You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.26 | শ্ৰীমতী গান্ধীর হুশিয়ারী | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শ্ৰীমতী গান্ধীর হুশিয়ারী

প্রেসিডেন্ট নিকসন মাথা চুলকাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই গালে হাত দিয়ে ভাবছেন। বৃটেন পড়ে গেছে। মহাফাপরে। বাংলাদেশ স্বাধীন। পাক-ভারত উপমহাদেশের পুরানাে শক্তিসাম্য একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। এখানে ভারত অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দাপাদাপি করছেন ভুট্টো। এই নিষ্ঠুর সত্য মানতে তিনি রাজী নন। তাঁর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এখনও পূর্ব পাকিস্তান। ভুট্টোর মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন বিশ্বাসঘাতক নুরুল আমিন এবং ত্রিদিব রায়। জলঘােলা করার কোন কসরতই আর বাকী নেই। নােংরা হাত না ধুয়েই তিনি আবার ছুটছেন গৃহবন্দী মুজিবুর রহমানের কাছে। শেখ সাহেব করমর্দন করেছেন কিনা জানা নেই। না করারই কথা। ভাল করেই চেনেন তিনি ভুট্টোকে। মুজিবকে বন্দীদশায় রেখে বাংলাদেশের ক্ষমা লাভ অসম্ভব। আর তিনি মুক্তি না পেলে প্রায় এক লক্ষ পাক বন্দীর কি দশা হবে বলা মুস্কিল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম বলে দিয়েছেন সাফ কথা-মুজিবের মুক্তির আগে যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের আলােচনা শিকেয় তােলা থাকবে। এতে পশ্চিম পাকিস্তানে দেখা দেবে প্রচণ্ড আলােড়ন। স্বজনদের ফিরে পাওয়ার জন্য ভুট্টোর উপর অসম্ভব চাপ সৃষ্টি করবে পাক যুদ্ধবন্দীর পরিবারবর্গ। মুজিবকে নিয়ে দর কষাকষির সুযােগ খুবই সীমিত। কারণ তুরুপের তাস ভুট্টোর হাতে নয়, ভারত এবং বাংলাদেশের হাতে। তবু মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিচ্ছেন ভুইফোড় পাক প্রেসিডেন্ট। বজায় রাখবেন তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব। বােঝাচ্ছেন স্বাদেশের নির্বোধদের-ভয় নেই। সঙ্গে আছে চীন এবং আমেরিকা। পাক-ভারত লড়াইএ ইয়াহিয়ার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নিকসনেরও আঙ্গুল পুড়েছে। তিনি প্রায় নির্বাক। তার হয়ে কথা বলছেন মাকির্ণ পররাষ্ট্রসচিব উইলিয়ম রােজার্স। তিনি বলছেন- পাকিস্ত ানের অখণ্ডত্বে আমরা বিশ্বাসী। কিন্তু তা রক্ষা করার সামরিক দায়িত্ব আমেরিকার নেই।
প্রেসিডেন্ট নিকসনকে বিশ্বাস করা শক্ত। কথায় এবং কাজে তার মধ্যে নেই কোন সামঞ্জস্য। ঘােলা জলে সাঁতার কাটতে ভুট্টোর মতই তিনি ওস্তাদ। চীনাদের কথা আলাদা। তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ভারতের ভবিষ্যত শক্তিমান ভূমিকা। নিশ্চিন্ত আরামে বসে আমেরিকার সঙ্গে এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রভাগ অবম্ভব। সেখানে প্রতিবন্ধক হিসাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে ভারত। তাকে নাস্তানাবুদ করার কোন চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না চীন। উভয় সঙ্কটে পড়েছে বৃটেন। পশ্চিম এশিয়ায় তার তৈল স্বার্থ মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে বাধা/ধাঁধা। মােল্লাতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলাে ওদের বরকন্দাজ। ইরানকে সামনে রেখে পাকিস্তানসহ মােল্লাতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলােকে নিয়ে একটি সামরিক জোট গড়ার পরিকল্পনা তাদের দীর্ঘদিনের। ওখানে ফাটল ধরাতে বৃটেন অনিচ্ছুক। অপরপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের বাজারের উপর রয়েছে বৃটিশ ব্যবসায়ীদের শ্যেনদৃষ্টি। শ্যাম এবং কুল-দুই রাখার পাঁয়তারায় চলবে তার কিছুদিন। প্রধানমন্ত্রী হীথ বারমুলায় একান্তভাবে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট নিকসনের সঙ্গে। পাক-ভারত উপমহাদেশে পুরানাে শক্তিসাম্যের বিপর্যয়ে উভয়েই চিহ্নিত। হয়ত স্বতন্ত্র করে ঢেলে সাজাতে হবে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক স্ট্র্যাটেজী। পাকিস্তান আজ ক্ষুদ্র, ভগ্ন এবং দুর্বল। আগের ডাট তার আর নেই। তবু তাকে দরকার। ভাঙ্গা হাতে ব্যান্ডেজ বাধার পালা সুরু হতে দেরী নেই। সত্যিকারের নষ্টামি করবে চীন এবং আমেরিকা। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী জাতিকে দিয়েছেন উপদেশ-বিজয়ের আত্মতুষ্টির সময় নেই। তার দুরদর্শিতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা অজানা। সঙ্কট দেখা দেবে যুদ্ধবন্দী বিনিময়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সৈন্যাপসারণ প্রভৃতি প্রসঙ্গ নিয়ে। স্বস্তি পরিষদে চলবে আর একপ্রান্ত হট্টগােল। ভারতের উপর চীনা এবং মার্কিন চাপ থাকবে অব্যাহত। শ্ৰীমতী গান্ধী বলেছেন-ভারতের সমস্যায় কোন বৃহৎ শক্তির হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না। মার্কিন কর্তৃপক্ষের ধারণা, টাকা দিলে মাথা কেনা যায়। শরণার্থী সমস্যার সমাধানে এ টোপ ফেলেছিলেন তারা। বিনিয়ে বিনিয়ে কথা পেড়েছিলেন-মুক্তিবাহিনীকে বর্জন কর। ভারতে শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য না হয় কটা ডলার দেওয়া যাবে। তাদের উপদেশ শােনেননি নয়াদিল্লী। স্থানীয় জনসাধারণ এবং মুক্তিবাহিনীর সহযােগিতায় জওয়ানরা এনেছেন বাংলাদেশের মুক্তি। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ধাপ্পা এবং চীনা তর্জন গর্জন রক্ষা করতে পারেনি আত্মসমর্পিত পাক সৈন্যদের। এমন একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে ভারত তা হয়ত এদের কল্পনায় আসেনি। ভীষণ চটে গেছেন নিকসন। বন্ধ করেছেন ভারতে মার্কিন সাহায্য। তাতে দমেননি নয়াদিল্লী। আবার সতর্ক করেছেন শ্রীমতী গান্ধী-টাকা ছড়িয়ে ভারতকে বশে আনা অসম্ভব। চীন হজম করতে পারছে না নয়া পরিস্থিতি। অবশ্যই আকণ্ট অস্ত্রসজ্জিত হবে পশ্চিম পাকিস্তান। ভারত বৈরিতা তার কমবে না। তার অস্ত্রঝঙ্কারের প্রতিধ্বনি উঠবে চীন-ভারত সীমান্তে। অদূরভবিষ্যতে যুদ্ধ হয়ত বাধবে না। কিন্তু যুদ্ধের মানসিকতা বজায় থাকবে দীর্ঘদিন। সবই নির্ভর করছে ভুট্টোর শাসনের স্থায়িত্বের উপর। পুরানাে জেনারেলরা বিদায় নিয়েছেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ জেনারেলরা মঞ্চে এসেছেন। ভুট্টো তাদের শাে বয়। রূপে এবং গুণে সবাই কট্টর। জেহাদী উত্তেজনায় জনসাধারণকে না রাখতে পারলে বেশীদিন টিকবে না ভুট্টোর নেতৃত্বে। মিটবে না হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নুতন জঙ্গীশাহীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ওরা দেখাতে চাইবেন, যা পারেননি আয়ুব এবং ইয়াহিয়া তা পারবেন তারা। চীন জোগাবে ইন্ধন। তুরস্ক, ইরান এবং সৌদী আরব দেবে মদৎ। পিছন থেকে ছড়ি ঘুরাবেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। এখানেই রয়েছে ভবিষ্যতের বিপদ। তাই জাতির উদ্দেশ্যে শ্রীমতী গান্ধীর উপদেশ-আত্মতুষ্টির সময় নেই। বৃহৎ শক্তিগুলাের কাছে তাঁর হুশিয়ারীভারতের সমস্যায় অপর কোন রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না। ফাঁকা কথা তিনি বলেন না। তার প্রমাণ-চৌদ্দদিনের লড়াইএ ভারতের চূড়ান্ত বিজয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১