You dont have javascript enabled! Please enable it! জাসদ আওয়ামী-পরিবার ত্যাগ - সিরাজুল আলম খান-আসম আবদুর রব-শাজাহান সিরাজ সমর্থক বিলুপ্ত মুজিববাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক

জাসদ আওয়ামী-পরিবার ত্যাগ করার পর সিরাজুল আলম খান, আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ এবং তাদের সমর্থক বিলুপ্ত মুজিববাহিনী ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্বের জন্য একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত হয়। সেমতে ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ মেজর (অব) এম এ জলিল ও আসম আবদুর রবকে যুগ্ম আহবায়কসহ ৭-সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি করে গঠন করা হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। পরে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ অনুষ্ঠিত একস্ট্রা কাউন্সিলে মেজর জলিলকে সভাপতি ও আসম আবদুর রবকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০৫-সদস্যের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি এবং ১২ মে ১৯৭৩ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সম্মেলনে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। জাসদ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তাধারাকে তার আদর্শ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য ঘােষণা করে এবং বুর্জোয়া শােষকশ্রেণীর’ মুজিব-সরকারকে উৎখাতের সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।  ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গী মনােভাব ও সমাজতন্ত্রের প্রতি আকাক্ষা ছাত্রলীগের তুলনামূলকভাবে সচেতন, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী অনেককে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী জাসদ আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে দুর্নীতি ও অন্যান্য কারণে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এবং ভারতবিদ্বেষী, স্বাধীনতাবিরােধী, মৌববাদী ও আহবায়ক কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ হলেন : ১. বিধানকৃষ্ণ সেন ২. শাহজাহান সিরাজ ৩, নূর  আলম জিকু ৪, সুলতান উদ্দিন আহমেদ ও ৫, রহমত আলী (এডভােকেট)।আত্মসমালােচনা দলিল, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৩-১৪। জাসদের জাতীয় কমিটি কর্তৃক পার্টির অভ্যন্তরে কেবলমাত্র সদস্যদের জন্য ৪৪ পৃষ্ঠার এই দলিলটি মার্চ ১৯৭৯ প্রচারিত হয়। উদ্ধৃত : নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি একটি নিকট বিশ্লেষণ, প্রাচ্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮১, পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪ (টীকা)। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, জাসদ-সম্পর্কিত আলােচনায় যতদূর সম্ভব তাদের নিজেদের দলিলসমূহ যথা আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, শাজাহান সিরাজের রাজনৈতিক রিপাের্ট ১৯৮০, মাহবুবুর রব সাদী’র বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব (আন্তপার্টি মতাদর্শগত সংগ্রাম বিষয়ক) ১৯৭৮, সিরাজুল আলম খানের আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে ১৯৭৬, কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১২ নেতার দলিল) প্রভৃতির ভাষ্য জনাব নজরুল ইসলামের পূর্বোক্ত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।

ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ৩১ রাজাকার-আলবদরদের পরিবারের তরুণ সদস্যরা জাসদকে তাদের নিরাপদ আশ্রয় এবং আওয়ামী ও ভারতবিরােধী মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াস পায়। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনােত্তর দ্বিতীয় ‘ডাকসু’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ‘মুজিববাদী’ ছাত্রলীগের যৌথ-প্রার্থীদের পরাজিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগ জয়ী হয় বলে মনে করা হয় (ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের কারণে ফলাফল প্রকাশ হতে পারেনি)। স্বাধীনতা-পরবর্তী উদ্ভূত পরিস্থিতি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যকলাপে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত না-হওয়ায় ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারাচ্ছিল এবং ‘বিপরীত মেরুতে অবস্থানের কারণে জাসদের সমর্থন বেড়ে উঠছিল’ দেখে তারা একের পর এক সরকারবিরােধী কার্যক্রম গ্রহণ করতে থাকে। যেমন ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৩ ও ২০ জানুয়ারি ১৯৭৪ প্রতিরােধ দিবস, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ হরতাল ও ৩১ মার্চ ১৯৭৪ থেকে সারা দেশে সি.ও. (সার্কেল অফিসার; তৎকালীন থানা প্রশাসনের প্রধান ব্যক্তি), চেয়ারম্যান প্রভৃতি ঘেরাও শুরু করা প্রভৃতি। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে স্বাভাবিক অনুষজ্ঞ হিসেবে খাদ্যসমস্যা দেখা দেয়। মাওলানা ভাসানী একে উপলক্ষ করে সরকার বিরােধী রাজনীতির সূচনা করেন। এ-সময়কালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বহারা পার্টি, নক্সালপন্থী প্রভৃতি মাওবাদীরা শ্রেণী শত্রু খতমের নামে উপযুপরি খুন-খারাবিতে লিপ্ত হয়। সবকিছু মিলে রাজনীতিতে একটি অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং তা সামাল দিতে সরকার ১৩ জানুয়ারি ১৯৭৪ ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭৪ অনুষ্ঠেয় পূর্ব-ঘােষিত প্রতিরােধ দিবস পালনােপলক্ষে জাসদ ১৮ জানুয়ারি ১৪৪ ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রচার-মিছিল বের করে। এদিন শাসকদল আওয়ামী লীগের তিনদিন ব্যাপী দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। ফলে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী উভয়ই অধিকতর তৎপর হয়। তারা ঢাকায় ১৮ জানুয়ারি ১১ জন ও ১৯ জানুয়ারি ১০ জন এবং ২০ জানুয়ারি রাজশাহীতে ৫৭ জনকে গ্রেফতার করে।

এরপরও মফস্বলের অনেক স্থানে সফল হরতাল পালিত হয়। এমতাবস্থায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ জাতীয় সংসদে রক্ষীবাহিনীকে বিনা-পরােয়ানায় যে-কোনাে সন্দেহভাজনকে গ্রেফতারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ৪. ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৪-২৫ ও ৩১। প্রসঙ্গক্রমে, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযােগে আদমজী পাটকল থেকে পদচ্যুত এম এ আওয়াল, স্বাধীনতাবিরােধী মাওলানা মতীন, ভারতবিদ্বেষী কবি আল-মাহমুদ প্রমুখ জাসদের নীতি-নির্ধারকদের অন্যতম গণ্য হয়েছিলেন। আল-মাহমুদ দলীয় মুখপত্র গণকণ্ঠের সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে তিনি ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মৌলবাদী জামাত-বিএনপি জোটে যােগ দেন। এমনকি সভাপতি মেজর জলিল হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান কার্ল মার্কস-চুলে দাঁড়িতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতিরূপ; পরে দীক্ষা নিয়েছিলেন ইসলামিক মৌলবাদেও আদম ব্যবসায়। দৈনিক গণকণ্ঠ, ১৯, ২০ ও ২১ জানুয়ারি ১৯৭৪স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও এতদসত্ত্বেও জাসদ তাদের পূর্বনির্ধারিত ‘সি.ও. চেয়ারম্যান ঘেরাও কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে যায় এবং ১৭ মার্চ ১৯৭৪ ‘প্রতীকী’ ঘটনা হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিন্টু রােডস্থ বাসভবন ঘেরাও করে। ১৭ মার্চ ১৯৭৪ ও ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ -এর ব্যর্থতা এবং তৎপরবর্তী সরকারি নির্যাতনের চাপে তাদের রাতারাতি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রঙিন স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসে। সমাজের মধ্যস্তর থেকে আগত অস্থিরমতি তরুণ হতাশ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে মধ্য-গগনে পৌছার আগেই উদীয়মান জাসদের গতি হয়ে পড়ে নিম্নগামী। এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যে শুরু হয় অতীত-পর্যালােচনা (প্রকৃত প্রস্তাবে ১৭ মার্চ ও ৭ নভেম্বরের মধ্যবর্তীকালে অতীত-পর্যালােচনা শুরু হয় কিন্তু তা কোনাে নির্দিষ্ট পরিণতি লাভ করেনি)। পর্যালােচনায় বসে আবিষ্কার হয়, ডেনমার্কের যুবরাজ ছাড়াই জাসদ হ্যামলেট মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিল! শাজাহান সিরাজের ভাষায় :১৭ই মার্চের পূর্বে বাংলাদেশের সমাজকাঠামাে সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, বিপ্লবের স্তর সম্পর্কে আমাদের কোনাে সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। স্বভাবতই শত্রু-মিত্র নির্ধারণ ও আন্দোলনের রূপরেখা সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা ছিল অনুপস্থিত। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে : বস্তুত ১৭ই মার্চ ১৯৭৪-এ আমরা কী করতে চেয়েছিলাম? তখনকার সাহিত্যগুলাে খুঁজে দেখলে মূলত একটি জবাব বেরিয়ে আসবে। (চেয়েছিলাম) গণআন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে তাকে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে।

অন্যান্য কিছু টুটকো কথাবার্তা বলেছিলাম বটে, কিন্তু সেটা আসলে ধূর্তব্যের মধ্যে আসতে পারে না। তখন পার্টির থিসিস ছিল না। রণনীতি রণকৌশল ছিল অনির্ধারিত। পার্টি থিসিস নেই (মার্কসবাদ, লেনিনবাদের কথা বলছি)। প্রলেতারিয়েত শক্তিভিত নেই। এ অবস্থায় আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, হতে পারে? ক্ষমতা দখল? কার? জাসদের? এগুলাে কোনাে কিছুই নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ আন্দোলন এগিয়ে যেতে লাগল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ১৭ মার্চ ১৯৭৪ -এর আগে জাসদের মধ্যে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামাে’, ‘বিপ্লবের স্তর’, শত্রু মিত্র, ‘আন্দোলনের রূপরেখা’, পার্টি থিসিস, ‘রণনীতি, রণকৌশল,’ ‘আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য’ প্রভৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিলনা বা এগুলাে সম্পর্কে ‘নিষ্পত্তি হয়নি। বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য এগুলাের ৬. ২৯ মার্চ ১৯৮০ তে অনুষ্ঠিত জাসদের দ্বিতীয় কাউন্সিলে (কার্যকরী) সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক রিপাের্ট, পৃষ্ঠা ১৪। আত্মসমালােচনামূলক দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৯ ও ২০ ১৭ মার্চ ১৯৭৪ ও ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর মাঝামাঝি সময়ে পার্টি থিসিস উত্থাপিত (এবং পরে সংশােধিত) হলেও এবং রণনীতি, রণকৌশল নির্ধারণ করা হলেও জাসদ সঠিক আন্দোলন রচনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ও তদানুসারে কার্যক্রম গ্রহণ একান্ত বাঞ্চনীয় হলেও জাসদ তা না করেই ঘােড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে।  ১৭ মার্চ ১৯৭৪ প্রকৃতপক্ষে কিভাবে কী ঘটেছিল তার বর্ণনায় শাজাহান সিরাজ জানাচ্ছেন : ১৭ই মার্চের আগেই ৩০শে জানুয়ারি, ৮ই ফেব্রুয়ারির কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনমুখী অবস্থার যখন বিকাশ হচ্ছিল, (তখন) আমরা প্রতিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বর্ধিত সভা করে যে-আন্দোলনের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেছিলাম তাতে বলা হয়েছিল, গ্রাসরুট লেভেল-এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে এবং সেখান থেকে একে আবার কেন্দ্রমুখী করা হবে। কেউ কেউ এটাকে গ্রাম থেকে শহর ঘেরাওয়ের অর্থে বুঝে থাকলেও ব্যাপারটি সেরকম ছিল না। সেভাবেই ঢাকা শহরে একটি টোকেন ঘেরাও অভিযান পরিচালনা করার কথা ছিল। অথচ ঘটল কী? টোকেন ঘেরাও বলা সত্ত্বেও, কেবল মেমােরেন্ডাম দেওয়ার কথা থাকা সত্ত্বেও এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাড়ি না-থাকা সত্ত্বেও আমরা সন্ধ্যার পরে সেখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলাম। ইতিমধ্যেই ধস্তাধস্তি, ঠেলাঠেলি, অস্ত্র ছিনতাই, গােলাগুলি ইত্যাদি শহীদ হলেন অনেকে।

গ্রেফতার হলেন জলিল, রবসহ অনেকে অর্থাৎ শাজাহান সিরাজ বলতে চান যে, আন্দোলনের কর্মসূচি (কেন্দ্র থেকে গ্রসরুট মুখী এবং গ্রাসরুট থেকে কেন্দ্রমুখী) সম্পর্কে নেতৃত্বের ব্যাখ্যা আর কর্মীদের বুঝ’ এক ছিল না। টোকেন ঘেরাও’ সেজন্য শেষ পর্যন্ত আর টোকেন থাকেনি। কিন্তু জাসদের অন্যতম নেতা মাহবুবুর রব সাদী তার সাথে ভিন্নমত পােষণ করে বলেন : পার্টির সিদ্ধান্ত ছিল এই ঘেরাওয়ের সঙ্গে সারাদেশে উনত্রিশটি জায়গায় সশস্ত্র ঘটনা ঘটানাে এবং দুই জায়গায় সিদ্ধান্ত পালিতও হয়েছিল। এরপরও আমরা যদি বলতে চাই চুয়াত্তরে মার্চ মাসে আমরা রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে যেতে চাইনি, বা এ ধরনের কোনাে ইচ্ছা আমাদের ছিল না, তাহলে একে মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু বলা যাবে।  পল্টন ময়দানে সমবেত লক্ষাধিক মারমুখি জনতাকে, চরম উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতার মাধ্যমে আরও মারমুখি করে তুলে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরায়ের ঘােষণা দিয়ে, জঙ্গী মিছিল সহকারে তার বাসভবন পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে আমরা যদি বলি শুধু ভাবে memorandum দিতে গিয়েছিলাম, তাহলে এটাকেও মিথ্যাচার ছাড়া কিছু বলা যাবে৯. আত্মসমালােচনা দলিল, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৯ তৎকালীন ছাত্রনেতা আফম মাহবুব হক বিনা উস্কানিতে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীকে লক্ষ্য করে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করেন। (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২৮ নভেম্বর ১৯৮০ পৃষ্ঠা ৪৩; খন্দকার মােজাম্মেল হকের পত্র) এ ঘটনায় কমপক্ষে ৮ জন নিহত হয় (এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৭)। মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব (আন্তঃপার্টি মতাদর্শগত সগ্রাম বিষয়ক), ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০ সেদিনকার পার্টি-নির্দেশ ছিল, যত শক্ত ব্যারিকেডই হােক তা অতিক্রম করে memorandum দিয়ে আসতেই হবে এর অর্থ কি? যেখানে একজন সাধারণ বুদ্ধিমান লােকও বুঝতে পারে একজন সরকারি মন্ত্রী ঐ ধরনের একটি মিছিল থেকে memorandum নিতে চাইবে না, সেখানে যেমন করেই হােক memorandum দিয়ে আসার নির্দেশ দেওয়া কি সংঘর্ষ সৃষ্টি করার নির্দেশ নয়?জানা যায়, এর পূর্বেই জাসদ ‘৩১ মার্চ থেকে সারা দেশে সি.ও, চেয়ারম্যান প্রভৃতি ঘেরাও শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মার্চ মাসের (সম্ভবত) দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাসদের বর্ধিত সভায় ঢাকায় একটা Token (প্রতীকী) ঘটনা না ঘটলে সারাদেশে সি.ও. চেয়ারম্যান ঘেরাও শুরু করতে অসুবিধা হবে-জেলা প্রতিনিধিদের এই মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ই মার্চের ঘটনাটি ঘটে।

জনাব সাদী বলেন : ১৯  এই সিদ্ধান্তটি ছিল প্রথম বড় রকমের ভুল ঘেরাও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা চরম পর্যায়ের পদক্ষেপ এ-কথা অনস্বীকার্য যে, সারাদেশ জুড়ে সরকারি কর্মচারী এবং প্রতিনিধিদের ব্যাপকভাবে ঘেরাও করার কর্মসূচি গ্রহণ করার অর্থই রাষ্টশক্তির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া কারণ এ ধরনের অন্দোলনকে মােকাবেলা করতে গিয়ে রাষ্ট্রশক্তি আঘাত হানতে বাধ্য অতঃপর শাজাহান সিরাজ ১৭ মার্চের আন্দোলনকে মূল্যায়ন করে বলেন : ১৭ই মার্চে যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা আন্দোলন রচনা করেছিলাম, তা তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছেনি। বিচ্ছিন্ন ও ভ্রান্ত কর্মসূচিগত পরিকল্পনার কারণে বিশেষ করে শ্রমিক এলাকাসমূহে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া যায়নি। উপরন্তু ১৭ই মার্চের ঘটনার পর জনগণ ও আমাদের মাঝে তৈরি হয় নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬ মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৮ কার্যকরী সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক রিপাের্ট, দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৪ ১৭ মার্চ ১৯৭৪ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ের লক্ষ্য কী ছিল তা জাসদ কখনই স্পষ্ট করে কিছু  বলেনি। আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯ -এ বলা হয় স্মারকলিপি প্রদানের নিমিত্তে টোকেন ঘেরাও (গ্রাম থেকে শহর ঘেরাও নয়) কিন্তু জনাব সাদীর বরাতে জানা যায়, সারাদেশে সি, ও, চেয়ারম্যান ঘেরাও ও উনত্রিশটি স্থানে সশস্ত্র ঘটনা ঘটানাের সুবিধার্থে ঢাকায় ঐ টোকেন ঘটনাটি ঘটানাে হয়। সাম্যবাদ”-এ একে ১৯০৫-এর মস্কো অ্যুত্থানের সাথেও তুলনা করা হয়। ১৯০৫ সাল ছিল প্রথম রুশবিপ্লবের প্রথম বৎসর। আর ডিসেম্বরের মস্কো অ্যুথান ছিল সে-বৎসরের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু-হওয়া বিপ্লবী ঘটনাবলীর সর্বোচ্চ পর্যায়, যখন মস্কোর শ্রমিকশ্রেণী ক্রাসূনােপ্রেসনেস্কি এলাকায় ব্যারিকেড নির্মাণ করে জারের সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে লিপ্ত হয়।’ (নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৫ পাদটীকা-৪) অন্যদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় সে সময় শ্রমিকরা ছিল ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় লিপ্ত। সুতরাং এ তুলনাও যথার্থ নয়। বাংলাদেশের তৎকালীন শ্রমিক রাজনীতির অবস্থা জানার জন্য পরিশিষ্ট ১০ পড়ুন যােগসূত্রহীনতা। এই কারণে আমাদের রাজনীতি ও আন্দোলনগত কর্মকাণ্ড জনগণের কাছে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। বস্তুত ১৭ই মার্চের পর আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তখনও কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি নেই; যেমন হাঁকডাক করলাম অথচ জনগণ জানল আমাদের মারাত্মক শক্তি আছে।

মুজিব সরকারের ক্ষমতা নাই আমাদের গায়ে হাত দেয়। তাই পরবর্তীতে আমরা যখন মূলত প্রকাশ্যে সশস্ত্র সমস্ত ক্রিয়াকলাপ শুরু করলাম তখনও জনগণ নীরব দর্শক। তারা দেখছেন আমরা কী করি। জনগণের নিজস্ব কোনাে ক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। ১৭ই মার্চের পর ফোরামভিত্তিক যে-সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে তােলা হয়েছিল তাও বিকশিত হয়নি। সংগঠন হয়ে ওঠে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বিপ্লবী রাজনীতির অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে আমরা তকালীন আন্দোলনের প্রবাহকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। তাই বুর্জোয়াব্যবস্থা যেখানে আক্রমণস্থল সেখানে আমাদের কর্মকাণ্ডের ফলে আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন সরকার, বিশেষত সরকার প্রধান (ব্যক্তি)।” অন্যত্র তিনি বলেন : ভুল মানুষ মাত্রই করে, কিন্তু সে-ই বুদ্ধিমান যে কম ভুল করে এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। ১৭ই মার্চ, ১৯৭৪-এ আমরা যে ভুল করেছি তার মাশুল আমরা এখনও যােগাচ্ছি। ১৭ মার্চের আন্দোলন মূল্যায়ন করে জনাব সাদী আরও বলেন: ২০ আত্মসমালােচনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা যদি আমাদের অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, আমরা সব সময়ই এমন সব কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেসব কাজ করার আপেক্ষিক যােগ্যতা আমাদের ছিল না। আমরা কখনও শক্রর শক্তির সাথে তুলনামূলকভাবে নিজেদের শক্তিটুকু যাচাই করে দেখার চেষ্টা করিনি। বরং মাঠে-ময়দানে, স্লোগানে, মিছিলে আমরা এমন বক্তব্য রেখেছি, যাতে নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে নিজেদেরকে এবং সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও ভাওতা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে আমাদের সমর্থন যেভাবে বেড়েছে, মাঠ-ময়দানে গরম বক্তৃতা দিয়ে যেভাবে আমরা হাততালি পেয়েছি, তাতে করে বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে গেছি। বুঝতে পারিনি এই সমর্থন ছিল নেতিবাচক।…১৭. আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৫-১৬ কার্যকরী সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক রিপােট, দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৫ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ২০ মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৮, ৮০ জাসদের দুর্ভাগ্য যে, মুজিব সরকারকে উৎখাত করার জন্য তারা যে জনসমর্থন পেয়েছিল বলে দাবি করে তা ১৫ আগস্ট মােশতাককে ও ৭ নভেম্বর জিয়াকে বেছে নেয়, কখনই তাদেরকে নয়এই সমর্থন আমাদের প্রতি জনগণের আস্থা সৃষ্টি হওয়ার কারণে নয়।

আমরা বুঝতে পারিনি এই ক্ষোভ বিশেষ এক বুর্জোয়া দলের প্রতি, সমগ্রভাবে বুর্জোয়াশ্রেণী বা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার প্রতি নয়। যাইহােক, এই নেতিবাচক সমর্থন থেকে ইতিবাচক শক্তি গড়ে তােলা এবং তার ইতিবাচক সমর্থন সৃষ্টি করার যে-কাজটুকু করার ছিল এবং তারজন্য যে সময়টুকু নেওয়ার প্রয়ােজন ছিল, তার জন্য অপেক্ষা না করে আমরা ঐ নেতিবাচক সমর্থনকে পুঁজি করে শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হই। উনিশশাে চুয়াত্তর সালের ১৭ই মার্চের ঘটনার মধ্য দিয়ে এর চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে।… মােটামুটি উনিশশাে চুয়াত্তরের ১৭ই মার্চ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন এবং বিশেষ করে ১৭ই মার্চের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব, আমাদের আন্দোলনে প্রায় সর্বত্রই একটা বামপন্থী হঠকারী ঝোঁক ছিল এবং এই ঝোকটি শুধু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিসমষ্টির মধ্যেই নয় বরং পার্টির কেন্দ্রসহ সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তার করেই এটা বিরাজমান ছিল। ১৭ মার্চের গােলাগুলিতে কর্মীদের হত্যা ও নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে পরদিন হরতাল আহূত হলেও তা সফল হয় না। এর পর জাসদকে আর খুব-একটা সভা-সমাবেশ করতেও দেখা যায় না। বেশ কিছুদিন পর ১৬ নভেম্বর ১৯৭৪ ঢাকার পল্টনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সে-সভায় সরকারের পদত্যাগের দাবি সহ ১৬-দফা দাবি পেশ করা হয়। কিন্তু এর এক সপ্তাহের মধ্যে ২৩ নভেম্বর দলের সহসাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও সাংগঠনিক সম্পাদক নূরে আলম জিকুকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতার-নির্যাতনের ফলে জাসদ ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে জনাব মাহবুবুর রব সাদীর পর্যবেক্ষণ হল:  সতেরই মার্চের পর থেকে আমাদের আন্দোলনে আরেকটা ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠল, সেটি হচ্ছে গণ-আন্দোলনের প্রতি অনীহা এবং সশস্ত্র গােপন রাজনীতির প্রতি আসক্তি। কোনাে কোনাে জায়গায় সশস্ত্র মুজিববাদীদের আক্রমণ আমাদেরকে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তুলতে বাধ্য করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান না-থাকলেও উপর্যুপরি কেন্দ্রীয় নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে আমরা আন্দোলনকে সশস্ত্র কার্যকলাপের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করি। উল্লেখ্য, ১৭ মার্চের ঘটনার পর প্রকাশিত সাম্যবাদের’ ২য় সংখ্যায় মাও সেতুং-কে উদ্ধৃত করে বলা হয়, দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এখানে সংগ্রাম অর্থ যুদ্ধ আর সংগঠন মানে সেনাবাহিনী।’ এ-কথার সাথে সঙ্গতি রেখে গড়ে উঠতে২২ মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮২ ২৩ নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২থাকে ‘গণবাহিনী’। গােটা এই প্রক্রিয়াটা চরমে গিয়ে ঠেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলিতে। আত্মসমালােচনা দলিলেও এর স্বীকৃতি পাওয়া যায় এবং সেখানে এর সমালােচনা করে বলা হয় :২৯ গণবাহিনী গড়ে উঠতে লাগল ।…

ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ নেই বলেই গণবাহিনী সদস্য সংগ্রহ করতে লাগল গণসংগঠন গুলাে থেকে এবং এভাবে সংগঠনসমূহের মৃত্যু ঘটতে লাগল। পার্টি প্রক্রিয়ার মূল দুর্বলতা মূলত এখানেই এবং এভাবেই। কারণ যেভাবে পার্টি গড়ে উঠছিল, তাও হয়ে পড়ল গণসংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন শক্তি। আজকে যেভাবেই এটাকে ব্যাখ্যা দিই না কেন, সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা আছে গণবাহিনীর জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে গণসংগ্রামের অভ্যন্তর থেকে হয়নি। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে তথা আমাদের সাথী সংগঠকদের কাছে শক্তি ছিল। মুজিবী স্বৈরশাসনের বিপক্ষে রাজনৈতিক মহল এমনকি জনগণের বেশ বড় রকমের একটা অংশে একটা প্রতিরােধ গড়ে উঠুক এ প্রত্যাশা ছিল। এরকম মুহূর্তে গণসংগ্রামে ছেদ ঘটিয়ে বা গণআন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই গড়ে উঠেছিল গণবাহিনী। … এই ছেদ ঘটানাের বক্তব্যটি (১৭ই মার্চের ঘটনার পর থেকে গণআন্দোলনে ছেদ ঘটিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নিয়ােজিত হওয়া-লেখক) একটি মৌলিক ভুল। সে ভুলের ভিত্তিতে যে নতুন ধরনের সংগঠনসমূহ গড়বার চেষ্টা করা হল, গণআন্দোলনের অনুপস্থিতিতে তা গণসংগঠনসমূহকে খেয়ে ফেলল। নিজেও সাধারণ অর্থে বিকশিত হতে পারল না।আগস্ট কুমূল্যায়ন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে সামরিক কু-এর মাধ্যমে উৎখাত করা হয়। এ প্রসঙ্গে জনাব সাদী বলেন: বাকশাল বিরােধী জনগণের নেতিবাচক সমর্থনকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ মুজিবের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন পুষ্ট মােস্তাক-চক্র।যেহেতু জনগণের ক্ষোভ বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে, বা বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে নয় বরং একটি বিশেষ বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে, সেইহেতু সেই বিশেষ সরকারটির পরিবর্তনেই জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল এবং আরাে কিছুদিন ধৈর্য ধরে পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। আমরা আমাদের নেতিবাচক সমর্থন বিপুল পরিমাণে হারালাম।২৪. আত্মসমালােচনা দলিল, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ২০-২৪।

২৫. মাহবুবুর রব সাদী, পূর্বোক্ত, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পৃষ্ঠা ৮৩-৮৪জনাব শাজাহান সিরাজের রিপাের্টের ভাষাও প্রায় অনুরূপ: তাই পরবর্তীকালে ১৫ আগস্ট ব্যুদেতার মাধ্যমে মুশতাক ক্ষমতা দখল করলে জনতা তাকেই সমর্থন যুগিয়ে যায়। মুজিবের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই জনগণের প্রয়ােজন আপাতত ফুরিয়ে যায়! কিন্তু কর্নেল তাহের এর বিপরীত মনােভাব পােষণ করেন। ১৫ আগস্ট সকালে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির এক অফিসার মেজর রশিদের পক্ষে ফোনে মুজিবের হত্যাকাণ্ডের খবর দিয়ে তাকে বাংলাদেশ বেতার ভবনে যেতে বলেন। ১৫ আগস্টের ক্যু সম্পর্কে তার ভাষ্য হল : আমি তখন রেডিও চালিয়ে দিয়ে জানতে পেলাম, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মােশতাক ক্ষমতা দখল করেছে। এই খবর শুনে আমি যথেষ্ট আঘাত পাই। আমার মনে হলাে এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। এমনকি জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।… ১৭ই আগস্ট এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এই ঘটনার নেপথ্য-নায়ক। আমি আরও বুঝতে পারলাম যে, এর পেছনে খােন্দকার মােশতাকসহ আওয়ামী লীগের উপরের তলার একটা অংশও সরাসরি জড়িত। এই চক্র অনেক আগেই যে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করে নিয়েছিল সেটাও আর গােপন রইল না। সেদিন থেকেই আমি বঙ্গভবনে যাওয়া বন্ধ করি ও এই চক্রের সাথে সব যােগাযােগ ছিন্ন করি।” পরবর্তীকালে মেজর জলিল মুজিবের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন : শেখ সাহেবের মৃত্যুটা হচ্ছে একটা ট্রাজেডি। ইটস এ ট্রাজেডি ফর দ্য নেশন। শেখ সাহেবের ইমেজ এই জাতি ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু সবচেয়ে বড় ট্যাজেডি হল আমরা তা ব্যবহার করতে পারিনি। শেখ সাহেবের মৃত্যুর জন্য তিনি যতটা দায়ী, আমার মনে হয় জাতি হিসেবে আমরাও কম দায়ী নই। জাতীয়তাবাদী চেতনাটার যেভাবে মৃত্যু ঘটল, তা আমি সহজে মেনে নিতে পারি না। এখনও মেনে নিতে পারছি না। ইতিহাস শেখ সাহেবকে মহানায়ক হিসেবে, আমার মনে হয় সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করবে।”২৮. দ্বিতীয় সম্মেলনের রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০ পৃষ্ঠা ১৫ লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব তাহেরের শেষ কথা (অনুবাদ : মুনীর হােসেন), কর্ণেল তাহের সংসদ, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৩৩-৩৫ যে-সময়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছিল ঠিক সে-সময়ে (১৫ আগস্ট ভােরে) আমেরিকান দূতাবাসের কয়েকটি গাড়ী শহরের চতুর্দিকে ছােটাছুটি করছিল।

আর পাকিস্তান হত্যাকাণ্ডের এক ঘণ্টার মধ্যেই মােশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয় তবে ঘাতকদের সাথে তাহেরদের সম্পর্কটি বুঝা যায় রশিদ কর্তৃক তাহেরকে ১৫ আগস্ট মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব ও সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে লে. কর্ণেল জিয়াউদ্দিনকে নিয়ে মােশতাকের জন্য একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব করার মধ্য দিয়ে। সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ ১৮ এপ্রিল ১৯৮০, (সাক্ষাৎকার), পৃষ্ঠা ৩৬সিপাহী ব্যু মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎস’র ভাষ্যমতে, মুজিবের উৎখাতের কয়েক মাস আগে থেকেই জাসদ এক সার্বিক গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্তন গেরিলা সৈনিক সমবায়ে গঠিত ‘বিপ্লবী গণবাহিনী ও কার্যরত সৈনিকদের গােপন সংগঠন ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জাসদের এই দুই সশস্ত্র শাখা নিয়ে গােপন সামরিক অধিনায়ক তাহেরের নেতৃত্বে এই প্রস্তুতি চলছিল। ১৯৭৬ সালের মার্চএপ্রিলের মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কথা ছিল। তারা ভেবেছিলেন, এই সময়ের মধ্যে শুধু যে তাদের সামরিক সংগঠনগুলােই উপযুক্ত হয়ে উঠবে তা নয়, সেই সাথে শহরে ও গ্রামে তাদের গণসমর্থনকে তারা আবার সংগঠিত করে তুলতে পারবেন। কিন্তু ঘটনার গতি-প্রকৃতি তাদের তাড়াহুড়াে করে কাজ করতে বাধ্য করেছে। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ভাের ৪টায় অভ্যুত্থান ঘটানাের প্রস্তুতিতে খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে সৈনিকরা সেনাবাহিনী প্রধান মে. জে. জিয়াউর রহমানের বাসভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়েছে। জিয়া ঘুম থেকে জেগে অবস্থা বুঝে নারায়ণগঞ্জে কর্নেল তাহেরকে ফোন করে তার বিপন্ন জীবন রক্ষার অনুরােধ করেন। কিন্তু কথা শেষ করার আগেই লাইন কেটে যায়। পরদিন ৪ নভেম্বর বিকালে জিয়া তার এক আত্মীয়কে তাহেরের বাসায় পাঠিয়ে পুনঃ অনুরােধ করেন, তিনি (তাহের) যেন সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তার প্রভাব কাজে লাগিয়ে জিয়াকে মুক্ত করেন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেন। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও সব ধরনের অপকর্মের অবসান ঘটানাের প্রতিশ্রুতি দেন। পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টের অভ্যুত্থানের পটভূমি ও ফলাফল সম্পর্কে ললিফশুলৎস বলছেন: ১৯৭৪ সালটা ছিল বাংলাদেশের জন্য বিপ্লবী বাম’-এর বছর।

জাসদ আর সর্বহারা পার্টি থেকে শুরু করে মাওলানা ভাসানী আর তােয়াহার সাম্যবাদী দল-সবাই এক সাথে, এক সুরে ক্ষয়িষ্ণু ও অসাধু মুজিব সরকারের ওপর ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তোষ অত্যন্ত স্বার্থকভাবে তুলে ধরছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যদিও বামপন্থী দলগুলােই প্রকাশ্য আন্দোলন আর গােপন তৎপরতার ভেতর দিয়ে গণবিদ্রোহের এক নতুন পটভূমি প্রস্তুত করেছিল, কিন্তু সময় আসলে ডানপন্থীরা ধূর্ততার চরম (পরাকাষ্ঠা) দেখিয়ে সুযােগ ছিনিয়ে নিল। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী পনের আগস্টের সকালে জেগে উঠে জানলো  মাত্র ছয়জন আর্মি মেজর আর তাদের অধীনস্থ সৈন্যদের অস্ত্রে পরিবারের প্রায় ৪০ জন সদস্যসহ শেখ মজিবুর রহমান ৩১. লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব তাহেরের শেষ কথা, পৃষ্ঠা ১৪। উল্লেখ্য, সামরিক ট্রাইব্যুনালে অনুষ্ঠিত বিচারে তাহেরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগসমূহের অন্যতম ছিল ১৯৭৪ সালের জুলাই থেকে আইনসিদ্ধ বৈধ সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করা। (লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৫) লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা উনিশ (বাংলা সংস্করণের ভূমিকা) লরেন্স লিফশলুৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩ ও ১৩৭ লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৩নিহত হয়েছেন। বিনিময়ে দেশকে দেবার মতাে তেমন কোন উপহার ছিল না ছয় মেজরের হাতে। কেবল মুজিবের দল আওয়ামী লীগের অতি ডানপন্থী রাজনীতিক খােন্দকার মােশতাক আহমেদ আর পাকিস্তান আমলের পুরনাে সেই নীতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, আমেরিকা হল যার সামরিক ও অর্থনৈতিক ভরসা। আয়ুব খানের মতােই এরাও সােভিয়েত সমর্থিত ভারতীয় আগ্রাসনবাদের প্রতি পিকিং(ওয়ালা)দের গাত্রদাহ মনােভাবকেই দাবার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করল। সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে কর্নেল তাহেরও প্রায় অনুরূপ মনােভাব পােষণ করতেন। তার ভাষায়:৩৬… মােশতাক সরকার জনগণকে মুজিব সরকারের চাইতে কোন ভাল বিকল্প উপহার দিতে পারে নি। পরিবর্তন হয়েছিল শুধু এই রুশ-ভারতের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হয়ে দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপুটে ঝুঁকে পড়েছিল। এছাড়া দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল আগের মতই। সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অন্যদিকে রাজনৈতিক নিপীড়ন আগের থেকেও বেড়ে গিয়েছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অত্যাচারের প্রবৃত্তি যেন দিন দিন বেড়েই চলছিল। জনগণের দুর্ভোগ ও হয়রানি আগের মতােই চলতে থাকে, রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার অব্যাহত থাকে। সত্যিকার অর্থে দেশ তখন একটা বেসামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের কবলে পড়ে গিয়েছিল।

মানুষ অস্থির হয়ে উঠে। তারা এই অবস্থা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। রুশ-ভারতের চর আর জনতার কাছে অগ্রহণযােগ্য অসামাজিক শক্তিগুলাে পরিস্থিতির সুযােগ নেয়ার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল। মােশতাক সরকারের ব্যর্থতার সুযােগে আমাদের জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করার জন্য একটা ষড়যন্ত্র গড়ে উঠে। এই চক্রান্তের নায়ক ছিলেন উচ্চাভিলাষী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ। প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পঁচাত্তরের তেসরা নভেম্বর খালেদ মােশাররফ ক্ষমতায় আসেন। খালেদ মােশাররফের অ্যুত্থানের দিনই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য বেশ কিছু । সিপাহী, এনসিও (নন-কমিশনড অফিসার) এবং জেসিও (জুনিয়র কমিশনড অফিসার)।৩৫. লরেন্স, লিফশুলৎস অ্যুত্থানকারী ছয় মেজরের কথা উল্লেখ করলেও তাদের নাম উল্লেখ করেন নি। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার বাংলাদেশ এ লেগেসি অব ব্লান্ড’ -এ সাত মেজরের নাম উল্লেখ করেন। এরা হলাে : ১. ফারুক রহমান, ২. খন্দকার আব্দুর রশিদ, ৩. শরিফুল হক (ডালিম), ৪, বজলুল হুদা, ৫, আব্দুল আজিজ পাশা, ৬. শাহরিয়ার রশিদ খান ও ৭. নূর চৌধুরী। হত্যা মামলায় এরা ছাড়াও আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১. মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), ২, রাশেদ চৌধুরী, ৩, মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), ৪, আহমেদ শরিফুল হােসেন প্রমুখসহ অন্যান্য কয়েকজন। একই সাথে নিহত লােকের সংখ্যাও ৪০ নয়, ২০ জন। লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৫-৩৬ তাহেরের নারায়ণগঞ্জের বাসায় হাজির হয়। আরেকটি বিদ্রোহের জন্য শুরু হয় সামরিক-প্রক্রিয়াকরণ । তাহেরের নির্দেশনায় ৪ থেকে ৬ নভেম্বর প্রতি রাতে জুনিয়র অফিসার আর সেপাইদের মধ্যে গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৫ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস ও শহর এলাকায় হাজার হাজার প্রচারপত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়। অ্যুত্থানের ডাক হিসেবে বারাে দফা দাবি পেশ করা হয়। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সব সেনা ইউনিটের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ও তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় অ্যুত্থান পরিকল্পনাকে দু’ভাগে ভাগ করে কার্যকর। করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং অন্যান্য সেনানিবাসেও সতর্কতার সাথে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ৭ নভেম্বর ভাের একটায় সিপাহী অভুত্থান শুরু হবে। সভার সিদ্ধান্তসমূহ ছিল :১. খালেদ মােশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, ২. বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা, ৩. একটা বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা, ৪. দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তিদান, ৫. রাজনৈতিক কর্মীদের উপর থেকে গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রত্যাহার, ৬, বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন ও ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বারাে দফা দাবি মেনে নেয়া ও তার বাস্তবায়ন করা। জাসদের পক্ষ থেকে এই অভ্যুত্থান সংঘটনের পক্ষে পরিপ্রেক্ষিত ও যুক্তি দেখিয়ে বলা হয় : খালেদ মােশাররফ আর তার সহযােগীরা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে ইন্দোসােভিয়েত প্রভাব বলয়ের বিস্তার ঘটাবার কাজে ব্যাপৃত হয়। আওয়ামী লীগ আর তার লেজুড়ে মণি-মােজাফফর চক্র প্রকাশ্যে বের হয়ে এসে শেখ মুজিবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে আত্মনিয়ােগ করে। এরই মধ্যে দেশের সেনাবাহিনী বিশেষ করে জোয়ানরা তাদের অফিসারদের মধ্যে ক্ষমতার লালসা আর নিজেদের উচ্চাকাক্ষা চরিতার্থ করতে সাধারণ সিপাহীদেরকে পুতুলের মতাে ব্যবহার করতে দেখে ভেতরে ভেতরে রােষায়িত হয়ে উঠছিল। পাঁচই নভেম্বরে প্রকাশিত ও ঢাকা সেনানিবাসে প্রচারিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রচারপত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাদের মনােভাব। পরদিন রাত্রিতে বিপ্লবী গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। যৌথ সভায় চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যারাক থেকে বের হয়ে এসে খালেদ মােশাররফ চক্রের পতন ঘটাতে ।… যে সব কারণে এই সংঘাতে জড়ানােটা জরুরি। হয়ে পড়ে তা হচ্ছেপ্রথমত : এর মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার সবচেয়ে সক্রিয়, সংগঠিত ও স্বেচ্ছাচারী সামরিক চক্রের ঐক্যে ফাটল ধরানাে,”৩৭.  ললিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩,১৪, ৭৪, ১৩৬ ও ১৩৮রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপাের্ট : ৭ই নভেম্বর ও পরবর্তী ঘটনাবলী, সাম্যবাদ, ৪র্থ সংখ্যা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ১৩-১৪। উদ্ধৃত ; ল, লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫দ্বিতীয়ত : বুর্জোয়া শক্তির সাংগঠনিক ক্ষমতা একেবারে পঙ্গু করে দেয়া, তৃতীয়ত : জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রধান পৃষ্ঠপােষক সব রকমের সাম্রাজ্যবাদী,  সংশােধনবাদী, আধিপত্যবাদী শক্তিকে দুর্বল করে দেয়া, চতুর্থত নতুন আইনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির যতদূর সম্ভব পুনঃপ্রচলন করে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কবর রচনা করা ও পঞ্চমত : বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমান্তরালে সর্বহারা শক্তিগুলাের রাষ্ট্র ও রাজনীতির শক্তিভিত গড়ে তােলা। সব কিছুই পরিকল্পনামাফিক হয়। বেতার, টিভি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পােস্টঅফিস, বিমানবন্দর ও অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলাে প্রথম আঘাতেই দখল করা হয়।

ভােররাত্রে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান ও ট্রাক ভর্তি সেনা সমভিব্যাবহারে কর্নেল তাহের তাের তিনটার দিকে সেখানে উপস্থিত হলে এক আবেগপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। নৈশপােশাক পরিহিত জিয়া তাহের ও তার ভাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেন, জীবন বাঁচানাের জন্য পানি ভর্তি চোখে কৃতজ্ঞতা জানান। সিপাহীরা জিয়ার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিলে জিয়া তা খুলে নিয়ে এই লােকই মালা পাওয়ার যােগ্য বলে তাহেরের গলায় পরিয়ে দিয়ে জাসদ বা তাহের যা বলবেন তিনি তা-ই করবেন বলে অঙ্গীকার করেন।  ভাের চারটায় তাহের ও জিয়া একসাথে বেতার ভবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে দু’জনে যে সব তাৎক্ষণিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলােচনা করেন তার একটি হলাে সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে সেনা-জনসমাবেশে উভয়ের ভাষণদান। পরে জিয়া “তিনি একজন সৈনিক, তার গণজমায়েতে বক্তৃতা দেয়া সাজে না’ বলে শহীদ মিনারে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ঐ কর্মসূচি বাতিল করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়া ও তাহের উভয়ই ১১ নং সেক্টরে যুদ্ধরত ছিলেন। সে সময় বিভিন্ন কৌশলগত প্রশ্নেও উভয়ই এক মত পােষণ করতেন। ফলে উভয়ের মধ্যে একটি প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে যা যুদ্ধের পরেও কিছু টানাপােড়েন সত্ত্বেও টিকে ছিল। যে জন্য খালেদ মােশাররফের অভ্যুত্থানে বন্দি জিয়া মুক্তির জন্য তাহেরের সাথে যােগাযােগ করেন। নভেম্বরের অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানকালে সম্ভবত উভয়ই একে অপরকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ব্যবহার করতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন। জিয়ার সাথে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জনৈক জাসদ নেতার মতে : আমরা তার (জিয়ার) সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখতাম।… আমরা ধরে নিয়েছিলাম। উপযুক্ত সময় আসলে জিয়া হয়তােবা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করবেন।… পরে৩৯. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের মতে, উপস্থিত অন্যান্য অফিসারগণ নিরাপত্তার কারণে জিয়াকে তাহেরের সাথে রেডিও অফিসে যেতে দেন নি।

তখন একটি রেকর্ডিং ইউনিট নিয়ে এসে তার ভাষণ রেকর্ড করে প্রচার করা হয়। বিকালে জিয়া রেডিও অফিসে যান এবং ১২ দফায় স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।প্রমাণিত হয় এটা ছিল একটা মস্তো বড় ভুল। ৪০ অভ্যুত্থানের প্রথম পর্ব সফল হলাে। খালেদ মােশাররফ ও তার সহযােগী অফিসারদের উৎখাত ও হত্যা করা হলাে। বেলা ১১টার দিকে সেনা সদর দপ্তরে তাহের, জিয়া, তাওয়াব, এম, এইচ, খান, খলিলুর রহমান, ওসমানী ও মাহবুব আলম চাষীর উপস্থিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়ে যে, সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন এবং তিনি। জিয়া, তাওয়াব ও এম.এইচ, খানকে উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসক করে একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করবেন। সেই সথে সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে।বিকালে জিয়া সিপাহীদের ১২ দফা মেনে নিয়ে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর করেন। বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি সায়েম জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তার সরকারের করণীয় সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। পরদিন মেজর জলিল ও আ.স.ম. রব প্রমুখকে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়। অভ্যুত্থানের মূল লড়াই ঢাকায় সংঘটিত হলেও ৭ ও ৮ নভেম্বর দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, যশােরে তা ছড়িয়ে পড়ে। উন্মত্ত সিপইদের হাতে অসংখ্য অফিসার প্রাণ হারায়। অনেক অফিসার লুকিয়ে সেনানিবাস ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচায়। এমতাবস্থায় ৯ নভেম্বর বায়তুল মােকাররমে জাসদের পূর্বানুমতিপ্রাপ্ত সমাবেশ পুলিশ এসে ভেঙ্গে দেয়। এখান থেকেই শুরু হয় জিয়া-জাসদ দ্বন্দ্ব।  বলা অসঙ্গত হবে না যে, সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবির বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই এ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। কলকাতার সাপ্তাহিক ফ্রন্টিয়ার এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেল, লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা সতের (বাংলা সংস্করণের ভূমিকা)। প্রসঙ্গত, পরে এ মূল্যায়ন ভুল প্রমাণিত হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৭ নভেম্বর সকালে সৈনিক সংস্থার সদস্যরা ট্রাকে চড়ে সেনানিবাস ছেড়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে ও ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই, খুনী অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান দিতে দিতে ঢাকা শহর প্রশিক্ষণ করে। শহরের জাসদ কর্মী-সমর্থক ও ভাসমান লােকজন তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে-ট্রাক মিছিলে যােগদান করে আনন্দ প্রকাশ করে। এই মিছিলেই নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ স্লোগানও ফিরে আসে।

এ সভায় ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়িয়েছেন ও সুবিধা পেয়েছেন এমন লােকদের সাথে বিপ্লবীদের সম্মিলন ঘটেছে। তাওয়াব ও এম, এইচ, খান মাত্র তিন দিন আগে সহাস্যবদনে খালেদ মােশাররফকে মেজর জেনারেলের ব্যাচ পড়িয়ে দিতে দেখা গেছে। বিচারপতি সায়েমকে ৫ নভেম্বর খালেদ মােশাররফই রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করেছিলেন। প্রকৃতই সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রতি নিষ্ঠ হলে রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পীকারকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হতাে। সর্বোপরি সংবিধানে কোন অবস্থাতেই সাময়িক শাসন জারি বা জোর করে ক্ষমতা দখল করার কর্তৃত্ব কাউকে দেয়া হয়নি। অ্যান্থনি মাসকারনহাসের মতে, অফিসার হত্যা প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় পরের দিন অর্থাৎ ৮ই নভেম্বর। … এতে করে সেনাবাহিনীতে প্রয়ােজনের তুলনায় অফিসারের সংখ্যা শতকরা ৩০ ভাগে নেমে আসে। (বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পৃষ্ঠা-১২৪) Bangladesh State and Revolution, Frontier, Calcutta, India, 13 December 1975. উদ্ধৃত : ল. লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিকেরা তাদের অফিসারদের বিরুদ্ধে এক গণঅভ্যুত্থানের আয়ােজন করে, এর মাধ্যমে ‘চর’ খালেদ মােশাররফের অপসারণই তাদের একমাত্র দাবি ছিল না। সেই সাথে তারা বারাে দফা দাবির তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নের দাবি জানায়। এই দাবি শুধুমাত্র প্রতিদিন পেটভরে ডালভাত পাবার নিশ্চয়তার দাবি না, এটা হচ্ছে একটা সংগঠিত সেনাবাহিনীতে সুপরিকল্পিত বামপন্থী ধারার বহিঃপ্রকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এ এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। এটা হচ্ছে একটা নিয়মিত বাহিনীকে একাত্তরে গেরিলা বাহিনীতে পরিণত করার ফল, গত চার বছরে যা তিলে তিলে অঙ্কুরিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। উক্ত ১২ দফা দাবির ভূমিকায় বলা হয় : শুধুমাত্র নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য আমাদের এই বিপ্লব নয়… নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে এরা (ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকারী সেনাবাহিনী-লেখক) আমাদের পুতুলের মত ব্যবহার করে যাচ্ছে-পনের আগস্টের ঘটনা তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।…আজ থেকে এদেশের সেনাবাহিনী নির্যাতিত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে নিজেদের গড়ে তুলবে।

কিন্তু বাস্তবে ঘটনা সেরূপ ঘটেনি। অভ্যুত্থান সফল হলেও এর নেতৃত্বের কোনরূপ পরিবর্তন তাে হয়ইনি, বরং অ্যুত্থানকারীরা জিয়া কর্তৃক পুতুলের মতই ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেনাবাহিনী নির্যাতিত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা তাে দূরের কথা বহুদিন যাবৎ তাদেরকে শাসন-নির্যাতন করেছে, এমনকি আজও পরােক্ষভাবে তা অব্যাহত আছে। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের মতে :কর্নেল তাহের আর জাসদ বাংলাদেশের মানুষকে তাদের স্বাভাবিক ইচ্ছার বাইরে ঠেলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে কারণেই তারা ব্যর্থ হয়েছিল। আর্থিক সুবিধে আর হেয় ভাবাপন্ন ব্যাটম্যান’ প্রথা উঠিয়ে নেয়ার ফলে জোয়ানদের মনে বিপ্লবের পক্ষে সমর্থন দ্রুত লােপ পেয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্ট পরিপূর্ণভাবে শান্ত হয়ে পড়ে। “সিপাহী বিপ্লবের’ মূল্যায়ন প্রসঙ্গে শাফায়াত জামিল বলেন : …আসলে এতে অংশ নেয়া সৈনিকদের বেশিরভাগই ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোন একটি ব্যাটালিয়নও এর মধ্যে ছিল না। … …৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি (৩ নভেম্বরের ঘটনার) কোন পাল্টা অ্যুত্থান ছিল না। মােশতাক-রশিদ-ফারুক চক্র এই পাল্টা অ্যুত্থান ঘটায় নি এবং সেজন্য তারা ক্ষমতায়ও ফিরে আসতে পারে নি। জিয়ার ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে জাসদ ও কর্নেল তাহেরই ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা চালায় ৭ নভেম্বর। সেই দিনের অভূত্থান-প্রচেষ্টায় তাদের কোন বিপ্লবী রাজনীতি সম্পৃক্ত ছিল না। সৈনিক সংস্থার ১২ দফায় বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে এমন একটি দফাও স্থান পায়নি। সবগুলােই ছিল সেনা৩৫. The Twelve Demands’, Far Eastern Economic Review, 5 December 1975. উদ্ধৃত ;ল, লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৬ ছাউনিকেন্দ্রিক। সেনা ছাউনিতে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে রচিত ১২ দফায় ছিল শুধু ঘৃণা, হিংসা আর বিদ্বেষ। …মাত্র ১২ ঘন্টার ব্যবধানে জিয়া এবং তার অনুগতরা জাসদ ও তাহেরের ঐ অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। জাসদ তাদের লক্ষ্য অর্জনে শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। কিন্তু জাসদ ও তাহেরের হঠকারিতায় এরই মধ্যে নিহত হন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সেনানীদের কয়েকজন। মূলত চেইন অব কমান্ড ও জিয়ার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি তাকে সেদিন সফল হতে সাহায্য করে, তাহের ও তার রাজনৈতিক সহযােগীরা ব্যর্থ হন। জিয়া ক্ষমতা নিয়ে আমাদেরই নিযুক্ত প্রেসিডেন্টকে বহাল রাখেন। বিমান ও নৌ বাহিনী প্রধানদ্বয়ও (যারা খালেদের সঙ্গে সামরিক আইন প্রশাসনে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারে দরকষাকষি করেছিলেন) স্বপদে বহাল রইলেন। মােশতাক অপসারিত এবং ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তথাকথিত সূর্যসন্তানেরা দেশ থেকে বহিষ্কৃত হলাে।

দৃশ্যপটে কেবলমাত্র খালেদ মােশাররফ রইলেন না। বাংলাদেশের কোন শহরবন্দরে বিপ্লবের কোন আলামতই পরিলক্ষিত হলাে না। তাহলে ‘বিপ্লব’ কোথায় এবং কিভাবে ঘটলাে? আমার ধারণা, ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড তদন্ত ও বিচারের হাত থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত রাখার ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত সুচতুরভাবেই এই দিনটিকে জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’রূপে ঘােষণা করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে জিয়ার একটি মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ। এর অবসান হওয়া প্রয়ােজন। সেই সঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক সকল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের বিধান করা প্রয়ােজন।” যা হােক, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ আগস্টের কু’-এর পাল্টা একটি কু’ সংঘটিত হয় এবং ৭ নভেম্বর সংঘটিত হয় তার পাল্টা সিপাহী বিদ্রোহ। এগুলাে সম্পর্কে জনাব সাদী বলেন :এরপর আসলাে ৩রা নভেম্বর। যেদিন পাক-মার্কিন সমর্থনপুষ্ট মােস্তাক সরকারকে উৎখাত করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে রুশ-ভারত সমর্থনপুষ্ট বুর্জোয়ারা ক্ষমতা দখল করল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নানা কারণে ভারতীয় আধিপত্যের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ায় সর্বস্তরে জনগণের মধ্যে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখা দিল এবং নেতিবাচক সমর্থন পাকমার্কিন সমর্থনপুষ্ট মােস্তাক সরকারের সপক্ষে যেতে থাকল। ঠিক এমনি একটা অবস্থায় পাঁচই নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি লিফলেট বিলি করা হল। এই লিফলেটের মাধ্যমেই আমরা প্রথম এই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করলাম। ঐ লিফলেটের মাধ্যমে খালেদ মােশাররফ চক্রের ক্ষমতা৫৭. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৯-৫১ মধ্য-আগস্ট ১৯৭৫-এর কু’-এর সমর্থকরা খালেদ মােশাররফকে রুশ-ভারত ও আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে প্রচার করে একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও পরে প্রমাণিত হয় যে, তিনি তা ছিলেন নাদখলকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং দেশকে নিয়ে অফিসারদের এই ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধে সিপাইদের ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানের আহ্বান জানানাে হয়। ঐ লিফলেট সাধারণ সিপাহীদের মধ্যে অত্যন্ত সাড়া জাগায় এবং ছয়ই নভেম্বর দিবাগত রাত্রে সৈনিক সংস্থার উদ্যোগেই অ্যুত্থান শুরু হয়। সাতই নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে সিপাহীদের বারাে দফা দাবির ভিত্তিতে আরেকটি লিফলেট দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য, সেনাবাহিনীর অফিসারদের সকলেই বিশ্বাসঘাতক ছিল না। তাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক হলেও দেশপ্রেমিক অফিসার নিশ্চয়ই ছিল।

আমরা আমাদের কোনাে আমলে অফিসারদের কাছে কোনাে আবেদন তুলে ধরার চেষ্টা করিনি। উপরন্তু আমরা ৭ই নভেম্বরের লিফলেটের মাধ্যমে সিপাহীদের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার আন্দোলন তুলে ধরি। অর্থাৎ আমরা আমাদের কার্যকলাপে সিপাহীঅফিসার দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করার চেষ্টা করি। ৭ই নভেম্বর অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক সিপাহী ছাড়া প্রায় সকল সিপাহীই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আহ্বানে অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। খালেদ মােশাররফের ক্ষমতা-দখলকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরােধী রুশ-ভারত চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এর বিরুদ্ধে দশই নভেম্বর হরতালের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সাতই নভেম্বর অত্যুথান সংঘটিত হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত কার্যকারিতা হারায়। সাতই নভেম্বরের অ্যুত্থানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে বিচারপতি সায়েমকে নামমাত্র প্রেসিডেন্ট রেখে বর্তমান সরকার ক্ষমতা দখল করে। সরকার জাসদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক (যথাক্রমে) মেজর এম. এ. জলিল ও আ.স.ম, রবকেও মুক্তি দান করে। কিন্তু ক্রমেই সরকারের সঙ্গে আমাদের নেতৃত্বের বিরােধ বেড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ২৩শে নভেম্বর আবার জলিল, রব ও হাসানুল হক ইনু এবং তার পরদিন কর্নেল তাহের গ্রেপ্তার হন। সরকারের এই ধরনের আচরণের কারণ হিসেবে সরকারি বক্তব্য হচ্ছে জাসদ, গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা পুনর্বার অ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার-উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। আমরা আজ পর্যন্ত এ-ব্যাপারে কোনাে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরিনি। সাতই নভেম্বর ও তার পরবর্তী সময়ে আসলে কী কী ঘটেছিল তার অনেক কিছুই এখনও পর্যন্ত নেতাদের অনেকের কাছেও অজ্ঞাত। অবশেষে ছাব্বিশে নভেম্বর। ভারতীয় হাই কমিশনের ঘটনা ঘটল। যাকে আমরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে একটি অবিপ্লবী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে ঘটনার নায়কদের বিপ্লবী সদিচ্ছা এবং ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। এরপর আমাদের উপর নেমে আসে নির্যাতন। খণ্ড মিছিল, লিফলেট, পােস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে-তােলার চেষ্টা করে আমরা বারবার ব্যর্থতা বরণ করি। অপরদিকে সরকারের সঙ্গে সমঝােতা সৃষ্টি করার নানারকম চেষ্টা চালিয়ে৪৯. ভারতীয় হাই কমিশনারকে হাইজ্যাক করে কর্ণেল তাহেরসহ জাসদের নেতৃবৃন্দের মুক্তিপণ হিসেবে তাকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয় ব্যর্থ হই।

সাতই নভেম্বর এবং তার পরবর্তী সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলির সঠিক। মূল্যায়ন তুলে ধরতে হলে প্রয়ােজন সংগৃহীত সঠিক তথ্যাবলি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই সময়কার ঘটনাবলির কোনাে তথ্যবহুল বিবরণ সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা তুলে ধরতে পারিনি। এই সময় জাসদ, গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কার্যকলাপ মূলত পরিচালিত হয়েছিল তৎকালীন সময়ে অবস্থিত। পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির (C.0.c.) নেতৃত্বে। তকালীন C.0.C.-নেতারা এ-ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরতে অনিচ্ছুক বা অপারগ। সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে জনাব শাজাহান সিরাজ বলেন : বস্তুত ৭ই নভেম্বর আমরা কী করতে চেয়েছিলাম তা জনগণ জানত না। কারণ আমাদের দিক থেকে এ সম্পর্কে কোনাে ধারণা জনগণকে দেয়া হয়নি। জনগণের সামনে কোনাে বক্তব্য বা দিকনির্দেশনা ছিল না।  ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর আর ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নিশ্চয়ই… স্পষ্ট। অ্যুত্থান সম্পর্কে কোনাে ধারণা তাদের ছিল না, আমরা পূর্বে এ-সম্পর্কে তাদের কোনাে ধারণাও দিইনি। গুরুত্বসহকারে তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গেও আমরা শারিরীকভাবে সম্পর্কিত ছিলাম না। কাজেই বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে অ্যুত্থান সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার দুরূহ কাজটি আমরা করিনি। (সত্য বলতে কী অভ্যুথান সম্পর্কে আমাদেরও তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল।) এ সম্পর্কে আত্মসমালােচনা দলিলে বলা হয় : আমরা ভুল করেছি এবং তা থেকে মূলত কোনাে শিক্ষা গ্রহণ করিনি। তার প্রমাণ হল উপরের ঘটনাগুলাে। কিন্তু সবচাইতে জাজ্বল্যমান নিদর্শন হল আরাে পরে, নভেম্বরের বিপর্যস্ত দিনগুলােতে। এর সবচাইতে বড় প্রমাণ ৬ই নভেম্বর সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ফোরামের ঢাকায় অবস্থানরত সদস্যদের (আমার যদি ভুল না হয়) বৈঠকে যখন প্রথম হঠাৎ করে সিপাহী অভ্যুত্থানের খবর (অথবা সিদ্ধান্ত) জানানাে হল। তখন আমরা যেন এক নৈর্ব্যক্তিক চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। ১০ তারিখ হরতালের ব্যাপারে আর কিছুই আলােচনা হল না।

তাড়াতাড়ি নিরাপদ আশ্রয়ে (সেল্টার) যেতে হবে নইলে আবার ধরা পড়ে যেতে পারি (?) তাই বিদায় নিলাম। বিশদভাবে কিছুই আলােচনা হল না, দুজনের উপর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলাম। একটা লিফলেট বের হল না কেন, কিংবা দেরি করে বের হল কেন’, নির্ধারিত মিছিল কেন বের হল না’, ‘পােস্টারিং দেয়ালে চিকা কেন লেখা হয়নি’ এ-ধরনের খবর নিতে আমরা (নেতারা) ক্ষিপ্রতায় অশ্ব, অথচ সেই আমরাই ছয় তারিখ রাতে তােফা ঘুম দিলাম। অভ্যুত্থানের মুহূর্তে এই সীমাহীন গাফিলতিকে বিপ্লব কখনও ক্ষমা করতে পারে না, আমাদেরও করেনি। আবারও দেখুন ৫ তারিখ রাত্রে৫১. মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৫-৮৬ শাহজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৬ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯ পৃষ্ঠা ২৫-২৭সেনানিবাসগুলােতে এস, এস. এর নামে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে, তাদের প্রকাশ্যে আহ্বান জানানাে হয়েছে বিদ্রোহ করতে। ভেবে দেখুন, জোয়ানদের হাতে খােলা অস্ত্র, সমস্ত দেশ ক্রোধে টগবগ করছে, এ লিফলেটের ফলাফল কী হতে পারে? অথচ ৬ তারিখ রাতেই পার্টি-নেতৃত্ব এ-ধরনের অভ্যুত্থানের খবর প্রথম পেলেন। হা হতােস্মি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোথায় এ অজ্ঞতার স্থান হতে পারে? ৭ই নভেম্বরের উপর আমরা এত পরস্পরবিরােধী বক্তব্য রেখেছি যে, এর মধ্য থেকে সত্যটা যে আসলে কী তা বার করাই মুশকিল। আমরা পাশাপাশি বক্তব্যগুলাে সাজিয়ে নিচ্ছি, যেমন আমরা লড়াইয়ে বলেছি, সে-মুহূর্তে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছিল, আবার ‘সাম্য’-৭-এ বলেছি, সিপাহী-অফিসারের দ্বন্দ্বকে ভিত্তি করে আমরা তখন সর্বহারার শক্তিভিত সংগঠিত করতে গিয়েছিলাম’… সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল থাকার কারণে সামরিক ফ্যাসিবাদ ক্ষমতা দখল করে। আবার কেন এই পণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার? পুস্তিকায় বলেছি, আমরাই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করি, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে…। এগুলাে এমন পরস্পরবিরােধী যা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আবার এরকমও বলা হয়েছে, অবস্থা এমন ছিল যে, আমরা কিছু না করলেও ঘটনা ঘটতই। পরবর্তীতে আমাদের নেতৃত্বে ৭ই নভেম্বর সংঘটিত হয়েছে এটাও বলা হয়েছে -এ থেকে একটি সঠিক মুল্যায়ন বের করা দুরূহ।সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতা সম্পর্কে বলা হয় : ৭ই নভেম্বর সকালে সামরিক আইন জারি, শহীদ মিনারের জমায়েতে এবং পরদিন বায়তুল মােকাররমের জনসভায় গুলিবর্ষণ ইত্যাদি ঘটনাবলি অ্যুথানে আমাদের পরাজয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এরপরও সংগঠিতভাবে পশ্চাদপসরণের কৌশল অবলম্বন না-করে আমরা আরও শক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হলাম। স্বাভাবিকভাবেই, রাষ্টশক্তির বেপরােয়া আঘাতে আমরা অসহায় হয়ে গেলাম। বিরক্ত জনগণও আমাদের কার্যক্রমে সাড়া দেয়নি, কারণ তখন জনগণের কামনা ছিল একটু স্বস্তি।… রাজনীতিতে স্থান-কাল-পাত্রের ধার আমরা তেমন ধারিনি। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন, বিপ্লব বা ক্ষমতা দখল যে-কোনাে মুহূর্তেই হতে পারে (অবশ্য আমরা যদি ঠিকমতাে কাজ করি) এরকম একটা ধারণা আমাদের অধিকাংশ সাথীর মধ্যে ছিল। আমাদের মতাে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে একটা ধর তক্তা, মার পেরেক মার্কা ব্যাপার নয়, তা বুঝতে না-পারার কারণে মরীচিকার মতাে এর পেছনে ছুটে চলেছি এবং অযথা শক্তি ক্ষয় করেছি।

৫৫ ৫৩. সৈনিক সংস্থা ৫৪. শাহজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপােট, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৬ ৫৫আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৩৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এর ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে জনাব সাদী আরও বলেন: সাতই নভেম্বরের ঘটনাবলি দ্বারা আমরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রশক্তির অন্তর্দেশে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছি এ-বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। ওই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আমরা অবশ্যই বিপ্লবী কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারতাম। কিন্তু ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে বিপ্লবী কৃতিত্ব তাে দূরের কথা, বিপ্লবী রাজনীতির ইতিহাসে আমাদেরকে নৈরাজ্যবাদী অপকীর্তির জন্য দায়ী থাকতে হবে। এই ধরনের ল আমরা কেন করলাম? যেহেতু আমরা বিপ্লবের স্তরকে সমাজতান্ত্রিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছি, সেইহেতু এবং সেই অনুপাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সর্বহারা সারবস্তু (content) সৃষ্টি করতে গিয়েই আমরা এই ঘটনা ঘটিয়েছি। আমাদের তৎকালীন সংগঠনের সবগুলাে রূপই ছিল ভুল। যে-কারণে নবতর উপলব্ধির মাধ্যমে সেগুলােকে অবলুপ্ত করে দিয়ে আমরা আবার গণসংগঠন পর্যায়ে ফিরে এলাম।দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পর ১৯৮০ সালের মার্চে জাসদের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে এর অতীত মূল্যায়ন করে বলা হয় : আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময় বিচারে আত্মপ্রকাশ থেকে স্বীকৃতিলাভের” পূর্বকাল এবং স্বীকৃতিলাভের পর থেকে সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী কিছু সময়, এই দু’টি পর্যায় চিহ্নিত করে দেখা যায় প্রথমটিতে বাম ঝোক এবং দ্বিতীয়টিতে ডান ঝোক স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে জনাব সাদীর মূল্যায়নও প্রায় সমরূপ : বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের কার্যকলাপের মধ্যে ডানপন্থী সুবিধাবাদের ঝোঁকের অস্তিত্ব থাকলেও প্রায় সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তার করে বিরাজিত ছিল যে ঝোকটি তা হচ্ছে বামপন্থী হঠকারিতা। সদ্য একটা অসমাপ্ত সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসা বুর্জোয়া। বিশ্বাসঘাতকতায় বিক্ষুব্ধ আমাদের অধিকাংশ নেতা ও কর্মীদের পাতি-বুর্জোয়া রােমান্টিকতাই এই বামপন্থী ঝোকের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য দায়ী।উল্লিখিত ‘বামপন্থী হটকারিতার কারণ অনুসন্ধান করে বলা হয় : মার্কসবাদ যেহেতু একটা বিজ্ঞান, এ বিজ্ঞানকে সর্বহারা এমনকি বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়ারাও পাঠ্যবিষয়ের মতাে বুঝতে পারে। সমাজদ্বন্দ্বের কারণে যে-কেউ (সে নিউক্লিয়াসটিও) সমাজতন্ত্রের কথা বলতে পারেন।৫৬. মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৯-৯২ শাজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপোর্ট, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৯ জিয়ার গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ায় পিপিআর-এর অধীনে স্বীকৃতি লাভ মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮১ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৪-১৫কিন্তু তখন পর্যন্ত তার শ্রেণীভিত্তি বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া। আমরা সেই নিউক্লিয়াসটি)” সেই বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই শুরু করেছিলাম।

দেশ স্বাধীন হবার পরও আমাদের সাংগঠনিক ভিত্তি ঐ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অর্থাৎ পেটি-বুর্জোয়া। পেটিবুর্জোয়া দোদুল্যমান চরিত্রের। যখন যেদিকে জোয়ার তখন সেদিকে, আর যখন ভাটা তখন ভয়ে লেজ গােটায়। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস তখনও শেষ হয়নি। আমরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বক্তব্য নিয়ে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম। আমরা কারা? তখনও ছাত্রলীগ। আমরা ঘােষণা করলাম আমরা লড়ছি সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্টে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলার আহ্বান জানালাম। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তদান, ত্যাগ, তিতিক্ষার পরাকাষ্ঠার পরেও স্বাধীনতা আন্দোলন বিজয় লাভ করার কারণেই এর ভুল-ত্রুটির মূল্যায়ন করা হল না। বরঞ্চ বিজয়ের জোয়ারে ভিন্নমত (সঠিক বা বেঠিক) চাপা পড়ে গেল। এটাও একটি পেটিবুর্জোয়া উচ্ছ্বাসপ্রবণতা। আবারাে বলতে হয়, পেটি-বুর্জোয়ারা সমাজতন্ত্র উচ্চারণ করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? তা নয়; তবে পেটি-বুর্জোয়ারা সমাজতন্ত্রের কথা বললেই তারা সমাজতন্ত্রী হয়ে যায় না। তখনও পর্যন্ত তাদের শ্রেণীভিত্তিটি পেটি-বুর্জোয়াই থেকে যায়। আমাদেরও তাই থেকে গেছে। এই পেটি-বুর্জোয়া চরিত্র আমাদের কখন কোথায়, কীভাবে কাজ করেছে তা পার্টি-ইতিহাস পর্যালােচনা করলেই বেরিয়ে আসবে। শুধু কী তাই? জাসদ কাজও করতে গেছে স্বগােত্রীয়দের অর্থাৎ পােটি-বুর্জোয়াদের মধ্যেই। দলিলের ভাষায়:আমাদের সাংগঠনিক কাজ ছিল মূলত ভাসমান পেটি-বুর্জোয়াদের মধ্যে প্রােথিত। পেটিবুর্জোয়া দোদুল্যমান চরিত্রের বলেই একসময় যারা আমাদের চারিপার্শ্বে সমর্থনে সমবেত ছিল, জিয়ার বিজয়ে তারা তার পক্ষেই চলে গেল। আমাদের রাজনীতিও ব্যাপক জনগণের কাছে তেমন স্পষ্ট ছিল না।… পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কসীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পেটি-বুর্জোয়াদের একটা অংশ সর্বহারা বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের যাত্রা ছিল সেখান থেকে। কিন্তু আমাদের বড় রকমের ব্যর্থতাই হল আমরা পেটি-বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারিনি। ‘পেটি-বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রম করতে না-পারার কারণে জাসদের মধ্যকার নানা মতবিরােধ ক্রমে প্রকাশ্য রূপ নেয়। প্রথমে ছাত্রফ্রন্ট বিভক্ত হয়। পরে মূল দলও বিভক্ত হয়ে নির্ভেজাল বিপ্লবী দল’ বাসদ গঠিত হয়। বাসদও পুনঃবিভক্ত হয়৭১. উক্ত নিউক্লিয়াস সম্পর্কে পরিশিষ্ট ১৮ দেখুন আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৩ ও ৪১-৪২(অরাজনৈতিক কারণে)। কেউ কেউ দল ত্যাগ করে জিয়ার বিএনপিতে যােগ দেয়। অবশিষ্ট ক্ষুদ্র অংশটি এখনও তাদের অস্তিত্ব ও বিভক্ত হওয়া অব্যাহত রেখেছে। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে বর্তমানে এর পৃথক কোনাে গুরুত্ব আছে বলে মনে হয়না।

‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তাধারা’কে আদর্শ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’কে লক্ষ্য ঘােষণা করলেও জাসদ কোনাে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক দল নয়, এ একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন’ বা একটি পাটি প্রক্রিয়া। মেজর জলিলের ভাষায় :৬৩জাসদ মার্কসবাদী পার্টি নয়। জাসদকে আমরা সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন বলছি। এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর সমন্বয় ঘটবে। এখানে আন্দোলনের মাধ্যমে কর্মী তৈরি। হবে। যেমন ধরুন, আপনি মাখন তৈরি করতে চান। তাহলে আপনাকে একটা কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দিতে হবে। দুধ গরম হলে মাখন উঠবে, আপনি তা তুলে রাখবেন। মাখন উঠবে, আবার তা তুলে রাখবেন। এখানে জাসদ হচ্ছে কড়াই এবং জনগণ হচ্ছে দুধ। অর্থাৎ ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিকজোটের মতাে জাসদও অপর একটি গণসংগঠন। তাদের পার্টি গঠনের তথাকথিত প্রক্রিয়া’ আর সম্পন্ন হওয়ার সুযােগ পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে বলে মনে হয় না। মাঝখানে তারা হাজার হাজার তরুণকে বিপদগামী করেছে এবং ঠেকিয়ে দিয়েছে প্রকৃত লাল পতাকাকে, মেকি লাল পতাকা দিয়ে । অতঃপর ডান বিচ্যুতি আগস্ট-হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ঘাতক মহিউদ্দিনের (আটিলারি) নেতৃত্বে বিদ্রোহী সিপাহিদের দ্বারা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পর কার্যত জিয়া সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। পরে তিনি পথের সম্ভাব্য সকল কাটা দূর করে দেশে তথাকথিত এক নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া চালু করেন। রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে অন্যান্যের সাথে জাসদও তখন সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে রাজনীতি শুরু করে। এ প্রসঙ্গে জাসদের বক্তব্য নিম্নরূপ : ৬৬এরই মধ্যে ঘরােয়া রাজনীতির সুযােগে পরাজিত আওয়ামী লীগ হাঁটি হাঁটি পা পা। করে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে থাকে। অন্যদিকে জিয়া সরকারও বুর্জোয়াশ্রেণীর।৬৩. সাপ্তাহিক বিচিত্রা”, ১৮ এপ্রিল ১৯৮০, পৃষ্ঠা ৩৬ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামটি জার্মানীর নাৎসী হিটলারের National Socialist Party এর অনুকরণে নেয়া হয়েছিল অনেকে ধারণা করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর পাকিস্তানের প্রভু আইয়ুব খানও ১৯৬২ সালে জাতীয় পরিষদ’ দ্বারা রাজনৈতিক দল বিধি’ প্রণয়ন করে ‘গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন। জিয়া সেই ‘আইয়ুবী’ নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তার ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের উপর তথাকথিত আইনী প্রলেপ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ বিভিন্নভাবে জিয়ার সম্মুখে ভীতি হয়ে দেখা দিতে শুরু করে। জিয়ার ধারণা ছিল, জাসদ হয়তাে আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলাতে পারে। জাসদ-আওয়ামী লীগ মিলিত শক্তি জিয়ার নিকট অনেক বিপদের কারণ ছিল। এই বিবেচনাতেই জিয়া জাসদ-সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে যে-কারণে আমরা রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলাম, সে-কারণগুলােও তখনও পুরােমাত্রায় বিরাজ করছিল। তাই আমরাও চাচ্ছিলাম সরকার আমাদের সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্ত নিক।

এর ভিত্তিতেই বিভিন্ন মহলের সাথে যােগাযােগ ও আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে ১৯৭৮-র এপ্রিলে আমরা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করি। স্বীকৃতি লাভের পূর্বে আমরা কিছুটা সরকারি শৈথিল্যও লাভ করি। জাসদের ব্যানারে মিছিল,.. আলােচনা সভা, আমাদের অনেক নেতা কর্মীর মুক্তিলাভ ইত্যাদি তার প্রমাণ বহন করে। অনুমােদন লাভের পরপরই বিগতদিনের আন্দোলনগুলাে মুল্যায়ন করে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সুস্পষ্ট রাজনীতির ভিত্তিতে জাসদকে জনগণের কাছে যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু অতীত রাজনীতির মূল্যায়ন হল না। বর্তমান করণীয় সম্পর্কে তাই সুস্পষ্ট কিছু বলাও গেল না। সংগঠনের সামনে ভেসে-আসা অসংখ্য প্রশ্নের জবাব আমরা দিতে পারলাম না। প্রশ্নপত্রের এ-পাতায় ও-পাতায় ইতিউতি পাক খেতে থাকলাম। এও এক ধরনের সুবিধাবাদ। জাসদকে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে পূর্বেই, জিয়া চাচ্ছিল বুর্জোয়াশ্রেণীর আভ্যন্তরীণ কোন্দলে আমাদেরকে তার গােষ্ঠীর স্বপক্ষে ব্যবহার করতে। এক্ষেত্রে তর্কাতীতভাবেই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে ব্যবহার করে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টি করা। … আন্দোলনের সাধারণ রূপ গােটা বুর্জোয়াব্যবস্থার (system) বিরুদ্ধে হলেও, বিশেষ রূপ কি অবস্থিত ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত করা। কিন্তু স্বীকৃতি লাভের পর থেকে আমাদের কর্মকাণ্ডে আমরা তা করতে ব্যর্থ হয়েছি।৬৭. বলা হয়ে থাকে, জাসদের স্বীকৃতি লাভে জিয়া সরকারের সাথে সমঝােতা স্থাপনে মাহবুবুর রব সাদী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এ যথার্থই সুবিধাবাদ। জনাব সাদী জানাচ্ছেন, বিভিন্ন সময়ে অতীতের মূল্যায়নের প্রশ্নে আদর্শগত সংগ্রাম শুরু করার জন্য কোনাে কোনাে ব্যক্তির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাকে আমরা চিত্রিত করেছি সংগঠনের কাজে বাধা সৃষ্টি হিসেবে। মূল্যায়নকে এড়িয়ে গিয়ে বলতে চেয়েছি আন্দোলন সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিবে’ (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৫)ব্যর্থতার ফিরিস্তি এখানেই শেষ নয়। রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনেও তারা পা দেয় ভুলের বালুচরে। শাহজাহান সিরাজের ভাষায় :স্বীকৃতিলাভের পরপরই আমাদের লক্ষ্য ছিল (আত্মসমালােচনা দলিলে ৩৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল) বুর্জোয়াশ্রেণীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে ব্যবহার করে মেহনতী শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করা। কিন্তু রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের সময় আমরা আমাদের রাজনীতিকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারিনি। আমাদের নিজস্ব পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনা নাথাকাটা যদিও একটা কারণ, তবুও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সে-সময়ে আমাদের বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের চাইতে ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়াগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে শাণিত হয়েছে বেশি। ফলে জনমতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

এ প্রসঙ্গে আত্মসমালােচনা দলিলে বলা হয় : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে আমাদের বক্তৃতা-বিবৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নকে বার বার এড়িয়ে যেতে চাইলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে আমাদের বক্তব্যে সব ছাপিয়ে যে-কথাটি বেরিয়ে এসেছে তা হল -এ যাত্রায় বাকশালকে পরাজিত করুন।”সংসদ নির্বাচনের সময়ও অবস্থার কোনাে ইতর-বিশেষ হয়েছে-তা বলা যায় না। যেমন:রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়কাল থেকে বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা পর্যন্ত আমাদের বক্তব্য ছিল-জাসদ আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। জনগণ, কর্মীবাহিনী, সংগঠনকে পুরােপুরিভাবে আমরা নির্বাচনমুখী করে তুলেছিলাম। আমাদের দাবি ছিল পার্লামেন্ট নির্বাচন দিতে হবে। আর নির্বাচনের তারিখ ঘােষণার পর আমরা নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলাম। একদিকে নির্বাচন বয়কট ঘােষণা, অন্যদিকে তিনশ’ সীটে প্রার্থী দাঁড় করানাে ও জেতার জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলায় নেতা-কর্মী-সংগঠকদের মধ্যে দেখা দেয় বিভ্রান্তি। আবার নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এমনভাবে জনগণ জানল-যা কোনােভাবেই আমাদের রাজনৈতিক অর্বাচীনতাকে ঢেকে রাখতে পারেনি।” শাহজাহান সিরাজের ভাষায় : …স্বভাবতই রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের সময়ে যে বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছিল, বয়কটের সূচনা ও পরিসমাপ্তি, সিদ্ধান্ত ঘােষণার মারাত্মক পদ্ধতিগত ত্রুটি তা আরও বাড়িয়ে৬৯. শাজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপাের্ট, পৃষ্ঠা ১৭ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৮ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৯-৪০ শাজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৮-১৯ পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, রাজনৈতিক রিপাের্টে (১৯৮০) রাজনৈতিক দলবিধির অধীনে স্বীকৃতি লাভের পর থেকে ১৯৭৯ -এর সংসদ নির্বাচন পরবর্তী কিছু সময় পর্যন্ত কালে জাসদের ডান-বিচ্যুতি ঘটে। লক্ষণীয়, এই ডান বিচুতিই ক্রমে জাসদের স্থায়ী নীতিতে পরিণত হয়ে জাসদকে একটি বুর্জোয়া সংসদীয় দলে রূপান্তরিত করে। এ এক বিরাট ট্রাজেডি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদের উত্থান ঘটে কালবৈশাখী ঝড়ের বেগে, আবার এর পতনও ঘটে উল্কার গতিতে, মাঝখানে নিঃশেষ হয়।

হাজার হাজার তরুণের মূল্যবান জীবন ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। পেশা ভিত্তিক পার্লামেন্ট ২৪ এপ্রিল ১৯৭৮ রাজনৈতিক দলবিধির অধীনে রাজনীতি করার অনুমতি লাভের পূর্বেই রাজনৈতিক কাজকর্মে সরকারি শৈথিল্য লাভ ও তাদের অনেক নেতা-কর্মীর জেল থেকে মুক্তি লাভের বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাসদকে একটা ভূমিকা গ্রহণ (জিয়াকে সমর্থন) করতে হয় এবং প্রথমে বয়কটের ঘােষণা দিয়েও পরে ‘অর্বাচীনভাবে’ সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে হয়।‘সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা দেয়া ‘অসংখ্য প্রশ্ন, হতাশা, দোদুল্যমানতা ও বিভ্রান্তি এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে দ্বিধা ও অনাস্থার প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের মার্চে দলের অভ্যন্তরে (কেবলমাত্র সদস্যদের জন্য) জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রচারিত ৪৪ পৃষ্ঠার। আত্মসমালােচনা দলিলে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় : জাসদের নির্বাচন সংক্রান্ত বক্তব্যে কিংবা কর্মকাণ্ডে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, জাসদ দিন দিন একটি পালার্মেন্টারি পার্টিতে রূপান্তরিত হচ্ছে? জাসদকে আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?… জাসদ কী কারণে হঠাৎ করে নির্বাচন বর্জন করলাে? নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত কোন্ ভিত্তিতে যৌক্তিক? নির্বাচন বর্জনের পর জাসদ আন্দোলনের কোনাে কর্মসূচি দিল না কেন? এটা কি সুবিধাবাদ নয়? বিরাট গলায় বর্জনের কথা বলা, যে-কেউ বর্জন থেকে ফিরে আসবেন, তিনি দেশ ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন ইত্যাদি বলার পরও আকস্মিকভাবে বঙ্গভবন থেকে খােদ জাসদেরই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত ঘােষণায় কী বুঝা যায়? এতে কি প্রমাণ হয় না জাসদ নিজেই তার প্রদত্ত ওয়াদার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? বিস্তারিত আলােচনার পর উল্লিখিত দলিলে উপযুক্ত প্রশগুলাের জবাব হ্যা-বাচক। হয়। তবে আত্মসমালােচনায় একে ডানবিচ্যুতির কথা বলা হলেও তা শােধরিয়ে কোনাে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া হয় না। বরং নিচের আলােচনায় দেখতে পাওয়া যাবে যে,৭৩.  নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩-৫তত্ত্বকথার নানা বাগাড়ম্বরের আড়ালে ক্রমে জাসদ বিপ্লব ত্যাগ করে সংসদীয় রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছে। ১৯ জানুয়ারি ১৯৮০ জাসদ আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর। জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য ও কর্মসূচি উপস্থাপন করে। সেই কর্মসূচিতে বন্দিমুক্তি ও মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার বিষয়ক প্রথম দফার পরের এবং গােটা কর্মসূচির প্রধান দাবিই ছিল জমির দাবি। ভূমি সংস্কারকে এক নম্বরে রেখে মােট দশটি উপদফা সংবলিত কৃষিক্ষেত্রের প্রগতিশীল রূপান্তর সাধনের লক্ষ্যে একটা বিস্তৃত দাবিই ছিল সেই কর্মসূচির দ্বিতীয় এবং মূল দাবি। কিন্তু ৬ মাসের মধ্যেই ২২-৩০ জুন ১৯৮০ অনুষ্ঠিত জাসদের জাতীয় কমিটির সভায় উক্ত কর্মসূচির বিপরীতে নতুন রাজনৈতিক প্রস্তাব ও বিতর্কিত’ ১৮-দফা। কর্মসূচি গ্রহণ এবং ৪ জুলাই ১৯৮০ তা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রচার করা হয়। ১৮-দফা কর্মসূচির প্রধান দাবি হল পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট। নতুন এই কর্মসূচিটাও শুরু হয়েছে ‘মৌলিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি দিয়ে। তবে জানুয়ারির কর্মসূচির ‘জমির দাবি’কে হটিয়ে এবার দু’নম্বরে স্থান দখল করেছে। ‘পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট’ আর ভূমি-সংস্কার সম্পর্কিত অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট দাবিটাকে ঠেলে পাঠানাে হয়েছে ১১ নম্বরে!

‘সংগঠনের অভ্যন্তরে বিরাজিত বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ের উপর একটা যৌথ মতামতে উপনীত হয়ে রচিত সমন্বয় কমিটির দলিলে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ১৮-দফা কর্মসূচি শিরােনামে একটি পরিচ্ছেদে এ সম্পর্কে বিশদ আলােচনা করা হয়। উক্ত দলিলের ভূমিকায় বলা হয় : সব বিতর্কের সমাধান একদিনেই সম্ভব নয়। কিন্তু বিতর্কের অবসান করতে হলে আমাদের অবশ্যই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সবার সুষ্ঠু ধারণা অর্জন করতে হবে। সেজন্য ১৮-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ব্যাপক জনতার আন্দোলন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তােলার মৌলিক৭৫. নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯২ ততদিনে সিরাজুল আলম খান, মেজর জলিল আটকাবস্থা থেকে মুক্তি পান এবং রবও মুক্তি পেয়ে পশ্চিম জার্মানী থেকে বিশ্রাম লাভ করে ফিরে আসেন। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি (C.0.C.) ভেঙে দেয়ার কিছুকাল পর থেকে চার সহযােগী সংগঠন জাসদ, শ্রমিক জোট, কৃষক লীগ ও ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে গঠিত হয় সমন্বয় কমিটি’। পরে সিরাজুল আলম খান, মির্জা সুলতান রাজা, শাজাহান সিরাজ ও নূরে আলম জিকুকে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উক্ত দলিলটি সামান্য পরিমার্জিত হয়ে কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ” নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। তবে ১২ নেতার দলিল হিসেবে তা সমধিক পরিচিতি লাভ করে। বলা বাহুল্য, উক্ত দলিলের সর্বত্র সিরাজুল আলম খানের ‘আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গের ছায়া বিরাজমানদৃষ্টিভঙ্গি কী হবে সে-সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা থাকলে ১৮-দফা কর্মসূচির যৌক্তিকতা আমরা বুঝতে ব্যর্থ হব।…. লক্ষ্য করুন, এখানে একটি গােলকধাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। কথিত মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা অর্জনের জন্যে প্রয়ােজন ১৮-দফার কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন, আবার ১৮ দফার যৌক্তিকতা বুঝার জন্য প্রয়ােজন মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা! দলিল রচয়িতাবৃন্দের এই লেজে-গােবরে অবস্থা থেকে অনুমান করা যায় যে, বিষয়টি তাদের কাছেই সুস্পষ্ট নয়। দলিলে বলা হয় :প্রচলিত বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনাে পরিবর্তনের পথ (বক্তব্য) হাজির না করে ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের দুই সমস্যাকে কেন্দ্র করে যে-কোনাে আন্দোলনের চরিত্র নিছক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক।

তার মধ্যে কোনাে বিপ্লবী মর্মবস্তু নেই ।… সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে সর্বহারা শ্রেণী নিছক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে যাবে কেন? এতে তার কোনাে স্বার্থ নেই।”যে-ক্ষেত্রে আন্দোলন বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারে না সে-ক্ষেত্রে এর মধ্যে একটা বিপ্লবী মর্মবস্তু (পুঁজিবাদ বিরােধী উপাদান) প্রবিষ্ট করিয়ে তাকে ‘বিপ্লবী আন্দোলনে’ রূপান্তরিত করতে হবে। জাসদ-নেতৃবৃন্দ মনে করেন, প্রস্তাবিত ১৮-দফা। হল সে ধরনের বিপ্লবী কর্মসূচি এবং পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টের দাবি’ হল সেই পুঁজিবাদ বিরােধী উপাদান। এই হল কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পথ’। দলিলের ভাষায়: এখনকার পালার্মেন্ট জনসাধারণের ভােটে নির্বাচিত এ-কথা সত্যি কিন্তু জাতীয় ঐক্যের জন্য বিভিন্ন শ্রেণী ও অংশের যে-প্রতিনিধিত্ব দরকার তা কোথায়? এই পার্লামেন্টকে যদি আনুপাতিক হারে বিভিন্ন পেশাজীবীদের (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কর্মচারী, সাংবাদিক, কারখানা, শ্রমিক, কৃষি মজুর সরকারি (?) ইত্যাদি) প্রতিনিধি নির্বাচিত করে ৩৩০ জনের বদলে ৫০০ জনের পার্লামেন্টে পরিণত করা হয় এবং সে পার্লামেন্টকে সকলপ্রকার আইন প্রয়ােগের দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে-তােলার জন্য সে পার্লামেন্ট হবে একটি কার্যকরী কাঠামাে। চিন্তা করে দেখুন, আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এমনি একটি কাঠামাে গড়ে তুলতে পারলে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে কিনা এবং যে সংগঠন বা সংগঠনসমূহ আন্দোলন পরিচালনা করবে তাদের স্বপক্ষেই আজ অথবা কাল পেটিবুর্জোয়া, উদারনৈতিক বুর্জোয়াসহ ব্যাপক জনতা যোগ দিবে কিনা? পেশার প্রতিনিধি সহ সার্বভৌম সংসদ গড়ে-তােলার আন্দোলন শুধুমাত্র জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করবে না, তা ফ্যাসিবাদবিরােধী চেতনাকেও কার্যকরীভাবে লালন করবে। সমাজতান্ত্রিক শক্তিভিত গড়ে-তােলার স্বপক্ষে এই নির্দিষ্ট শ্লোগানটি কি কোনােই অবদান রাখতে পারে না? অবশ্যই অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষকে তাদের নিজস্ব৭৭. কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, পৃষ্ঠা ১৮ কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তত্ত্বিক বিশ্লেষণ, পৃষ্ঠা ৪৫সংগঠনে সংগঠিত করার জন্য স্লোগানটি যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। সকল প্রকার আইন প্রণয়নের কাজে অংশগ্রহণের এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে যেহেতু কর্মজীবী মানুষেরা তাদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলবে সেহেতু সংগঠিত শক্তি হিসেবে কর্মজীবীদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানাের পথটাকে সুগম করে দেবে। তাই, পেশাজীবীদের প্রতিনিধিসহ সার্বভৌম সংসদের দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা।

গণতান্ত্রিক আন্দোলন ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে শুধু কোণঠাসা করে দেবে না, পুঁজিবাদবিরােধী সংগঠিত চেতনায়ও বিকাশ ঘটাবে। দেখা যাচ্ছে, জাসদ আশা করে, আন্দোলনের মাধ্যমে পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট’ গড়ে তুলতে পারলে তা (বা তা আদায়ের আন্দোলন) হবে আজ অথবা কাল পেটিবুর্জোয়া উদারনৈতিক বুর্জোয়াসহ ব্যাপক জনতার ১. ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার একটি কার্যকরী কাঠামাে’ ২. ফ্যাসিবাদ বিরােধী। চেতনাকে লালনকারী’ ৩. ‘সমাজতান্ত্রিক শক্তিভিত গড়ে তােলার লক্ষ্যে ‘অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষকে তাদের নিজস্ব সংগঠনে সংগঠিত করার’ সংগঠক ৪. ‘পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক সচেতন সংগঠিত শক্তি সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান। অন্য কথায়, পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট হল পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গঠনকারী একটি প্রতিষ্ঠান যা একই সাথে শ্রমিকশ্রেণীকে কমিউনিস্ট পার্টিতে সংগঠিত করে সমাজতান্ত্রিক শক্তিভিত গড়ে তুলে পুঁজিবাদবিরােধী চেতনার বিকাশ ঘটাবে ও সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদকে কোণঠাসা করবে। অর্থাৎ বুর্জোয়া পার্লামেন্টে পেশাভিত্তিকতা (বিপ্লবী মর্মবস্তু/উপাদান) প্রবিষ্ট করিয়ে আন্দোলনকে বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রম করিয়ে সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদ বিরােধীও করা (এক ঢিলে বহু পাখি শিকার!) সম্ভব হবে। জাসদের তালিকায় নিচের দিকে স্থান পাওয়া কৃষি মজুররা সংখ্যায় মােট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এবং তাদের সংগঠিত করতে পারলে এখনই পার্লামেন্ট দখল করা যায়। যেমনটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট-কোয়ালিশন সরকার করেছে। এজন্য সিপিআই(এম)-কে জমির দাবিকে হটিয়ে পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টের দাবিকে অগ্রাধিকার দিতে হয়নি। উপরন্তু, পালার্মেন্টের এলাকা বা পেশাভিত্তিকতা হল রাষ্ট্রকাঠামাের একটা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক রূপের (form) প্রশ্ন, তার মর্মবস্তুর (content) পরিবর্তন নয়। তাছাড়া এ কথা সর্বজনবিদিত যে, আইন সভার দ্বিতীয় (উচ্চ) কক্ষ চূড়ান্ত বিচারে প্রথম। (নিম্ন) কক্ষের কাজে কিছু বিলম্ব ঘটাতে পারে বটে, কিন্তু বাধা দিতে পারে না; সে কক্ষ যাদের সমন্বয়ে বা যে-ভাবেই গঠিত হােক না কেন। বাংলাদেশে জিয়ার গ্রাম সরকারেও দেখা গেছে ভূমিহীন কৃষক তার নিজস্ব স্বার্থের পরিবর্তে বিত্তবানদের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য হয়। সুতরাং পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট নয়, প্রয়ােজন সমাজের শক্তির ভারসাম্য বদলে দেয়া, গ্রামীণ সর্বহারাকে ‘শ্রেণীতে রূপান্তরিত করা। আর এজন্য প্রয়ােজন তাদের জীবনের সমস্যাকেন্দ্রিক স্লোগান ও সে-স্লোগানের ভিত্তিতে তাদের সংগঠিত করার ধীরলয়ের নিরবচ্ছিন্ন কাজ।জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আসম আবদুর রব একদা পালার্মেন্টকে। “শুয়রের খােয়াড়’ আখ্যা দিয়ে এবং তিনি নিজে যে খােয়াড়ে ‘গৃহপালিত বিরােধী দলীয় নেতা হয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনকে তারা বাংলার বুকে ‘শেষ নির্বাচন ঘােষণা দিয়েছিলেন। তখন তাদের চেতনা ও কর্মের পুরােটা জুড়ে ছিল শ্রেণীসগ্রামের মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা।

আর এখনকার অবাস্তব ও বিভ্রান্তিমূলক পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টের দাবি অর্থাৎ পার্লামেন্টের বহিরঙ্গের রূপ বদলানাের দাবি প্রকৃত প্রস্তাবে ‘শ্রেণী সংগ্রাম, সমাজিক বিপ্লব, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রভৃতি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে দেশে পুঁজিবাদকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করার কৌশলের নামান্তর মাত্র।  প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, একের ভেতর বহু গুণের অধিকারী এই পেশা-ভিত্তিকতার ভিত্তিটি কী এবং এদের প্রতিনিধিত্বই বা নির্ধারিত হবে কিসের ভিত্তিতে? এ বিষয়ে সিরাজুল আলম খান তার একুশ শতকে বাঙালি’, ‘খােলা চিঠি’ প্রভৃতি পুস্তিকায় বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তিনি মনে করেন: …সম্পদ অনুসারে তাদের (জনগণের) সামাজিক বিভাজন- উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত ৩%, মধ্য-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ২২% নিম্নবিত্ত ও গরীব মানুষ ৭৫% । উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত সমাজ অর্থাৎ শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, বড় কৃষক, সমবায়ী, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাঙ্কার, বড় দোকানদার, সমাজসেবী (এনজিও), সরকারি, আধা সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি সামাজিক গােষ্ঠী পেশাজীবী হিসেবে চিহ্নিত। আর শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, ছােট কৃষক, কর্মচারী, দোকান কর্মচারী, সাধারণ সৈনিক, পুলিশ, আনসার, রিক্সাচালক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী প্রভৃতি শ্রমজীবী, কর্মজীবী হিসেবে পরিচিত। এই শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীরাই হলাে আমাদের সমাজ জীবনের নব্য সমাজশক্তি।৮১. অবাস্তব এজন্য যে, দেশে মােট পেশার সংখ্যা, প্রতিটি পেশায় পেশাজীবীর সংখ্যা, প্রতিনিধিত্বের ভিত্তি ও নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণ করা খুবই জটিল কাজ। প্রস্তাবানুযায়ী ডাক্তার-সমাজ আইন সভার উচ্চকক্ষে একটি আসন বা নারীসমাজ ষােলটি আসন পাবে। এম এ মতীন বা বদরুদ্দোজা চৌধুরী বা ফজলুল করিম বা আমানুল্লাহ প্রমুখ খ্যাতিমান ডাক্তারগণ সাংসদ মায় মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এবং অষ্টমটি ব্যতিরেকে সকল সংসদেই অন্যূন ১৫ থেকে ৩০ জন মহিলা সাংসদ এবং দু’একজন মন্ত্রী মায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (বর্তমানেও প্রধানমন্ত্রী একজন নারী)। এরা নিজ নিজ পেশা বা “সমাজের হয়ে অতিরিক্ত কী-ই বা করতে পেরেছেন? সুতরাং বুর্জোয়া সংস্কারমূলক দাবি হিসেবেও ‘পেশা ভিত্তিক অপ্রয়ােজনীয়। ফলে পৃথিবীর কোথাও এরূপ পার্লামেন্ট দেখা যায় না বা তা প্রতিষ্ঠার দাবিও লক্ষ্য করা যায় না।

সিরাজুল আলম খান, একুশ শতকে বাঙালি, এম, এন, ও, পাবলিকেসন্স (প্রা:) লিমিটেড, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ৩০তিনি আরাে মনে করেন, আমাদের দেশের পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী কাঠামাের বৈশিষ্ট্য। অনুযায়ী এখানে শ্রমজীবী-কর্মজীবীর শ্রমশক্তি ও পেশাজীবীর ‘দক্ষতা’ সমন্বয়ে উৎপাদন ইউনিট’ গড়ে উঠলেও রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় (আইন প্রণয়ন, প্রশাসন, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা) এই শ্রমশক্তি ও দক্ষতার জৈবিক একীভবন (Organic Integration) নেই। অর্থাৎ আইসভায় রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা আছে কিন্তু সামাজিক শ্রম, কর্ম ও পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব নেই। রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের বিভিন্ন অংশের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটলেও বিশেষ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। উপরন্তু নীতি প্রণয়নকারী রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্রের সাথে নীতি সঞ্চালনকারী (Transmitting agent) শ্রমজীবী-পেশাজীবীর অসঙ্গতি বা দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এসব কারণে দেশের এ যাবৎকাল চালু থাকা রাজনৈতিক, প্রশাসন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। জনজীবনে কোন গুণগত পরিবর্তন সাধন করতে পারে নি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠা জনগণের সকল অংশের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল হলেও স্বাধীনােত্তরকালে ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার বদলে ব্রিটিশ ধাচের দলীয় শাসন ভিত্তিক পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা চালু হলাে- যা কিনা শাসনতান্ত্রিকভাবে জনগণকে সরকারী দল ও বিরােধী দলে বিভক্ত করে দেয়, ফলে জাতীয় ঐক্য ভেঙ্গে পড়ে। দেশ কার্যতঃ ব্রিটিশ-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক চিন্তা-চেতনা ও ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়ে আসছে। নাম পরিবর্তন ছাড়া (এবং দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) ঔপনিবেশিক আমলের আইন বা বিধি রহিত করা হয়নি, বহাল রয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের উপযােগী শাসন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামাে গড়ে উঠে। নি। এমতাবস্থায় দিক নির্দেশনা হিসেবে জনাব খান বলেন:বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক কাঠামােকে অর্থবহ ও কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দল হতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পাশাপাশি শ্রমজীবী-পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত আইন প্রণয়নকারী সংস্থা (পার্লামেন্ট) একান্ত প্রয়ােজন।

পাঁচ বছর অন্তর রাজনৈতিক দলসমূহ ও আমলাতন্ত্রের কার্যকলাপকে অনুমােদন দান (সমর্থন বা বিরােধিতা উভয় অর্থে) করাকে গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। গণতন্ত্র হতে হবে অংশীদারিত্ব ভিত্তিক। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সমাজ শক্তিসমূহের অংশীদারিত্বের স্বীকৃতি এবং এর ভিত্তিতে গড়ে তােলা ঝাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার কাঠামােই হলাে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’। বাংলাদেশের সমাজ শক্তির বিন্যাস, সমাজের সামগ্রিক চাওয়া-পাওয়া এবং রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্রকে আইন প্রণয়ন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ওউৎপাদন কাঠামােয় প্রয়ােগ করতে হবে। উল্লেখ্য, জাসদের একদা তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান কর্তৃক ১৯৭৬ সালে গণকণ্ঠে ‘আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে’ শিরােনামে লিখিত প্রবন্ধে ‘পেশাভিত্তিকতা’,৮৩ সিরাজুল আলম খান, একুশ শতকের বাঙালি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১তথা ‘১৮ দফা কর্মসূচি’ প্রথম জ্বণাকারে প্রকাশিত হয়। পরে তা নির্দিষ্ট অবয়ব লাভ করে ১৯৮০ সালের জুন মাসে জাসদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৮৩ সালে ড. জিল্লুর রহমান খান ও সিরাজুল আলম খান যৌথভাবে এর পরিমার্জিতরূপ অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’-র তত্ত্ব উপস্থাপন করেন এবং ১৯৮৭ সালে এর প্রতিষঙ্গীরূপ (Corresponding structure) নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সরকারের রূপ (form) ও পার্লামেন্টসহ নানাবিধ প্রতিষ্ঠান/সংস্থার গঠন ও পরিচালনা সংক্রান্ত ‘চার্ট’ বা মডেল তৈরি করে। কমিটি এলাকা ভিত্তিক প্রতিনিধি ৩০০ ও শ্রম-কর্ম-পেশা, এবং মহিলা ও উপজাতীয় প্রতিনিধি ২০০ সমন্বয়ে ৫০০ আসনের এককক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদের প্রস্তাব করে। পরে ১৯৯৩ সালে এক কক্ষের পরিবর্তে দুইকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের নিম্নরূপ সংশােধিত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়:১. জাতীয় সংসদ : ‘নিম্নকক্ষ'(Lower House) এবং উচ্চকক্ষ’ (Upper House)নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। ক. নিম্নকক্ষ : ৩০০ (তিনশত) সদস্য বিশিষ্ট। রাজনৈতিক দলসমূহ কর্তৃক মনােনীত প্রাপ্তবয়স্কদের ভােট দ্বারা অঞ্চল ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে। খ. উচ্চকক্ষ : ২০০ (দুইশত) সদস্য বিশিষ্ট। (১) শ্ৰম-কর্ম-পেশায় নিয়ােজিত (শ্রমজীবী, কর্মজীবী, পেশাজীবী) ব্যক্তিদেরদ্বারা অদলীয়ভাবে নির্বাচিত সদস্য।৮৪. আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে আলােচনার জন্য পরিশিষ্ট ১৭ পড়ুন জনাব খান মনে করেন, এই প্রস্তাবের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভূমিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে।

জাতীয়তাবাদ এখানে প্রেরণার শক্তি হিসেবে কাজ করবে। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কেবল সমাজ শক্তির ভূমিকা (এম-কর্ম-পেশার ভূমিকা) বাংলাদেশের বৃহত্তর অর্থে যে কোন দেশের) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়ােজন মেটাতে পারবে না। আমাদের জাতীয়তাবাদ হাজার। বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, অভিজ্ঞতা এবং জনগণের আশা-আকাক্ষী ও সচেতন প্রয়াসে সৃষ্ট। এই জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার লক্ষো আমি বাঙালির ঐক্যের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করি। (আমরা জাতি হিসেবে বাঙালি আর নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী)। বর্তমান পৃথিবীতে (প্রবাসী ৪০ লক্ষসহ) বাঙালির সংখ্যা ২০ কোটি (২০০ মিলিয়ন)। ২০২৫ সন নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৪০ কোটি। শুধু ভাষা এবং ধর্মের গণ্ডি দিয়ে এই জাতীয়তাবাদকে সীমাবদ্ধ না রেখে, প্রতিটি বাঙালির জন্য শ্রম-কর্ম-পেশার মাত্রাকে সংযােজিত করে বাঙালিত্বের সংজ্ঞাকে নির্ধারণ করতে হবে। এর ফলে আমরা নিজেদেরকে যেমন সার্বিক উন্নতির পথে নিয়ােজিত করতে পারবাে, তেমনি অন্যদিকে বিশ্বপরিসরে যে কোন জাতির সমকক্ষ হয়ে উঠবে। আর তখনি সারা বিশ্বব্যাপী আমাদের থাকবে একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়।’ (একুশ শতকের বাঙালি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২-৩৩)। সিরাজুল আলম খানকে সমন্বয়ক এবং ড, জিল্লুর রহমান খান, অধ্যাপক আজমল আহমেদ, অধ্যাপিকা রাজিয়া আহমেদ, আমানুল্লাহ, সফিউল আলম, মােহাম্মদ শাহজাহান, আ.স.ম. আবদুর রব ও নূরে আলম জিকুকে সদস্য করে এই কমিটি গঠিত হয় সিরাজুল আলম খান, একুশ শতকে বাঙলি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৯(২) প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের দ্বারা অদলীয়ভাবে নির্বাচিত সদস্য। (৩) উপজাতীয়দের দ্বারা অদলীয়ভাবে নির্বাচিত সদস্য। (৪) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত সদস্য (মূলতঃ প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং আমলাকর্মকর্তা ও শান্তি-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীদের মধ্য থেকে)। (৫) জাতীয় নির্বাচনে প্রাপ্ত ভােট অনুযায়ী আনুপাতিক হারে রাজনৈতিকদলসমূহের মনােনীত সদস্য।

২. গ্রুপ বিভক্তি :শ্রম, কর্ম, পেশা, মহিলা এবং উপজাতিসমূহকে নিম্নোক্ত ১৩ (তেরাে) ক্যাটিগ্যারিতে (Category) ভাগ করা হলাে : (১) বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী : যথা- শিক্ষক, আইনবিদ, সাংবাদিক,শিল্পী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, প্রকাশক, চলচ্চিত্র শিল্পী-কুশলী, সংগীত শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী, ক্রীড়াবিদ ইত্যাদি। টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ যথা-বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, ডাক্তার, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, দক্ষ কারিগর, স্থপতি, পরিকল্পনাবিধ, শিল্প-ম্যানেজার, ব্যবসায়ী-এক্সিকিউটিভ, ব্যাংকবিশারদ, সমাজসেবী (এনজিও), একাউন্টেন্ট ইত্যাদি। (৩) ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প : যথা-শিল্পপতি, ব্যবসায়ী (ক্ষুদে, মাঝারি ওবৃহৎ), ফ্যাক্টরী মালিক, দোকানদার, ব্যাংকার, বীমা(বিদ) ইত্যাদি। শ্রমিক : যথা- শিল্প শ্রমিক, ফ্যাক্টরী শ্রমিক, ফ্যাক্টরী আইনের অন্তর্ভুক্ত শ্রমিক-কর্মচারী, যানবাহন (রিক্সাসহ) শ্রমিক, সরকারি, আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সেক্টরের শ্রমিক ইত্যাদি। কৃষি শ্রমিক : যথা- ক্ষেতমজুর, দিনমজুর ও গ্রামীণ এলাকার সকল ধরনের মজুর ইত্যাদি। সমবায়ী কৃষক ; যথা- ধনী, মাঝারী ও ছােট কৃষক যারা সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত। ক্যাডার সার্ভিস যথা- সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা। প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনী যথা- সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বি.ডি.আর, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, সহযােগী বাহিনী ইত্যাদি। কর্মচারী ; যথা- সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সেক্টরের অধীন সকল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। মহিলা : যথা- ১৮ বৎসরের অধিক বয়সী মহিলা। সমাজের অনগ্রসর অংশ : যথা- তাঁতী, জেলে, ধােপা, নাপিত, মুচি,কামার, কুমার, মেথর, বেদে ইত্যাদি। (১২) উপজাতি : যথা- চাকমা, মারমা, তনচুংগা, মুরং, লুসাই, বােম, টি,মগ, গারাে, সাঁওতাল, হাজং, কুকি, খাসিয়া ইত্যাদি।(১০) (১১)(১৩) অন্যান্য যারাই কোন না কোন জাতীয় উন্নয়নমূলক কাজেনিয়ােজিত-সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ৩. ভােট পদ্ধতি এক ব্যক্তি-দুই ভােট। এক ভোেট অঞ্চলভিত্তিক এবং দ্বিতীয়ভােট এম-কর্ম-পেশা ভিত্তিক। ৪. প্রত্যাহার পদ্ধতি (Re-Call System) ১৫% ভােটার দ্বারা যে কোননির্বাচিত ব্যক্তির সদস্যপদ প্রত্যাহারের জন্য স্পীকারের নিকট আবেদন করা যাবে। উদ্যোগ গ্রহণ (Initiative) ৫% ভােটার দ্বারা যে কোন আইন প্রণয়ন অথবা বাতিল করার জন্য স্পীকারের নিকট লিখিতভাবে আবেদন করার ব্যবস্থা থাকবে। জাতীয় সংসদ সে আবেদন বিবেচনা করতে বাধ্য থাকবে। নির্বাচন অনুষ্ঠান সকল পর্যায়ের নির্বাচন ঘােষণা এবং অনুষ্ঠানের সর্বময় ক্ষমতা থাকবে নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হবে।দেখা যাচ্ছে, ৮৬ ধরনের” শ্ৰম-কর্ম-পেশার লােককে ১২/১৩টি দলে’ বিন্যাস করে আইনসভার প্রস্তাবিত দ্বিতীয় (উচ্চ) কক্ষে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোন দলে ১৪, কোন দলে ৩, আবার কোন দলে মাত্র ১ ধরনের লােক রয়েছে। এদের প্রতিনিধিত্বের হার কী হবে তা বলা হয়নি।

প্রতিনিধিত্বের হার সমান হলে, প্রতিটি দলে ১৬ জন (২০০ + ১২=১৬.৬৭) প্রতিনিধি পাওয়া যায়। তাহলে ২ নং দলের বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, ডাক্তার, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, দক্ষ কারিগর, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, শিল্প-ম্যানেজার, ব্যবসায়ী-এক্সিকিউটিভ, ব্যাংকবিশারদ, সমাজসেবী (এনজিও), একাউনটেন্ট প্রভৃতি সকলে বা ১২ নং দলের ১৩ উপজাতি পাবে ১৬ জনবাংলাদেশের শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী প্রভৃতির পরিসংখ্যান নিম্নরূপ ডাক্তার-৩০,০০০; ইঞ্জিনিয়ার-৩০,০০০; ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার-৫০,০০০; শিক্ষক-৫,০০,০০০; সাংবাদিক-২,০০০ সংস্কৃতিসেবী-১০,০০০; কৃষিবিদ-১০,০০০; ডিপ্লোমা কৃষিবিদ-৫০,০০০; ব্যাংক কর্মকর্তাকর্মচারী-৩০,০০০; আইনবিদ-৪০,০০০; ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-১০,০০০; দোকান মালিক১,৫০,০০০; দোকান-কর্মচারী-৩,৫০,০০০; সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী-১৫,০০,০০০; বিভিন্ন প্রকার বিশেষজ্ঞ-৭,০০০; প্রতিরক্ষা বিভাগ-১,০০০০০; পুলিশ-১,০০,০০; আনসার। প্যারামিলিটারি-৫,০০,০০০; ক্রীড়াবিদ-২০,০০০; প্যারামেডিকস১,০০,০০০; উপজাতি-৭,০০,০০০; সমবায়ী কৃষক-১০,০০,০০০; কৃষি শ্রমিক-১,৫০,০০,০০০; শিল্প-শ্রমিক-৬০,০০,০০০; রিক্সাচালক-৫,০০,০০০; দিনমজুর-১,০০,০০০; তাঁতী-জেলে প্রভৃতি১০,০০,০০০; কৃষক (সমবায়ভুক্ত নয়)-১,৫০,০০,০০০; গ্যারেজ, লেপ, মেসিন, ওয়ার্কশপ প্রভৃতি-৫,০০,০০০; অন্যান্য ক্ষুদ্র কর্মে জড়িত-২০,০০,০০০; (প্রবাসী বাঙালি-৫০,০০,০০০; জনসংখ্যা- ১৩ কোটি, ভােটার-৬ কোটি, নারী-পুরুষ অনুপাত ৫০: ৫০) সিরাজুল আলম খান, খােলা চিঠি (পুস্তিকা), এম, এন, ও.পাবলিকেসন্স, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ১৩ যদিও শ্রম-কর্ম-পেশাওয়ারী লােকসংখ্যা বিভাজনে মাত্র ২৯টি ধরন উল্লেখ করা হয়েছে (৮৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য)(পেশার প্রতি “ধরনে’ ১ জন) প্রতিনিধি, তেমনি ৭ নং দলের সরকারি; আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১ম ও ২য় শ্রেণীর ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা ১৬ জন; ১০ নং দলের মহিলারা (মােট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক) ১৬ জন এবং ৫ নং দলের কৃষিশ্রমিকরা (সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ) ১৬ জন প্রতিনিধি পাবে। এই হিসেবে ১ নং দলের প্রতিটি পেশার প্রাপ্য ধরা যাক ১ জন (১৬.৬৭°১২ = ১.৩৯) ।

তা হলে ৫০ হাজার শিক্ষক বা ২ হাজার সাংবাদিক বা ৫ শত (অনুমান) প্রকাশক সবাই ১ জন প্রতিনিধি পাবে। অর্থাৎ ৯ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫ শত কৃষি শ্রমিকের জন্য যেখানে ১ জন, সেখানে ২ হাজার সাংবাদিকের (বা ৫ শত প্রকাশকের) জন্যও ১ জন প্রতিনিধি। অন্য কথায়, ১ জন সাংবাদিক ও ৪৬,৮৭৫ জন কৃষিশ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব সমান। প্রতিনিধিত্বের এরূপ হার সুষম বা গণতন্ত্রসম্মত কী না এবং এ-দ্বারা জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ নয় কী?”লক্ষণীয়, প্রস্তাবিত শ্ৰম-কর্ম-পেশায় নিয়ােজিত ব্যক্তিবর্গের প্রায় সকলই নিজ নিজ পেশাগত সংগঠনে পূর্ব থেকেই সংগঠিত। কোন কোন পেশায় একাধিক সংগঠনও রয়েছে। ডাক্তারদের বিএমএ, ইঞ্জিনিয়ারদের ইআইবি, শিক্ষকদের ‘সমিতি’ ব্যবসায়ীশিল্পপতিদের এফবিসিসিআই, আমলাদের ‘এসােসিয়েশন’ শ্রমিক-কৃষকদের ‘গণসংগঠনসমূহ এক্ষেত্রে খুবই সুপরিচিত। সব সংগঠন নিজ নিজ পেশার স্বার্থসংরক্ষণার্থে সুদূর অতীতকাল থেকে কাজ করে আসছে এবং তারা নিজেরাও এরূপ অংশীদারিত্বের দাবি উত্থাপন করে নি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে, “বিপ্লবী মর্মবস্তু’ প্রবিষ্ট বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রমকারী’ সমাজতান্তিক শক্তিভিত গড়ে তােলার কার্যকরি কাঠামাে ‘পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টকে একই সাথে শ্রমিক-কৃষক ও শিল্পপতিব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বের ‘সােনার পাথর বাটি’ বানানাের চিন্তা করা হয়েছে। বরং বলা সমীচীন হবে যে, পেশাভিত্তিকতার নামে শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষককুলের স্বার্থ বিরােধী পুঁজিবাদী ও সুবিধাভােগীদের স্বার্থই প্রকারান্তরে রক্ষার চিন্তা করা হয়েছে।৮৮ জনাব খান প্রস্তাবিত শ্ৰম-কর্ম-পেশার প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদের রূপরেখার জন্য পরিশিষ্ট ২০

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান