালীত্ববােধ ও জাতীয় চেতনা। তা তারা আরেকবার প্রমাণ করলেন। বন্দুক বেয়নেটে তারা দমিল না। তারাও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করল। মুক্তিবাহিনী গঠিত হল। এখন সারা বাংলাদেশে মুক্তিফৌজের আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠছে। হানাদার পাকবাহিনীকে শায়েস্তা করে সারা বাংলাদেশে দখল নেবে মুক্তিফৌজ, পত পত করে উড়বে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু এর আগে এখনাে বহু ত্যাগ আত্মদান ও রক্তের প্রয়ােজন রয়েছে। এবং এই প্রয়ােজন মিটলেই ঘুচবে বাঙালীর লাঞ্ছনা ও অবমাননা। শােষণ শাসনের হবে চির অবসান। গড়ে উঠবে সত্যিকার বাংলাদেশ। শাসন শােষণ মুক্ত বাংলার হােক জয়।।
সূত্র: আজাদ, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১