You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.16 | বাংলাদেশ ও বিশ্বজনমত | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ ও বিশ্বজনমত

গত আড়াই মাস কাল বাংলাদেশে এহিয়াশাহী বর্বরতার বিভীষিকা কত নিদারুণ, কত বিষাদমাখা ও অমানুষিক ছিল আধুনিক সভ্যজগতের ইতিহাসে তাহার তুলনার স্থান নাই।
হিটলারী বর্বরতা, মুসােলিনীর অমানুষিকতা সব কিছুই স্লান হইয়া গিয়াছে এহিয়াখান-টিক্কা খান গােষ্ঠীর বীভৎসতায়।
ভারত এবং নিকট প্রতিবেশী কয়েকটি রাষ্ট্র ঐসব নারকীয় লীলাখেলার যে সকল তাজা খবর পাইয়াছে । বিশ্বের অন্যত্র সে গুলি সে ভাবে তখন প্রচার লাভ করে নাই।
কেন প্রচার লাভ করে নাই তাহার প্রধান কারণ হইল এহিয়া শাহী বাংলাদেশে কোন বিদেশী সাংবাদিককে যথেচ্ছ ভ্রমণ করিতে দেয় নাই, দ্বিতীয় কারণ হইল শেখ মুজিবুর রহমান তথা আওয়ামীলীগ দলের নিজস্ব কোন প্রচার ব্যবস্থা ছিল না। কারণ আওয়ামীলীগ দল ভাবিতে পারে নাই এহিয়া খান ও তার দোস্ত জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং টিক্কা খান যে বন্ধুতার, ভদ্রতার এবং আলােচনার ভান করিয়া হঠাৎ যে বাংলাদেশে নারকীয় কাণ্ড আরম্ভ করিয়া দিবেন। | তৃতীয়তঃ দিল্লীতে যে সকল বিদেশী দূতাবাস ছিল সে গুলি বাংলাদেশের ভিতরকার হত্যালীলা, পরিকল্পিত নেতৃত্ব-হনন এসকলের তেমন কোন সন্ধান সূত্র রাখেন নাই বা পান নাই। তাহা ছাড়া পশ্চিম
আরবী, উর্দু ও ইংরেজী সংবাদপত্রগুলি বাংলাদেশের নারকীয় হত্যালীলার ও ধ্বংসলীলার সত্যিকার ছবি চাপা দিয়া এহিয়াশাহীর গুণগান ও আওয়ামীলীগ দলের বিদ্রোহ দমনের কথা ফলাও করিয়া প্রকাশ করতঃ বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করার পরিপূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের মালিকানায় বা পাকিস্তান সরকারের অর্থে পরিচালিত সংবাদপত্রগুলি ও বেতারযন্ত্র মিথ্যা কাহিনী প্রচার করিয়া বাংলাদেশের ভিতরের সকল রকমের অনাচার, অত্যাচার ব্যভিচার চাপা দিয়া বিশ্বজনমতকে বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্যের বা দূরপ্রাচ্যের এমনকি আফ্রিকার মুসলীম রাষ্ট্রগুলিকে বেমালুম বিভ্রান্তিতে রাখিয়াছিল। | আওয়ামী লীগ দলের বা বাংলাদেশের সকল সংবাদপত্র বিশেষতঃ পাঠান বিরােধী পত্রিকা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, সম্পাদক বা সাংবাদিকদেরে হত্যা করা হইয়াছিল, সংবাদপত্র কাৰ্যালয়গুলি পুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছিল। সরল বিশ্বাসে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ হয়ত স্বপ্নেই কল্পনা করেন নাই
শকে আকস্মাৎ লৌহ যবনিকার অভ্যন্তরে রাখিয়া বেমালুম ধ্বংস ও নিধনযজ্ঞ এহিয়াগােষ্ঠী চালাইয়া যাইবেন। সারা দুনিয়াকে বিভ্রান্তিকর ভুল, মিথ্যা ও বানাউট [বানােয়াট] সংবাদে বা প্রচারণায় প্রতারিত করিয়া এহিয়াগােষ্ঠী বাংলাদেশকে নরকে পরিণত করিয়া লয়।
একেত ছিল না জয়বাংলার নিজস্ব তেমন কোন প্রচার ব্যবস্থা তদুপরি বিশ্ব সাংবাদিকরা বাংলাদেশ হইতে বিতাড়িত ছিলেন। তদুপরি এহিয়াশাহী মিথ্যা সংবাদে দুনিয়াকে বিভ্রান্ত রাখিয়াছিল।
তের সংবাদপত্রগুলি ও আকাশবাণী হইতে এবং বিদেশস্থ ভারতের কতিপয় দূতাবাস হইতে যখন সত্য সঠিক সংবাদ ও এহিয়াশাহী বৰ্ব্বরতার কথা প্রকাশিত হইতে থাকে তখন পাকিস্তান প্রচার করিতে থাকে পাকিস্তানকে সর্বস্বান্ত বা ধ্বংস করার জন্য ভারত মিথ্যা প্রচার চালাইতেছে। তখন পাকিস্তানের সকল প্রকার প্রচারণা ভারত বিদ্বেষে মাতিয়া উঠে এবং রব তােলে একটি মুসলীম রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য ভারত এসব করিতেছে।
ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে, জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধির তথ্যপূর্ণ প্রতিবাদ ও বিবৃতির কারণে বিশ্বের জনমত অবশেষে সত্যের সন্ধানে অগ্রসর হয়। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলি পাকিস্তাননামীয় মুসলিম রাষ্ট্রের দরদে প্রথমে বিভ্রান্ত হইলেও শেষে সত্য উপলব্ধি করিতে সক্ষম হয়। অতঃপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কতিপয় সাংবাদিক, রেডক্রশের বহুসংখ্যক প্রতিনিধি, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল সরজমিনে আসিয়া এহিয়াশাহী বর্বরতা লক্ষ্য করিয়া হতভম্ব ও বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া যান।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর, শিক্ষা মন্ত্রীর এবং শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রীর সাম্প্রতিক ইউরােপ ও মধ্যপ্রাচ্য সফর এমন কি ভারতীয় জমিয়তে ওলামার কয়েকজন নেতার আরব দেশগুলি সফরের ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের জনমত সত্যের সন্ধানে দানা বাঁধিতেছে।
প্রায় দুইমাস এহিয়া চক্র সীমাহীন অপপ্রচার করিয়া বাংলাদেশের নারকীয় লীলা গােপন রাখিয়া দুনিয়াকে বিভ্রান্ত করিতেছিল। ঈইদানীং বিশ্বজনমত ও বিশ্ববিবেক বাংলাদেশের আনুপূর্বিক ঘটনার বাস্তব চিত্র পাইয়া আগাইয়া আসিতেছেন। বিলম্ব অনেক হইয়া গিয়াছে, বাংলাদেশের নিজস্ব প্রচার যন্ত্র তেমন কিছু ছিল না বলিয়া বিশ্ববাসীরা বাংলাদেশবাসীদের নিদারুণ সংকটে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এহিয়াশাহীর নারকীয় শীলার লীলার সত্য সঠিক তথ্য-সংবাদ পান নাই বা পাইবার সুযােগ গ্রহণ করেন নাই।
ইদানিং বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিনিধিদের প্রচারে, বিবৃতিতে এবং ভারতের দৃঢ় মনােভাবে বিশ্ব বিবেকের টনক নড়িয়াছে।
বাংলাদেশবাসীদের স্বাধীনতার যে সংগ্রাম চলিতেছে তাহা সফল হওয়ার নানা লক্ষণ দেখা যাইতেছে। দেশবাসী আশা করে মুক্তিফৌজ তাহাদের বাংলাদেশকে এহিয়াশাহী নিগঢ় হইতে উদ্ধার করিয়া নিজস্ব সাৰ্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করিতে পারিবেই।
কথায় বলে সে ই ভালাে হাসে যে শেষে হাসে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশবাসীদের মুখে হাসি ফুটবেই। সােনার বাংলার ধ্বংস স্তুপের মধ্য হতেই সােনার পদ্ম প্রস্ফুটিত হইবে।

সূত্র: আজাদ, ১৬ জুন ১৯৭১