You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ মুজিব-হত্যা- বাংলাদেশের সব গােয়েন্দা সংস্থা হয় বে-খবর ছিল না-হয় তা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিল - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিব-হত্যা প্রতিরােধ প্রচেষ্টা ও প্রতিবাদকোনাে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে নিবৃত্তিমূলক হামলা করার প্রস্তুতির জন্য প্রয়ােজন দু’ঘণ্টা সময় আর আগাম গােয়েন্দা-খবর। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর বিদ্রোহ সম্পর্কে বাংলাদেশের সব গােয়েন্দা সংস্থা হয় বে-খবর ছিল, না-হয় তা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিল। সামরিক গােয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক (ডিএমআই) লে. কর্নেল (অব.) সালাহউদ্দিনের বরাতে কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল জানাচ্ছেন, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এই বিদ্রোহ সম্পর্কে রাত প্রায় সাড়ে ৪টায় অবহিত হন এবং সেনানিবাসে অবস্থানরত প্রায় সকল ইউনিট কমান্ডারদের সাথে যােগাযােগ করেন। শাফায়াতের সাথে যােগাযােগ হয় সকাল প্রায় ৬টায়। সময় ও অবস্থানের বিচারে তখন তারা অভ্যুত্থানকারীদের তুলনায় দেড় ঘণ্টা পেছনে। বিস্ময়ের।১. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস গােয়েন্দা বিভাগের জনৈক কর্মকর্তার বরাতে জানাচ্ছেন, আগস্টের প্রারম্বে গােয়েন্দাবিভাগ মুজিবকে উৎখাতের কমপক্ষে পাঁচটি সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের তদন্ত চালাচ্ছিল। তরুণ। সেনা-অফিসারদের অসন্তোষ ছিল ঐ হিসেবের অতিরিক্ত। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৬০)। হত্যা মামলার ৪২ তম সাক্ষী মেজর জিয়াউদ্দিন জানান, বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাতের জন্য ফারুকরশিদ-ডালিম-নুরচক্র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একথা ১৫ আগস্টের ৮/১০ দিন আগেই ডিজিএফআই লিখিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছিল। কিন্তু অজ্ঞাতকারণে ওদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি (ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৫)। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, (১৫ আগস্টের) এই বিরাট সমরসজ্জা সেনা-সদরের ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স। ইউনিটের মাত্র তিনশাে গজের মধ্যেই সম্পন্ন হচ্ছিল। অথচ, ঐ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দিন-রাত সতর্ক দৃষ্টি রাখার কথা। ১৪ আগস্ট দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বােমা বিস্ফোরণের পরও এদের চৈতন্যোদয় হয়নি। কর্নেল শাফায়াত জামিল জানাচ্ছেন, ১৫ আগস্টের আগে বিভিন্ন সময়ে সেনা-সদরে অনুষ্ঠিত যেসব বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন তার কোনােটিতেই এ ধরনের কোনাে ঘটনা ঘটার আশঙ্কা। প্রকাশ বা সতর্কীকরণ করা হয়নি। উপরন্তু, ঘটনার মাস-দুয়েক আগে তার ব্রিগেডের একমাত্র । গােয়েন্দা ইউনিটটিকে অজ্ঞাত কারণে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। যদিও অন্যান্য সকল ব্রিগেডের। গােয়েন্দা ইউনিট বহাল ছিল [একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়য়ন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১৯]২.

কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১৮বাংলাদেশের রাজনীতি – ১০ব্যাপার যে, সেনাপ্রধান কাউকে প্রতিরােধ-উদ্যোগ নেয়ার জন্য পরামর্শ বা নির্দেশ দেননি। বিদ্রোহের খবর পাওয়ার সাথে সাথে (হত্যাকাণ্ডের দেড় ঘণ্টা আগে রাত সাড়ে চারটায়) নিবৃত্তিমূলক হামলার তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেয়া হলে এ হত্যাকাণ্ড প্রতিরােধ করা সম্ভব ছিল। সেনাপ্রধান তা না করে কেন মহামূল্যবান দেড় ঘণ্টা সময় শুধু যােগাযােগের নামে অপচয় করলেন তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক। এটা তার কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা বা ভীত হওয়ার কারণে হলে বলতে হবে অযােগ্য লােককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানাের প্রতিফল মুজিব পেলেন তার প্রাণের দামে। আর ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে কোনােরূপ যােগসাজশ বা আপসের কারণে তা হয়ে থাকলেও একই ফলাফলই প্রাপ্য ছিল। মুজিবের ধানমণ্ডির বাড়ি ও গণভবনের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ছিল ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের ওপর। কিন্তু পঁচাত্তরের জুলাইয়ের শেষদিকে সেনা-সদর তা পরিবর্তন করে কুমিল্লা ব্রিগেডের ওপর ন্যস্ত করে। সে-মতে কুমিল্লা থেকে ১ম ফিল্ড আর্টিলারির একটি ব্যাটারি/কোম্পানি এনে ঐ গার্ড ডিউটিতে নিয়ােগ করা হয়। মেজর ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর বজলুল হুদা, সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ারদার বিন্নি সময়ে ঐ আর্টিলারির অফিসার ছিলেন। বিধি অনুযায়ী নিরাপত্তা সেনাদলটির প্রশাসনিক দায়িত্ব ঢাকার স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) হামিদের ওপর এবং সার্বিক দায়িত্ব লগ এরিয়া কমান্ডার ও সেনাপ্রধানের উপর থাকার কথা। মুজিবের বাসভবন আক্রমন করার সময় এই সেনাদলটিকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। ভাের সাড়ে চারটায় মুজিবের বাসভবনের নিরাপত্তায় নিয়ােজিত সেনাদলকে অগ্রসরমান হত্যাকারীদের প্রতিরােধ করার নির্দেশ দেয়া হলে তারা প্রতিরােধ করত এবং বিদ্রোহীদের দ্বারা এটা একটা সামরিক অভ্যুত্থান, পুরাে সামরিকবাহিনী এর পেছনে রয়েছে’ -রক্ষীদের এ-কথা বােঝানাে সক্ষম হত না। অন্তত এ নিয়ে উভয় দলের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিত। সে-সুযযাগে নিবৃত্তকারী দল হামলাকারীদের রুখে দিতে পারত। মুজিব হত্যা মামলার ৪র্থ সাক্ষী মুজিবের বাসভবনে নিয়ােজিত নিরাপত্তাবাহিনীর কমান্ডার হাবিলদার কুদুস সিকদার জেরাকালে জানান :হত্যকাণ্ডের সময় গােলাগুলির শব্দ শুনে আশপাশ থেকে অনেক লােক বঙ্গবন্ধুর৩. হত্যা মামলার ৪৫ তম সাক্ষী হিসেবে শফিউল্লাহকে জেরাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘সময় পেলে ১৫ আগস্টের ঘাতকদের কোর্ট মার্শালের আদেশ দিতাম।

কিন্তু তা হয়নি। কারণ তার আগেই (২৪ আগস্ট ১৯৭৫) মােশতাক আমাকে সরিয়ে জিয়াকে করে সেনাপ্রধান”. ড. মােহাম্মদ হাননান বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৫৭]। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি প্রতিরােধ ও কোর্ট মার্শাল উভয়ের জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই করেন নি এবং সেনাপ্রধানের চাকরি হারালেও রাষ্ট্রদূত হয়ে তা পুষিয়ে নিয়েছেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও যড়য়ত্রময় নভেম্বর, পূর্বােক্ত, পৃষ্ঠা ১১৯ মুজিব-হত্যা মামলার বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট ১৯ পড়ুনবাড়ির দিকে ছুটে এসেছিল। কিন্তু তাদের কাউকেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ঘাতক আর্মির দল তাদের তাড়িয়ে দেয়।নিরাপত্তাবাহিনী ও আক্রমণকারীদের মধ্যে কোনাে বিরােধ দেখা দিলে সে-সুযােগে জনগণই বিদ্রোহীদের প্রতিরােধ করার সুযােগ পেত। মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন কুমিল্লা ব্রিগেডকে দেয়া হল এবং কেন তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হল তার উত্তর হত্যার ষড়যন্ত্র উদঘাটনের জন্য প্রয়ােজন। জাতির দুর্ভাগ্য যে, সেনাপ্রধান সেদিন প্রতিরােধের কোনাে চেষ্টা তাে করেনইনি উপরুন্ত নৌ ও বিমান প্রধান সহযােগে বরখাস্তকৃত ডালিম ঘঘাষিত সামরিক শাসন সমর্থন ও অবৈধ মােশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে অন্যদের প্রতিরােধ-চিন্তায় পানি ঢেলে দেন।১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে দুটি ইউনিটের বাছাই করা সৈনিকদের নাইট ট্রেনিং’ -এর ‘ব্রিফিং’-এ ‘সরকার উৎখাতের যে ঘােষণা দেয়া হয়, তা ছিল ‘অস্পষ্ট।’ বালুর ঘাট মাঠ থেকে কোথায় যাওয়া হচ্ছে তা সৈনিকদের বুঝতে দেয়া হয়নি। হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরই কেবল সৈনিকরা বুঝতে পারে যে, ‘অফিসাররা তাদের ‘ধোকা দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে এনে এই ঘৃণ্যকাণ্ড ঘটিয়েছে। মুজিবের বাসার সেনা-নিরাপত্তাবাহিনী ভীত বা প্রভাবিত হয়ে ঘাতকদের প্রতিরােধ করতে ব্যর্থ হয় বা বাধাদানে বিরত থাকে। নিরাপত্তায় নিয়ােজিত পুলিশের ডিএসপি ৫০তম সাক্ষী নূরুল ইসলাম খান বলেন :ঘাতকদের আক্রমণের মুখে পুলিশকে তিনি পাল্টা গুলি চালানাের নির্দেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু ঘাতকদের গুলিতে নিজে আহত হওয়ায় আর কিছুই করতে পারিনি।’মুজিবের ফোন পেয়ে সামরিক গােয়েন্দাবিভাগের ডাইরেক্টর কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ এক-মুহূর্তও দেরি না করে পাজামা-গাউন পরিহিত অবস্থায় তার গাড়িতে চড়ে (মতান্তরে ট্রাকভর্তি সৈন্য নিয়ে) প্রতিরােধে এগিয়ে আসেন। বাড়িতে ঢুকতে বাধা পেয়ে কড়া বাক্য বিনিময় করে গেটের বাইরে গাড়ি থেকে নেমে সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢােকার মুখে বুকে ও মাথায় গুলি খেয়ে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়েন (মতান্তরে সােবহানবাগে গাড়িতে বসা থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন)।

তিনিই একমাত্র বীর সামরিক কর্মকর্তা, যিনি নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে কর্তব্য পালনে এগিয়ে এসে বিরল নজির স্থাপন করেন।  ১৫ আগস্ট ভােরে প্রধানমন্ত্রী (একই সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) মনসুর আলীর ফোন পেয়ে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান রেডিও স্টেশন দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ট্রুপস রেডি করার নির্দেশ দেন। তখনও তিনি জানতেন না যে, সপরিবারে মুজিব নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার৬ . ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৭। ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮কিউ, জি, দস্তগীর মােশতাক সরকারকে না মানার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনাে কোনাে আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রতিবাদ মিছিল বের করার পরামর্শ দেন ও বেতার কেন্দ্র থেকে ঘােষণা প্রচারের উদ্যোগ নেন। কিন্তু চট্টগ্রামের ভীতু আওয়ামী লীগ নেতারা। মিছিল বের করা থেকে নিবৃত্ত থাকেন। | সকাল ৬টায় দরজা ধাক্কিয়ে, ঘুম ভাঙিয়ে মেজর রশিদ (পরে লে. কর্নেল অব.) কর্নেল শাফায়াত জামিলকে মুজিবহত্যার সর্বনাশা বার্তাটি দেয়। একই সাথে মােশতাকের নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার কথা জানিয়ে এর বিরুদ্ধে কোনাে এ্যাকশনে গিয়ে গৃহযুদ্ধের উসকানি না দেয়ার জন্য হুশিয়ারি দেয়। রশিদের কথা শেষ না হতেই বেজে ওঠে শফিউল্লাহর ফোন। বিদ্রোহে শফিউল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত না হতে পারলেও বিদ্রোহীদের মােকাবেলা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে শাফায়াত তার ব্রিগেডের তিনজন ব্যাটেলিয়ন কমান্ডারকে ফোন করে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে বলে দ্রুত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। পথিমধ্যে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সামনের মমাড়ে একটি ট্যাঙ্কের উপর মেশিনগান নিয়ে বীরের ভাব করে বসা মেজর (পরে লে, কর্নেল অব.) ফারুককে দেখতে পান। অবস্থাদৃষ্টে নিরস্ত্র অবস্থায় অরক্ষিত হেডকোয়ার্টারে যাওয়া নিরাপদ নয় ভেবে সংলগ্ন পদাতিক ব্যাটালিয়ন দুটোর (১ম ও ৪র্থ বেঙ্গল) প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি ইউনিট লাইনে চলে যান। সেখানে গিয়ে ব্যাটালিয়ন দুটোর মাঝখানে ৩টি ও ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সামনে ফারুকেরটি ছাড়াও আরও ১টি ট্যাঙ্ক দেখতে পান এবং শুনতে পান যে, মিরপুরে ফিল্ড রেজিমেন্টের আর্টিলারি গানগুলােও তৈরি রয়েছে। যাহােক, ফোনে প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী ১ম ও ৪র্থ বেঙ্গলের সদস্যরা অপারেশনের জন্য তৈরি হতে থাকে।

সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ” ইউনিট লাইনে ১ম বেঙ্গলের অফিসে এসে সেনাপ্রধানের বরাতে সমস্ত অপারেশন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অর্থাৎ সেনাপ্রধানের নির্দেশে সিজিএস ৪৬ ব্রিগেডের শাফায়াতের কমান্ড অধিগ্রহণ করেন। তবে বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি এরই মধ্যে প্রায় সম্পন্ন হয়ে দিয়েছিল। শাফায়াতের ভাষায় :আমি আশা করছিলাম, বিমানবাহিনীর সহায়তায় সেনা-সদরের তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনে একটি সমন্বিত আন্তঃবাহিনী পরিচালনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ৮. কর্ণেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩২ কর্নেল শাফায়াতের অধীনস্থ আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর রশিদ বিদ্রোহের মাসখানেক আগে ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসলে তাকে যশােরে পােস্টিং দেয়া হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরই তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। জনশ্রুতি হল, কর্নেল শাফায়াতের অনুরােধে তা করা হয়। কিন্তু শাফায়াতের মতে, এ ধরনের পােস্টিং সেনাপ্রধানের একান্তই নিজস্ব দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি বিদ্রোহী ফারুকের মামা বলে শােনা যায়। ট্যাঙ্কবাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক সেনাদল এককভাবে কখনােই আক্রমণযুদ্ধ পরিচালনা করে না। পদাতিক সেনাদলের সহায়কশক্তি হিসেবে বিমান অথবা ট্যাঙ্কবাহিনীর সহায়তা প্রয়ােজন।” সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটায় ১ম বেঙ্গলের অফিসের সামনে একটি কনভয় এসে থামে। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ও উপপ্রধান জিয়া নেমে আসেন গাড়ি থেকে। পেছনে সশস্ত্র ডালিম ও কয়েকজন সৈন্য। সামান্য পরেই এসে পৌছান বিমানপ্রধান আব্দুল করিম খন্দকার ও নৌপ্রধান মােশাররফ হােসেন খান। মিনিট-দশেক অবস্থানের পর তারা সবাই চলে যান রেডিও স্টেশনের উদ্দেশ্যে। দুঃখের বিষয় যে, তিন বাহিনীর প্রধান একাধিকবার একত্র হওয়ার পরও সেনাপ্রধানের উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনের কোনাে যৌথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নি।  অনুমান সকাল সাড়ে ৯টার দিকে খালেদ মােশাররফ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে। ফিরে শাফায়াত জামিলের অফিসে বসে সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেতারে সশস্ত্রবাহিনীর প্রধানগণ ‘অবৈধ ও খুনী সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ও আনুগত্য প্রকাশ করায় বিদ্রোহ দমনের সকল প্রস্তুতি’ অকার্যকর হয়ে পড়ে।

এরপর বিদ্রোহের সাফল্যকে সংহত করা’ ও ‘সরকারের অবস্থানকে নিরঙ্কুশ করার জন্য বঙ্গভবন থেকে আদিষ্ট হয়ে খালেদ মােশাররফ দিনভর একের-পর-এক নির্দেশ জারি এবং নাজুক এলাকা ও স্থাপনায় সেনা মােতায়েন করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু যেহেতু ইতােমধ্যে নিহত হয়েছেন, সেহেতু গৃহযুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের আশঙ্কায় কোনাে পদক্ষেপ নেয়া সমীচীন হবে না’ বিবেচনা থেকে খালেদ মােশাররফ ফোনে রক্ষীবাহিনীকে কোনােরকম আক্রমণাত্মক ভূমিকা না নেয়ার পরামর্শ দেন। সর্বত্র যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন বাতাসের উল্টোদিকে যাওয়া ঠিক হবে না-এমন ধারণা বিস্তার লাভ করে। গুটিকয় মেজরের কৃত পাপ সমগ্র সামরিকবাহিনীকে কলুষিত করে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ সাধারণভাবে বলা হয়, মুজিবহত্যার কোনাে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি। কথাটির। সত্যাসত্য বিচার প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে ১৫ আগস্ট ভােরবেলা মুজিব-হত্যা, মােশতাক কর্তৃক ক্ষমতা দখল, সামরিক শাসন ও সান্ধ্য-আইনের ঘােষণা একই সাথে । বেতারে প্রচার করা হয়। সর্বনাশা এই ঘােষণা শুনে একে তাে মানুষ বিহ্বল, অধিকন্তু সান্ধ্য আইন জারি করে মানুষকে ঘরে আটক থাকতে বাধ্য করা হয়। এতদাঞ্চলে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ -এর আগে-পরে বেশ ক’বার সামরিক শাসন জারি । হয়েছে। কিন্তু কখনােই তা তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি। বরং কখনাে কখনাে।১১.  কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৫ এ এল খতিবের ভাষায়, কিছু সংখ্যক মানুষ সেদিন ছিল খুশিতে আত্নহারা, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ তখন সব হারানাের বেদনায় মূক (কারা মুজিবের হত্যাকারী, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৮) মানুষ উল্লসিত হয়ে স্বাগত জানিয়েছে। পাকিস্তানি আমলে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রথম সামরিক শাসন জারি হয়। নির্দেশ শুনেই মানুষ স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে নিজের আশেপাশের ময়লা-আবর্জনা, ঝােপ-জঙ্গল পরিষ্কারে মনযােগী হয়ে উঠে। কয়েকদিনের মধ্যে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আইয়ুব খান ঢাকা সফরে এলে ‘সর্বস্তরে তিনি প্রাণঢালা সংবর্ধনা লাভ করেন।এরশাদ ২৪ মার্চ ১৯৮২ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। সেদিনও বাংলাদেশে সামরিক শাসনবিরােধী কোনাে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়নি।” পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশে বহু আন্দোলনে বহু নিবেদিতপ্রাণ নেতাকমী বহুভাবে আত্মােৎসর্গ করলেও সামরিক শাসন এবং সান্ধ্য আইন জারিকালে ট্যাঙ্ক-মেশিনগানের গুলি চ্যালেঞ্চ করে রাজধানীতে তাৎক্ষণিক কোনাে প্রতিবাদ কোনােকালেই হয়নি।

তবে ১৯৫৮ সালের ময়মনসিংহের মতাে ১৯৭৫ সালেও বরগুনা ও কিশােরগঞ্জে স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে। দুর্জয় বরগুনা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকাল সাড়ে ৭টায় বেতারে ডালিমের সর্বনাশা ঘােষণা শুনে ‘হত্যাকাণ্ড ও সংবিধান লঙ্নের বিরুদ্ধে বরগুনা মহকুমা প্রশাসক সিরাজ উদদীন। আহমেদ ‘বাকশাল ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এবং রক্ষীবাহিনী ও বঙ্গবন্ধুর অনুগত সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরােধ শুরু করেন। তিনি ও তার সহগামী ছাত্রলীগ ও বাকশালের কর্মীরা সশস্ত্র হয়ে জিপে চড়ে প্রতিবাদকারীদের সংগঠিত করেন। পুলিশের ভূমিকা সন্তোষজনক না হওয়ায় তাদের থানা থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। সেদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং খুনী সরকারের পক্ষে সকল১০. এর উল্লেখযােগ্য ব্যতিক্রম ছিল ময়মনসিংহ। ছাত্রনেতা (পরে ন্যাপনেতা) কাজী আব্দুল বারী (মাসুক মিয়া)-র নেতৃত্বে শহরে তাৎক্ষণিক সামরিক শাসনবিরােধী প্রতিবাদ-মিছিল বের হয়। পরে ১৯৫৯ সালে আত্মগােপনাবস্থায় তিনি ধৃত হয়ে সামরিক আদালতে এই অপরাধে বেদণ্ড ভােগ। করেন। এমন নিষ্ঠুরভাবে বেত্রাদেশ কার্যকর করা হয় যে, তিনি বাকি সারাজীবনের জন্য বধির হয়ে পড়েন এবং অন্যান্য রােগে আক্রান্ত হয়ে অশেষ যন্ত্রণা ভােগ করেন। আজীবন সংগ্রামী এই বীর ১৯৩৭ সালে কিশােরগঞ্জের অষ্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রামে এক সামরিক বিদ্রোহে জিয়া নিহত হন। বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল। করতে সক্ষম হয়নি। এরপরও জিয়া হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৩০ বা ৩১ মে কোনাে মিছিল হয়নি। তবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় এবং বিদ্রোহের প্রধান ও অন্যান্য নেতার হত্যার পর ১ জুন জিয়ার লাশ (‘কবর’ থেকে উত্তোলিত একটি শাদা বিছানার চাদরে মােড়া তিনটির একটি) ঢাকায় নিয়ে আসার পর অনুষ্ঠিত জানাজায় প্রচুর লােক উপস্থিত হন। নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হলেও মহকুমাসমূহকে তখনও প্রশাসনিকভাবে জেলা করা হয়নি। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ এগুলােকে জেলা করার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ‘গভর্নরদের কার্যক্রম শুরু করার কথা ছিল। পরে জিয়া মহকুমাসমূহকে জেলার মর্যাদা দান করেন। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রন্থের প্রণেতা, বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যপ্রকার মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। ১৫ থেকে ১৭ আগস্ট ৩ দিন বরগুনার সকল দপ্তরের কাজ বন্ধ রাখা হয়।

১৫ ও ১৬ আগস্ট মহকুমা প্রশাসকের সরকারি বাসভবনে প্রতিবাদ ও শােকসভা অনুষ্ঠিত হয়। পটুয়াখালী জেলা-সদরে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর লিডারের মাধ্যমে ও অন্যান্যভাবে ঢাকায় যােগাযােগ করে কোনাে পথ-নির্দেশ না পাওয়ায় ও অবৈধ সরকার নিজেকে সংহত করতে সক্ষম হওয়ায় তিনদিন পর প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে। মহকুমা প্রশাসক সিরাজ উদদীন আহমেদ আত্মগােপন করেন। এ জন্য তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয় এবং পটুয়াখালী জেলায় তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। একই সাথে তার পরিবারকে সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও সেদিন যারা সিরাজ উদদীন আহমেদের সাথে প্রতিরােধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হলেন : ১. সিদ্দিকুর রহমান, যুবনেতা, পরে ১৯৭৯ সালে সাংসদ, পরলােকগমন ২৯জুন ১৯৮৬। ২. জাহাঙ্গীর কবীর, ছাত্রলীগের তৎকালীন বরগুনা জেলা সভাপতি। ৩. আবদুর রশীদ, তকালীন ছাত্রলীগ সম্পাদক। ৪. সুলতান উদ্দিন আহমেদ, তৎকালীন ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি, পরে।এ্যাডভােকেট, পরলােকগত। ৫. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, ছাত্রনেতা পরে সাংসদ ও উপমন্ত্রি। ৬. দেলওয়ার হােসেন। ৭. আবদুল মােতালেব। ৮, এ্যাডভােকেট নূরুল ইসলাম সিকদার, আওয়ামী লীগ সম্পাদক। ৯. এ্যাডভােকেট নিজামউদ্দিন আহমেদ, পরে সাংসদ (১৯৮৬), ঢাকায় সড়কদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ ৯ ডিসেম্বর ১৯৯০। ১০. ইউনুস শরীফ। ১১. অধ্যক্ষ শামসুল আলম, বরগুনা কলেজ। ১২. আবদুল লতিফ ফরাজী। ১৩. আবদুল মান্নান। ১৪. ফররুক আহমেদ, তৎকালীন মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা। ১৫. মাহমুদুর রহমান, তকালীন জনসংযােগ কর্মকর্তা। ১৬. আলী আসগর, তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার। ১৭. মােখলেসুর রহমান, তৎকালীন সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)। ১৮, বিপ্লব কুমার শর্মা, তৎকালীন মহকুমা ত্রাণ কর্মকর্তা। ১৯, আসমত আলী সিকদার, তকালীন স্থানীয় সাংসদ। ২০. সাংসদ শাহজাদা আব্দুল মালেক খান ও অন্যান্য।শাহজাদা আবদুল মালেক খান ছিলেন রাষ্ট্রপতি মােশতাকের ভায়রা-ভাই। তিনি মােশতাকের মন্ত্রী করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে যােগ দিয়ে বিরল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

৩ নভেম্বর ১৯৭৫ খালেদ-শাফায়াতের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে বরগুনার অকুতােভয় নেতৃবৃন্দ পুনঃসংগঠিত হন। জেলহত্যার প্রতিবাদে বাবু জ্ঞানরঞ্জন ঘােষের বাসায় গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিরাজ উদদীন আহমেদ, এ্যাডভােকেট নূরুল ইসলাম সিকদার, এ্যাডভােকেট জয়নাল আবেদীন (বাকশালে বিলুপ্ত ন্যাপ সম্পাদক), অধ্যক্ষ শামসুল আলম প্রমুখ। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলহত্যার প্রতিবাদে বরগুনায় ৬ নভেম্বর পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ৭ নভেম্বর সফল সেনা-বিদ্রোহের পর বরগুনায় নেমে আসে সরকারি নির্যাতন। সিদ্দিকুর রহমান, ইউনুস শরীফ, এ্যাডভােকেট নূরুল ইসলাম সিকদার, নূরুল ইসলাম পাশা, আবদুল মান্নান (বেতাগী), জাহাঙ্গীর কবীর, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, আব্দুর রশীদ, মােতালেব প্রমুখসহ আগস্টের শােকসভায় যােগদানকারী সকলকে গ্রেফতার করা হয়। সিরাজ উদদীন আহমেদ বরগুনা ত্যাগ করে বরিশালে আশ্রয় নেন। পরে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে এঁদের কেউ কেউ ঢাকায় মিলিত হয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। সাংসদ নিজাম উদ্দিন আহমদের মামা আলহাজ জয়নাল আবেদীনের ইস্কাটন গার্ডেনস্থ বাসায় অনুষ্ঠিত এক গােপন সভায় ভারতের সহায়তায় সরকার উৎখাতের কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সে-মতে চট্টগ্রামের সাংসদ নূরুল আলম ও আমতলীর সাংসদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ কলকাতায় অবস্থানরত যশােরের সাংসদ রওশন আলীর সাথে প্রথম দফায় সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় দফায় বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন সাংসদ ও সিরাজ উদদীন আহমেদের কলকাতা যাওয়ার কথা হয়। ইতােমধ্যে কমবেশি ৪০ জন সাংসদের সাথে যােগাযােগ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাংসদদ্বয় নুরুল আলম ও নিজাম উদ্দিন আহমেদ কলকাতা যাওয়ার পথে যশােরে গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় এ পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। গ্রেফতারকৃত সাংসদদ্বয়কে দীর্ঘদিন পর যশাের থেকে ঢাকা জেলে স্থানান্তর করা হয়। নিজাম উদ্দিন আহমেদসহ বরগুনার গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীগণ প্রায় দু-বছর পর জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। বিসিএস (প্রশাসন) কর্মকর্তা হওয়ার জন্য বা যে-কোনাে কারণেই হােক সিরাজ উদদীন আহমেদ শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তবে তার বিরুদ্ধে সামরিক সরকার একাধিক মামলা দায়ের করে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ‘প্রকাশ্যে রিভলভার উঁচিয়ে জনগণকে তিনি ভয় দেখিয়েছেন’-এই অভিযােগ প্রমাণের জন্য পুলিশ বহুভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

কারণ বরগুনার ৭ লক্ষ বীর-জনতার একজনও তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি। সবশেষে সরকার তাকে ক্ষমা চাইতে বলার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে গর্বিত, আমি ক্ষমা চাইতে পারি না।’ অবশেষে অভিযােগ থেকে অব্যাহতি পেয়ে ১ বছর ৪ মাস পর তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হন।সিরাজ উদদীন আহমেদ বি.এম. কলেজে (বরিশাল) ফজলুল হকের (পরে ফ্লাইট সার্জেন্ট ও আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ ফজলুল হক মণির সহপাঠী ছিলেন। ১৯৬২-র সামরিক আইন বিরােধী আন্দোলন ও ১৯৬৪-র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে মােনায়েম খান বিরােধী আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বরগুনা ক্লাব প্রাঙ্গণে তিনি তার বন্ধু আসমত আলী সিকদারের সাথে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সিরাজ উদদীন। আহমেদ ৭ বছর বরগুনায় ছিলেন। ১৯৭৪ সালে সকলের সহযােগিতায় দক্ষতার সাথে তিনি দুর্ভিক্ষ মােকাবেলা করেন। তার ভাষায়, “কেউ না-খেয়ে মারা যায়নি।’ ১৯৭৫ সালে বরগুনা জেলার সাংসদত্রয় (আসমত আলী সিকদার, শাহজাদা আব্দুল মালেক খান ও নিজাম উদ্দিন আহমেদ) মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে সিরাজ উদদীন আহমদকে বরগুনার গভর্নর নিয়ােগের সুপারিশ করেন। কিন্তু তখন তিনি উপসচিব’ না-হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৫ সালে বরগুনাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে টাউনহলের নাম ‘সিরাজ উদদীন মিলনায়তন’ রাখা হয় এবং তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়। বর্তমানে তিনি সরকারি কর্ম কমিশনের অন্যতম সদস্য। তিনি ১০টির অধিক গ্রন্থের প্রণেতা। তার ভাষায় : “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অস্ত্র দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশােধ নিতে পারিনি। তাই প্রতিবাদ জানাতে কলম ধরেছি।দুর্মদ কিশােরগঞ্জ২০ ১৫ আগস্ট ভােরে মেজর ডালিমের সর্বনাশা বেতার ঘােষণায় সারাদেশের মতাে। কিশােরগঞ্জেও নেমে আসে অদ্ভুত নিঃশব্দতা-নিঃস্পন্দনতা। তবে নিমিষেই ঘাের কাটিয়ে অমিত-তেজী কিছু যুবক শহরের স্টেশন রােডের (রঙমহল সিনেমা হল সংলগ্ন) ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জমায়েত হয়। তারা প্রায় সবাই ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ (মােজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী। সংক্ষিপ্ত আলােচনার পর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও সামরিক শাসন জারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রস্তাব নিয়ে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা বাকশাল নেতৃবৃন্দের সাথে যােগাযোেগ১৯. ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মােনায়েম বিরােধী আন্দোলন করার অপরাধে আসমত আলী সিকদার ও শেখ মণির ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়। তিনি শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন।

১৯৬৯ সালে তিনি বরগুনায় আইনব্যবসা শুরু করেন এবং পরে সাংসদ নির্বাচিত হন সিরাজ উদদীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০১, ভূমিকা। “আমার কথা ২০. ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সংঘটিত বিক্ষোভ-মিছিলে অংশগ্রহণকারী ১২ জনের সাথে গত ২০০২ সালের। জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকার, জনকণ্ঠ ২০ আগস্ট ১৯৯৬, সংবাদ ১৫ আগস্ট ১৯৯৮ ও ১৪ আগস্ট ১৯৯৯ -এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ‘দুর্মদ কিশােরগঞ্জ’ অধ্যায়টি রচিত বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তখন বাকশালের অঙ্গসংগঠন ‘জাতীয় ছাত্রলীগে একীভূত হলেও এর। আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম তখনও শুরু হয়নি। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তখন বাকশালে একীভূতকরেন। কিন্তু জেলা বাকশাল নেতৃবৃন্দ ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাদের কেউ ঢাকায় কিশােরগঞ্জের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যােগাযােগের পরামর্শ দেন, কেউ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন এবং কেউ আগত পরামর্শপ্রার্থীদের ভৎসনা করেন। তাদের সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত, কেউ ঘােরে আবিষ্ট, কেউ মােশতাকের প্রতি মােহাবিষ্ট। কেউ নিরাপত্তার প্রয়ােজনে’ গ্রেফতার বরণের জন্য প্রস্তুত। নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে কোনাে দিক-নির্দেশনা না পেয়ে প্রতিবাদাকাজী যুবকেরা। ফিরে এসে পুনঃ আলােচনায় বসেন। প্রসঙ্গক্রমে কোনাে একজন একাত্তরের ২৬ মার্চের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ২৬ মার্চ ১৯৭১ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটের সংবাদ পেয়ে গুটিকয় অকুতােভয় তরুণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে শহরে শুরু করেছিলেন। প্রতিবাদ মিছিল। পরে দেখা গেল মিছিল যত এগােয়, অংশ গ্রহণকারী তত বাড়ে এবং যখন তা শেষ হয় তখন লােকসংখ্যা অগণন, জনসমুদ্র। একাত্তরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে উপস্থিত সবাই অধিক উদ্দীপিত হয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করার পক্ষে মত। দেন। সময় তখন সকাল সাড়ে ন’ বা দশটা। একজন কেউ দাড়িয়ে বজ্রমুষ্ঠি উঁচিয়ে স্লোগান দেন, মেজর ডালিমের ঘােষণা সাথে সাথে সকলে দাড়িয়ে সাহসের ঝড় তােলে গগনবিদারী প্রত্যুত্তর মানি না, মানব’ বলতে বলতে রাস্তায় নেমে আসে। চলতে শুরু করে ক্ষুদ্র কিন্তু তাৎপর্যময় মিছিল। আরও যেসব প্রধান প্রধান স্লোগান ওঠে, তা হল ‘মুজিবহত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম, মুজিবহত্যার বদলা নেব, বাংলাদেশের মাটিতে’, সামরিক আইন তুলে নাও, গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও’।

মিছিলটি পূর্বদিকে যাত্রা করে শহরের পুরান থানা, একরামপুর, বড়বাজার, গৌরাঙ্গবাজার হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে এসে শেষ হয়। | কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিক্ষোভে-বিদ্রোহে মানুষ একাত্তরের মতাে এগিয়ে আসেনি। রাস্তার মােড়ে মােড়ে, রেডিওর পাশে মানুষের নিম্নস্বর আলােচনা। দু’চারজন যাত্রাপথে মিছিলে যােগ দিলেও অধিকাংশই শঙ্কিত, বিহ্বল। ফলে মিছিলের গতি বাড়িয়ে স্বল্পসময়ে শহর প্রদক্ষিণ সমাপ্ত করা হয়। মিছিলশেষে সকলেই পাশের জাহেদের চা-পানশালায় এসে সকালের নাশতা/চা-পান করেন। সাথে সাথে চলে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলােচনা। শহরের থমথমে ভাব দেখে সবাই পরিস্থিতি বিরূপ হওয়ার আশঙ্কা করেন। সেরূপ ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য আত্মগােপন করা, গ্রেফতার এড়িয়ে২০. বাকশালের জেলা-সম্পাদক মােস্তাফিজুর রহমান (চুন্ন মােক্তার), সহ-সম্পাদক এ্যাডভােকেট নূরুল ইসলাম, সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম, মহিউদ্দিন আহমেদ, বাকশাল নেতা আব্দুল কুদুস মােক্তার ও জমিয়ত আলীর সাথে যােগাযােগ করা হয়। সহ-সম্পাদকদের মধ্যে আব্দুল হামিদ। এ্যাডভােকেট ও কাজী আব্দুল বারী সেদিন কিশােরগঞ্জে উপস্থিত ছিলেন না।২১.  মতান্তরে আখড়া বাজার, কালীবাড়ি হয়ে থানার সামনে দিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে ফিরে এসে। মিছিলটি শেষ হয়। সেখানে পরে ‘সাগর অডিও ও ভিডিও’, ‘পদ্মা ইলেক্ট্রনিক্স প্রভৃতি দোকান হয়েছেচলা এবং সাময়িকভাবে তাড়াইল থানাস্থ তালজাঙ্গায় গােপন যােগাযােগ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এমন সময় পুলিশ ভর্তি একটি ট্রাক ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ের সামনে এসে থামে। কিছু পুলিশ ট্রাক থেকে নেমে পরিবেশ পর্যবেক্ষণে মনােযােগী হয়। মিছিলকারীরা বিপদ আঁচ করে প্রথমে রােকেয়া সরণী, খরমপট্টি, নীলগঞ্জ রােড এলাকায় ও পরে তাড়াইল, করিমগঞ্জ, ইটনা থানায় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন।  পরে জানা যায়, কিশােরগঞ্জ ও বরগুনা শহর ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও এ ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি। প্রতিবাদের এই ক্ষুদ্র আয়ােজনটি তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হলেও তা আবেগের ফসল ছিল না; ছিল যুক্তিনিষ্ঠ কর্তব্যানুরাগী, | রাজনৈতিক লক্ষ্যাভিসারী, গণতন্ত্রের চেতনা শাণিতকারী। জাতীয় সংসদের বর্তমান বিরােধীদলীয় উপনেতা আবদুল হামিদ এ্যাডভােকেট সেদিন ঢাকায় শেরেবাংলা নগরস্থ সাংসদ-হােস্টেলে অবস্থান করছিলেন।

তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান : ঘটনার তিনদিন পর কিশােরগঞ্জ শহরে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-মিছিলের সংবাদ পাই। তখন এ-ও জানতে পাই যে, সারাদেশে এরূপ মিছিল শুধু কিশােরগঞ্জেই সংগঠিত হয়েছে। কিশােরগঞ্জের অধিবাসী হিসেবে এজন্য আমি গর্ববােধ করি। মিছিলকারীদের প্রতি আমি সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই।কিশােরগঞ্জ তথা সারা বাংলাদেশের জন্য গৌরবময় এ কীর্তি স্থাপনকারী দুঃসাহসিক বীরগণ হলেন : ১. ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, পরে এ্যাডভােকেট ও সাধারণ সম্পাদক, জেলাগণতন্ত্রী পার্টি, কিশােরগঞ্জ।২. আমিরুল ইসলাম, পরে এ্যাডভােকেট ও সভাপতি, জেলা কমিউনিস্ট পার্টি। ৩.গােলাম হায়দার চৌধুরী, পরে অধ্যক্ষ, খালিয়াজুরী মহাবিদ্যালয়,খালিয়াজুরী, নেত্রকোণা। ৪. সেকান্দার আলী ভূঞা, পরে বীমা কর্মকর্তা, কিশােরগঞ্জ। ৫. হাবিবুর রহমান মুকু (তার প্রকৃত ডাকনাম মুফতি ক্রমে ‘মুকু’তেরূপান্তরিত হয়)।অলক ভৌমিক। ৭. আকবর হােসেন খান। ৮. অশােক কুমার সরকার, পরে এ্যাডভােকেট ও সচেতন নাগরিক কমিটিনেতা। ৯, হালিম দাদ খান (রেজওয়ান), পরে অধ্যক্ষ, আদর্শ মহাবিদ্যালয়, খাড়াচুড়াইন, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ; এ গ্রন্থের লেখক। ১০. নূরুল হােসেন সবুজ, পরে ঠিকাদার। ১১. এনামুল হক ইদ্রিস, পরে পল্লী চিকিত্সক, সিপিবি নেতা। ১২. পীযুষ কান্তি সরকার, পরে কৃষি-যন্ত্রপাতি ব্যবসায়ী। ১৩. রফিক উদ্দিন পনির, পরে সরকারি চাকরিজীবী। ১৪. অরুণ কুমার রাউত। ১৫. আবদুল আহাদ, উল্লিখিত চা-পানশালার মালিক জাহেদের ছােটভাই;পরলােকগত। ১৬. নির্মলেন্দু চক্রবর্তী, পরে চাকরিজীবী। ১৭, সাইদুর রহমান মানিক, পরে এ্যাডভােকেট, ঢাকা জজকোর্ট। ১৮. আলী আসগর স্বপন, পরে বার্তাজীবী, জনকণ্ঠ, ঢাকা। ১৯. সৈয়দ লিয়াকত আলী বুলবুল ও বেশ কিছু পথচারী।দুর্বার ঢাকা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঢাকায় জাতীয়ভাবে মুজিবহত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি। তবে তরুণ-ছাত্রকর্মীরা সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রতিবাদ জানাতে সচেষ্ট হয়। ২৪/২৫ আগস্ট কিছু ছাত্র নেতাকর্মী মধুর ক্যান্টিনে জমায়েত হয়। ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান জমায়েতে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন এবং পুলিশমিলিটারি টের পাওয়ার আগেই একটি ঝটিকা প্রতিবাদ মিছিলও সংঘটিত হয়।

এটা ঢাকায় প্রথম এবং বাংলাদেশে তৃতীয় প্রতিবাদ। এরপর ২০ ও ২১ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিনসহ ক্যাম্পাসে সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সময় অল্পকিছু ‘দেয়াল-লিখনও চোখে পড়ে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ভােরে হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সংবাদ পাওয়ামাত্র জাতীয় সংসদের সদস্য-ভবনে অবস্থানরত সাংসদগণ অতি সাধারণ পােশাকে পায়ে হেঁটে নিজ নিজ নিরাপদ আশ্রয়ে গমন করেন। অনেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতি অবহিত করার জন্য তাদের ঠিকানা/ফোন নম্বর সংসদের বেয়ারাদের দিয়ে যান। কেউ কেউ পরে নিজে এসে লােক পাঠিয়ে অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়ে সদস্যভবনে পুনঃ বাস| জনকণ্ঠ ও সংবাদ পত্রিকার প্রতিবেদনে এই মিছিলে অংশগ্রহণকারী ক্রমিক নম্বর ১৬১৯ পর্যন্ত নামসমূহ নিয়ে মতদ্বৈধতা রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত আসাদুল্লাহ খান জানিয়েছেন, ঐদিন কিশােরগঞ্জে অবস্থান না করায় তিনি ঐ মিছিলে অংশ নিতে পারেননি (এজন্য তার আফসােসের অন্ত নেই)। প্রথম দুটি প্রতিবেদনে উল্লিখিত মতিউর রহমান (তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা, বর্তমানে পক্ষাঘাতে অসুস্থ) ৩ জুলাই ২০০২ এক সাক্ষাৎকারে জানান, মিছিলটি পুরান থানার দিক থেকে পশ্চিমদিকে যাত্রাকালে হােটেল মােবারকের সম্মুখ থেকে তিনি এতে যােগ দেন। কোথায় গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়, মিছিলে শেষাবধি বা কোনাে স্থান পর্যন্ত তিনি ছিলেন, কীভাবে প্রথম মুজিবহত্যার সংবাদ পান, হােটেল, মােবারকের সামনে এ সময় কেন এসেছিলেন এসব কিছুই তিনি সাক্ষাৎকার প্রদানকালে স্মরণ করতে পারেননি। ঐ সাক্ষাৎকারে উপস্থিত স্টেশন রােডের গােপাল চন্দ্র দাস জানিয়েছেন, মিছিলটি একরামপুর থেকে পবিত্র লন্ড্রীর সামনে দিয়ে যাত্রাকালে তিনি তাতে যােগ দিয়ে কাটাখালী (বড়বাজার) পুল পর্যন্ত যান এবং তার দলীয় (ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ) কাউকে দেখতে না পেয়ে মিছিল ত্যাগ করে চলে আসেন মুনীরুজ্জামান, মুজিবহত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ), বিশেষ সংগ্রহক সংখ্যা (বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার), সংবাদ, ৯ নভেম্বর, ১৯৯৮ ভােরর কাগজ, ১৭ আগস্ট ১৯৯৬করতে আসেন। সুনামগঞ্জের ছাতক-দোয়ারা বাজার থেকে নির্বাচিত তৎকালীন স্বতন্ত্র সাংসদ আবুল হাসনাত মাে. আব্দুল হাই গত ২৯ অক্টোবর ২০০২ প্রদত্ত এক সাক্ষাঙ্কারে জানান যে, হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার পর তিনি সদস্যভবন ছেড়ে গ্রিনরােডে তার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। কয়েকদিন পর ইসমাইল নামক এক বেয়ারার মারফত তিনি জানতে পারেন যে, শাহ মােয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান। প্রমুখ সদস্যভবনে গিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে সকল সাংসদকে ফিরে আসতে বলেছেন। একই সাথে উঠিয়ে নেয়া নিরাপত্তা-পুলিশ পুনর্বহাল করা হয় এবং কেটে দেয়া ফোনেরও পুনঃসংযােগ দেয়া হয়। ফলে পরিস্থিতি অনুকূলে বিবেচনা করে সাংসদগণ ফিরতে শুরু করেন। মােশতাক তার ক্ষমতা-দখলকে জাতীয় সংসদ কর্তৃক বৈধতাদানের অভিপ্রায়ে অধিবেশন আহ্বানের পরিকল্পনা করেন। সেজন্য মনােভাব বােঝ এবং প্রয়ােজনবােধে তাদের হাত করার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ বঙ্গভবনে সাংসদদের একটি সভা” আহ্বান করা হয়। কিন্তু নগণ্যসংখ্যক সাংসদ উপস্থিত হওয়ায় সভার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় ।

তাই হুইপ আব্দুর রউফের নেতৃত্বে লােক পাঠিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যােগাযােগ করে সাংসদদের প্রলুব্ধ করে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং ১৬ অক্টোবর (সরদার আমজাদের মতে ১৫ অক্টোবর) পুনঃ বঙ্গভবনে সভা আহ্বান করা হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যভবনসমূহে অবস্থানকালে সাংসদগণ বঙ্গভবনে আহুত সভাকে উপলক্ষ করে নিজেদের মধ্যে আলােচনার সুযােগ পান। গাজীপুরের কালিগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সাংসদ এ্যাডভােকেট ময়েজুদ্দিনের (পরে তিনি স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনে শহীদ হন) উদ্যোগে মুজিব-সমর্থক সাংসদগণ গােপনে সংগঠিত হতে শুরু করেন। তারা নিজেরা পূর্বাহ্নে বৈঠক করে বঙ্গভবনে যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়ে মনস্থির করার সিদ্ধান্ত নেন। সে-মতে ১৬ (মতান্তরে ১৫) অক্টোবর বেলা ১১টায় নাখালপাড়াস্থ সাংসদ-হােস্টেলে শতাধিক সাংসদ সভায় মিলিত হন। সাংসদ ময়েজুদ্দিন, ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভূঞা প্রমুখ সভায় ভাষণ দেন। কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী মুজিবহত্যার বিচার চেয়ে স্লোগান দেন। (মানিক চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন ইউসুফ মােশতাকের দুই প্রতিনিধিকে ইতােপূর্বে সদস্যভবন থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন)। মন্ত্রি সােহরাব হােসেন মােশতাক সরকারের পক্ষে উক্ত সভায় যােগ দেন এবং বঙ্গভবনের সভায় সকলকে কথা বলতে পারার নিশ্চয়তা প্রদান করেন। সভায় মুজিব ও অন্যান্যদের হত্যাকাণ্ডে শােক প্রকাশ করা হয়। এরপর সবাই বঙ্গভবনের সভায় গমন করেন। ডাকসু, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কিছু তরুণ। নেতাকর্মী সাংসদদের বঙ্গভবনের সভায় যােগদান থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ২৬ সরদার আমজাদ হােসেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সঙ্কটকালে তৎকালীন সংসদ সদস্যদের আনুগত্য(নিবন্ধ), জনকণ্ঠ ৩১ শ্রাবণ, ১৪০৯ বাংলাহন। সাজেদা চৌধুরী, ডা. আবুদল মালেক, নূরুল কাদের, লুৎফর রহমানসহ ১০/১২ জন ছাড়া প্রায় সকল সাংসদই উক্ত সভায় যােগদান করেন। যা হােক বঙ্গভবনের সাংসদ সভায় মােশতাক কাঙ্ক্ষিত সমর্থন পাননি। কুমিল্লার সাংসদ সিরাজুল হক (পরে মুজিব হত্যা মামলার প্রধান কৌসুলী) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন আইন অনুযায়ী আপনাকে বৈধ রাষ্ট্রপতি বলা যায় না’। ‘অসন্তুষ্ট’ মােশতাক। সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন “আজ আপনারা সাহসের সাথে কথা বলতে পারছেন। আগে এরূপ বললে (অর্থাৎ বাকশালের বিরােধিতা করলে) এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত।

এরই মধ্যে প্রধানত সিপিবি’র উদ্যোগে ন্যাপ ও গ্রেফতার এড়ানাে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে গােপন যােগাযােগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সংগঠিতভাবে মুজিবে হত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানাের সিদ্ধান্ত হয়। সেমতে ডাকসু ও ছাত্রসংগঠনগুলাের উদ্যোগে ২৯ অক্টোবর প্রকাশ্যে জাতীয় শােক দিবস (মতান্তরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি দিবস) পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পরে প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ থাকায় ৪ নভেম্বর -এর তারিখ পুনঃনির্ধারিত হয়। কর্মসূচির প্রচারের অংশ হিসেবে দুটি প্রচারপত্র (লিফলেট) প্রকাশ করা হয়। এর একটিতে ছিল ব্যাখ্যাসহ বাকশাল কর্মসূচি ও মুজিবহত্যার বর্ণনা এবং অপরটিতে ৪ নভেম্বরের কর্মসূচি অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় বটতলা থেকে মুজিবের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি পর্যন্ত মৌন মিছিল সফল করার আহ্বান। প্রচারপত্র প্রকাশ করা ছিল তখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এবং তা বিলি করতে গিয়েও বেশ ক’জন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ৪ নভেম্বরের কর্মসূচিসহ তৎকালীন আন্দোলনে সবচেয়ে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন ডাকসু ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহবুব জামান ও ছাত্রলীগ নেতা ইসমত কাদির গামা। আরাে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তারা হলেন ছাত্রলীগের খ, ম, জাহাঙ্গীর, ওবায়দুল কাদের, সৈয়দ নূরুল ইসলাম, রবিউল আলম চৌধুরী, মকুল বােস, কাজী ইকবাল, মমতাজ হােসেন, বাহলুল মজনুন চুন্ন প্রমুখ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল আলম লেনিন, কাজী আকরাম হােসেন, কামরুল আহসান খান, অজয় দাশগুপ্ত, খােন্দকার শওকত জুলিয়াস, আব্দুল মান্নান খান, মৃণাল সরকার, নিয়াজ আহমেদ অপু, গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, নূর আলী প্রমুখ। | পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৪ নভেম্বর সকালে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সমাগত হয়। কিছু আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি, শ্রমিক ও নারী নেতাকর্মীও তাদের সাথে যােগ দেন। সকাল ১০টার কিছু পর বুকে কালাে ব্যাজ ধারণ করে দুই সারিতে মিছিলকারীগণ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অনেকের হাতে ছিল ফুল। শুরুতে অত্যুৎসাহী দু’একজন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান৩০ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭দেন।” নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সামনে মিছিল আটকে দেয়া হয়।

মিছিলের সামনের কাতারে থাকা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সাথে শুরু হয় পুলিশের বাকবিতণ্ডা। একজন পুলিশ অফিসার তার ওয়ারলেস-ফোনে অপরপ্রান্তের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘গুলি চালানাে সম্ভব নয়, শত শত ছাত্র মিছিলে যােগ দিয়েছে। প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে যােগাযােগ করে স্লোগান না দেয়ার শর্তে রাস্তা ছেড়ে দেয়া হয়।  মিছিল যতই এগােয়, ততই রাস্তার দু’পাশ থেকে মানুষ শামিল হয়। কলাবাগান পৌছানাের পর শত শত ছাত্রের মিছিল হাজার হাজার শােকার্ত বাঙালির করুণ সারিতে পরিণত হয়। কলাবাগান থেকেই খালেদ মােশাররফের মা ও ভাই (সাংসদ রাশেদ মােশাররফ) মিছিলে যােগ দেন। সামরিক প্রহরা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মিছিল গন্তব্যে পৌছে। মুনীরুজ্জামান জানান : বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেট ছিল বন্ধ। সামনে ছিল পুলিশ। কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এক অভূতপূর্ব শােক-বিহ্বল দৃশ্যের অবতারণা হয় ৩২ নম্বরের বাড়িটির গেটের সামনে। কান্নার রােল পড়ে যায়। সমস্ত পরিবেশ হয়ে পড়ে শোকাভিভূত। এরই মধ্যে মানুষ ফুল অর্পণ করে বন্ধ করা গেটের সামনে।আগের দিন ৩ নভেম্বর ভােরে খালেদ-শাফায়েতের নেতৃত্বে আগস্ট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। শত্রুর শত্রু হলাে বন্ধু’ এই সমীকরণের ভিত্তিতে অত্যুত্থানটিকে নিজেদের পক্ষের ভেবে বটতলায় উপস্থিত আওয়ামী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উৎফুল্লতা দৃষ্ট হয়। কিন্তু এই ধারণা সঠিক ছিল না। ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৮ মােশাররফ ভ্রাতৃবৃন্দের মা মিছিলে যােগ দেয়ায় রটানাে হয় যে, এ মিছিল ৩ নভেম্বর-অভুথানের নেতা খালেদ মােশাররফের আশীর্বাদপুষ্ট ও তার মায়ের নেতৃত্বে সংগঠিত। প্রকৃতপ্রস্তাবে, আরাে অনেক অংশগ্রহণকারীর মতাে কলাবাগান থেকে যােগ দিয়ে ৩২ নম্বর সড়ক পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া ছাড়া রাশেদ মােশাররফ ও তার মা’র অন্য কোনাে ভূমিকা ছিল না। রাশেদ মােশাররফ আওয়ামী রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও তার ভাই খালেদ মােশাররফ ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী সমর্থক ছিলেন  অদ্যুত্থানের আগে-পরে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে কোনাে যােগাযােগও করেননি। শােকমিছিল যাত্রাকে বাধাহীন করার জন্য এর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মাত্র একবারই ৪ নভেম্বর সকালে খালেদ মােশাররফকে ফোনে বলেন, ‘আমাদের নেতা জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা তার প্রতিবাদ করব।

তার জন্য চোখের পানি ফেলবে, শোক করব, মিছিল করব। আপনার আর্মি যেন বাধা না দেয়। এ প্রসঙ্গে খালেদ মােশারফের সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল :“ওটা সিভিলিয়ানদের ব্যাপার, আর্মির কিছু করার নেই।’ মুিনীরুজ্জামান, পূর্বোক্ত)। খালেদ মােশাররফের অভুথানের পর এই শােক-মিছিল অনুষ্ঠিত হওয়ায় শত্রুপক্ষ মিছিলকে তার আশীর্বাদপুষ্ট বলে অপপ্রচার করে। প্রকৃতপক্ষে অ্যুত্থান ও মিছিল দুটোরই প্রস্তুতি ও সংঘটন সম্পর্কহীনভাবে সমান্তরালে সম্পন্ন হয়। মিছিলের তারিখ প্রস্তুতির অভাবে ২৯ অক্টোবর থেকে পিছিয়ে ৪ নভেম্বর পুনঃ নির্ধারিত হয়। কাকতালীয়ভাবে অভুথানটিও ঘটে এর আগের দিন। সময়ের কাকতাল’ ও খালেদের মায়ের মিছিলে যােগদানের ঘটনাকে পুঁজি করে সারাদেশে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে একটি ভারতবিরােধী উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয় মুনীরুজ্জামান , মুজিব হত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ),পূর্বোক্তশােক প্রকাশনার্থে মৌনমিছিল হলেও এটাই মুজিবহত্যার প্রথম সংগঠিত জাতীয় প্রতিবাদ।”৩৫প্রতিবাদ সর্বব্যাপী হল না কেন? এ অধ্যায়ের শুরুতে বলা হয়েছে, সামরিক শাসন/সান্ধ্য আইন জারির প্রাক্কালে ট্যাঙ্কমেসিনগানের সামনে বুক পেতে দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ এদেশে কখনােই হয়নি। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন-চার বছর আগে একটি ফুলকে বাঁচাননার জন্য লক্ষকোটি মানুষ যেখানে জীবন-মৃত্যু’কে ‘পায়ের ভৃত্য’সম গণ্য করেছে সেখানে যথাযথ প্রতিবাদ না। হওয়ার উপযুক্ত যুক্তি সর্বজন গ্রাহ্য নয়। এ প্রসঙ্গে কলামবিদ মুনীরুজ্জামান বলেন : …ঘটনাটা শুধু অপ্রত্যাশিত ছিল না, বরং এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর যারা সমর্থক ছিলেন-তারা তাে বটেই, যারা সমর্থক ছিলেন না-তারাও প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি। পক্ষাঘাতগ্রন্থ রােগীর মতাে বােধশক্তি হারিয়ে বসেছিলেন অনেকেই। | এই সারপ্রাইজ এলিমেন্ট’-এর ওপরই নির্ভর করেছিল ঘাতকদের ষড়যন্ত্রের সাফল্য। তারা হিসাব করেছিল, বাঙালির মানসে বঙ্গবন্ধুর যে-আসন, সেটা যে কখনাে কক্ষচ্যুত হতে পারে-এটা বাঙালির বােধে ধরা পড়তে পড়তে তারা পরিস্থিতি গুছিয়ে নেবে।… কার্যত হয়েছিলও তা-ই। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হােসেন এ প্রসঙ্গে বলেন : আশ্চর্যজনক যে, এতবড় ঘটনার কোনাে প্রতিবাদ কোথাও থেকে ওঠেনি, এমনকি ১৫ তারিখ সকাল থেকেই এমপি হােস্টেল এবং অন্যান্য জায়গা হতে সংসদ সদস্যগণ, যার বেশিরভাগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য, তাদের পরবর্তী করণীয় বা তারা আমাদের (মানে সেনাবাহিনীর) কোনাে কাজে আসতে পারে কিনাএসব জানার জন্য ব্রিগেড এবং অন্যান্য হেডকোয়ার্টারে অনবরত ফোন করেই যাচ্ছিল। কী বিচিত্র সাংসদগণ তাদের করণীয় কী তা জানার জন্য ফোন করছেন ক্যান্টনমেন্টে।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও কিশােরগঞ্জের প্রতিবাদকারীগণের মিছিল করার প্রস্তাবে স্থানীয় নেতৃত্ব সাড়া দেননি। এ প্রসঙ্গে মুনীরুজ্জামানের মূল্যায়ন হল : তারা ভয় পেয়েছিলেন বা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন অথবা জনগণ থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন ছিলেন যে, সাধারণ মানুষের মাঝে মুভ’ করার মতাে অবস্থা তাদের ছিল ৩৫. বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তার বাহিনী নিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন এবং এর পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য ভারত গমন করেন। পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় তিনি সেখানে স্বেচ্ছা-নির্বাসন জীবনযাপন করেন, পরে পরিবেশ অনুকূল হলে দেশে ফিরে আসেন। মুনীরুজ্জামান, মুজিব হত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ), পূর্বোক্ত ঢাকায় এ সময় মনােনীত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ চলছিল। কিছুদিন পূর্বে জেলা বাকশালের সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকদের মনােনীত করা হয়। জেলা কমিটির সদস্যপদে ও থানা বাকশাল কমিটিতে মনােনয়ন প্রভৃতি তদবিরের জন্য অধিকাংশ সাংসদ তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। যদিও সংসদ তখন অধিবেশনে ছিল না। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হােসেন (অব.), বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় পৃষ্ঠা ৪৬ কিশােরগঞ্জের তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের বেলায় যেটি পরীক্ষিত সত্য, বৃহত্তর জাতীয় পরিসরের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বেলায়ও এসব কারণের প্রায় সবগুলােই সত্য। জাতীয় পর্যায়ে কেউই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে রাস্তায় নামেননি। … সংসদ-সদস্যগণ মুজিবহত্যার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও রাজনৈতিকভাবে নিহত হয়ে সেনাবাহিনী-নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। চিন্তা করার বা উদ্যোগ নেয়ার সাহস, ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনােটাই তাদের ছিল না।…৩৯ মুজিবহত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ না হওয়ার অপর একটি কারণ হল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই তা প্রকাশ পায় এবং স্বাধীনােত্তরকালে আপসকামী ও দায়িত্বহীন মােশতাক-শেখ মণিগং মুজিবের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রকৃত অনুসারীদের কোণঠাসা করে ফেলে। হত্যার পরপরই মােশতাকের ক্ষমতারােহণ এবং স্বল্পসময়ের ব্যবধানে আওয়ামী লীগেরই একাংশ মন্ত্রি হওয়ায় আওয়ামী মহলে এই ধারণা বিস্তার লাভ করে যে, মুজিব নিহত হলেও ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতেই রয়েছে।

ততদিনে মুজিবের জনপ্রিয়তাও হ্রাস পেয়েছিল, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মােশতাকের বিরােধিতা করে হালুয়া-রুটির ভাগ থেকে বঞ্চিত হওয়া ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকিও কেউ কেউ নিতে চায়নি। ঘাতকরা দক্ষতার সাথে এই মনােভাবকে তাদের অনুকূলে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৩ সালে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে মুজিবের আজীবন ডাকসুর সদস্যপত্র ছিড়ে ফেলা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশালীন উক্তির অভিযােগে ডাকসু অফিস ও সারাদেশে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন অফিস জ্বালিয়ে দিয়ে, হরতাল পালন করে যারা প্রতিশােধ নিয়েছিল তারাই ১৯৭৫ সালে সিড়িতে মুজিবের রক্তাক্ত লাশ মাড়িয়ে মন্ত্রির ‘চাকরি’ গ্রহণে দ্বিধাবােধ করেনি। এমনকি মন্ত্রিত্ব না-পাওয়া কেউ কেউও মুজিবকে ‘ফেরাউন’ প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করতেও পিছপা হয়নি।” মুনীরুজ্জামান আরাে বলেন :১৫ আগস্টের মুজিবহত্যার প্রতিবাদ না হওয়ার পেছনে আরাে দুটো কারণ উল্লেখ করতে হবে। এর একটি হচ্ছে বাকশাল গঠন। বাকশাল সম্পর্কে বিরুদ্ধপক্ষের প্রচার ছিল শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করে আজীবনের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। এ-কারণেও মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। আরেকটি হচ্ছে দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উদ্ধত আচরণ ও দুর্নীতির জন্য সর্বত্র মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা। এসব কারণে মুজিবহত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে মানুষ কতটা সাড়া দেবে তা নিশ্চিত ছিল না ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ৩৯. মুনীরুজ্জামান মুজিব হত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ), পূর্বোক্ত সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, সামাদ আজাদ, রাজ্জাক, তােফায়েল প্রমুখ যারা মােশতাকের সাথে হাত মেলাতে চাননি তাদেরকে সপ্তাহকালের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যেতে হল। তবে দুঃখজনক যে, তাঁরাও ঝুঁকি নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে এগিয়ে আসেননি। যদিও প্রথমােক্ত চার নেতাকে শেষপর্যন্ত জীবন দিতেই হল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। আর যেহেতু ক্ষমতাসীন বাকশাল তথা আওয়ামী লীগ। প্রতিবাদ করেনি, সে-কারণে অন্য রাজনৈতিক দল বা জনসাধারণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে নি। কিশােরগঞ্জের প্রতিবাদটি ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম।” ক্ষমতাসীন আওয়ামী-বাকশালীরা প্রতিবাদে এগিয়ে না আসার কারণ হিসেবে মুজিব হত্যা মামলার রায়ে বর্ণিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির উল্লেখ করে বলা হয় : অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পূর্বে ও পরে তার অনুসারীগণের।

ব্যবহারে অনেক পার্থক্য। ইহা কিছুটা বােধগম্য আমাদের দেশের নেতা ভিত্তিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে; যেমন নেতা আছে তাে সব আছে, নেতা নাই তাে কেউ নাই। উপযুক্ত বিষয়সমূহের সার-সংক্ষেপ হিসেবে বলা যায়, ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতা, দুনীতি, গণবিচ্ছিন্ন, রাজনৈতিক আনুগত্য ও নেতৃত্বের অভাবে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ঢাকাসহ সারাদেশে সংগঠিত হয় নি। | প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, খুনীদের মুখপাত্র (সে নিজেও খুনী) মেজর ডালিমের স্ত্রী তাসনিম হত্যাকাণ্ডের পর কিছুদিন বিকৃত মস্তিষ্কের মতাে আচরণ করে। অন্য সবাই যখন খুনী মেজরদের না-রাগানাের জন্য সতর্ক, তাসনিম তখন ওদের আমল দেয়া তাে দূরের কথা বরং দেখলেই থুতু ফেলত।মুজিব নিহত হওয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলামের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করার কথা। কিন্তু কোনাে দুঃসাহসিক কাজের উদ্যোক্তা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল না। পরে খুনিদের সরকারে যােগদানের প্রস্তাব নিয়ে তাহের ঠাকুর ও শাহ মােয়াজ্জেম তার কাছে গেলে তিনি বলেন ; আমার আর কোনাে সরকারি পদের দরকার নেই। মােশতাককে বলাে আমাকে। ছেড়ে দিতে। আমি ময়মনসিংহে চলে যাব। আর ক’দিনই বাঁচব। একটু অবসর জীবন কাটাতে চাই।” তাজউদ্দিন ছিলেন মােশতাকের চিরশত্রু। মুজিবনগর সরকার ঢাকায় পৌছেই ষড়যন্ত্রকারী মােশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। কিন্তু মুজিব তাকে পুনর্বাসিত করেন। ১৯৭৪-এর নভেম্বরে কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের প্রাক্কালে মুজিবের মন্ত্রীসভা থেকে তাজউদ্দিনের বিদায় ও বাকশালে তার অন্তর্ভুক্ত না-হওয়ার পেছনে মােশতাকের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। তাই মােশতাক তাজউদ্দিনের কাছে কাউকে পাঠাননি। তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই মােশতাক তাজউদ্দিনের বাড়িতে সশস্ত্র প্রহরা মােতায়েন করে তাকে নজরবন্দি করে রাখে। প্রহরায় নিয়ােজিত সেনাদের ৪১. মুনীরুজ্জামান, মুজিব হত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ) পূর্বোক্ত এএল খতিব, কারা মজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫১ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৫

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান