বাংলাদেশ ও পূৰ্ব্বভারত
বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতি কতটুকু সফলতার পথে সে প্রশ্ন আজ আমাদের অবােধ্য। বাংলাদেশে বা পূর্ববঙ্গে গত তিন মাস যাবত যাহা সংগঠিত হইয়া যাইতেছে, সে দেশের অসহায়, নিরস্ত্র, নিরপরাধ নরনারীর দুঃখ দুর্দশা কত চরমে উঠিয়াছে, সে দেশ হইতে আগত প্রায় অর্ধকোটী মানুষের আশ্রয়দান, স্থানদান ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ত্রিপুরা ও মেঘালয় কি ভাবে ব্রিত হইয়া পড়িয়াছে! পূর্ব ভারতের জনগণ, সরকারী প্রশাসন ও দৈনন্দিন জীবন ধারা কি ভাবে ভারগ্রস্ত হইয়াছে। তাহা ব্যাখ্যা করার প্রয়ােজন পড়েনা।
শরণার্থীদের সেবা-সাহায্যের ব্যাপারে ভারত সরকারের এবং প্রাদেশিক সরকারগুলির আন্তরিতার [আন্তরিকতার] এবং বাস্তব ব্যবস্থার ত্রুটী হইতেছে বলিয়া মনে করা যায় না। কারণ এত বড় চাপ, এত বড় দায়িত্ব, এতধিক গুরুত্ব অকস্মাৎ যথাযথভাবে চালাইয়া নেওয়াতে হয়ত স্থান বিশেষে কথঞ্চিৎ ত্রুটী থাকিতে পারে কিন্তু সদিচ্ছাতে কোন অভাব নাই।
বিশ্ববিবেক সত্যিকার ভাবে কি করিবে, পাকিস্তানের জঙ্গীশাসকরা কোন বাস্তব পন্থা গ্রহণ করিবেন, বাংলাদেশ ব্যাপারে বাস্তব রাজনৈতিক সমাধান কবে কি ভাবে হইবে তাহাও অবােধ্য রহিয়াছে।
অপর দিকে পূর্বভারতের জনগণের মনে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়াছে—কবে শরণার্থীদের চাপ হ্রাস পাইবে, কবে শরণার্থীরা তাহাদের নিজ নিজ স্থানে ফেরৎ যাইবে এবং কবে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় দৈনন্দিন নৈমিত্তিক কাজ স্বাভাবিকভাবে চালু হইবে? জনমন আজ দোদুল্যমান, অনিশ্চিত ও অস্থির।
পূর্বভারতের আকাশ বাতাস, জনস্বাস্থ্য, জনমত ও জনকল্যাণ আজ ভারাক্রান্ত। তৎসঙ্গে ইদানীং পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর সেখানকার পরিস্থিতি কোন ধাপে কিভাবে পরিচালিত হয়। সেটাও জনগণকে ভাবায়িত করিয়া তুলিয়াছে।
সর্বোপরি পাক-জঙ্গীশাহী আচরণ বর্তমানের মত অস্বস্তিকর ভাবে চলিতে থাকিলে পূর্ববাংলার সংলগ্ন পূৰ্ব্বভারতের বর্ণিত রাজ্যগুলির অনিশ্চিত পরিস্থিতি কি রূপ লয় তাহাও চিন্তার বিষয়।
আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার জনগণের নিত্যনৈমিত্তিক খাদ্য সম্ভারের যথাযথ যােগানদারী ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য রক্ষার অতি প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা, সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণের সহায়ক পরিবেশ রচনায় গুরুত্ব, বিশেষতঃ দৈনন্দিন উন্নয়ন ও প্রশাসন ব্যবস্থার সচকিত ক্রিয়াশীলতা এসব জিনিষ বাস্তব ও ত্বরান্বিত পরিকল্পনার সহিত চালাইয়া যাওয়ার গুরুত্ব আজ সমধিক প্রয়ােজন।
প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উচিত জনগণকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত রাখিয়া দৃঢ় বাস্তব পদক্ষেপে কাজ করিয়া যাওয়া। কেন না জনমনে অবসাদ ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হইতে থাকিলে প্রশাসনিক চক্রকে অনেক ক্ষেত্রেই দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হইতে হয়।
এহেন পরিস্থিতিতে দূর্নীতিপরায়ণ, মুনাফাশিকারী ও সমাজবিরােধী শক্তিজোট দানা বাঁধিয়া জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার সুযােগ পায়।।
আজ প্রশাসক, সমাজসেবক, বিধায়ক নিৰ্বিশেষে সকলকেই কঠোর বাস্তবতার সহিত কাজ করিয়া যাইতে হইবে।
সূত্র: আজাদ, ৭ জুলাই ১৯৭১