ভুট্টো হলেন প্রধানমন্ত্রী
নুরুল আমিন তলিয়ে গেছেন। ভুট্টো হয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। গােষনা করেছে পাক-বেতার। ইয়াহিয়ার নামগন্ধ নেই প্রচারযন্ত্রে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তার বেতার ভাষণের কথা ছিল। কিন্তু শােনা গেল না ইয়াহিয়ার কণ্ঠস্বর। বাজল কেবল গানের রেকর্ড। অথচ রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে একটির পর একটি ফরমান বেরুচ্ছে। অস্ত্র-সম্বরণের নির্দেশ এসেছে প্রেসিডেন্ট এবং চিফ অফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের বয়ানে। প্রধানমন্ত্রীর পদে ভুট্টোকে নিয়ােগ করেছেন প্রেসিডেন্ট। এই পদাধীকারী ব্যক্তি- ইয়াহিয়ার নাম একেবারেই অনুক্ত। মনে হয়, সবই বলছে বকলমে। পাকিস্তানের এক নম্বর হিরাে ইয়হিয়া খান কি এতই। অপাংক্তেয় হয়ে গেলেন যে, তার নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করতে পাক-বেতার লজ্জা পাচ্ছে? তিনি কি আর ক্ষমতার আসনে নেই? বাংলাদেশে পাক-বাহিনীর নিঃস্বৰ্ত আত্মসমর্পণ এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে নিঃসর্ত অস্ত্র সম্বরণের সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়াও কি আত্মসমর্পিত হলেন? পরাজয়ের গ্লানিতে লাহাের উত্তাল। সামরিক আইন অগ্রাহ্য করে লড়নেওয়লারা দেখাচ্ছে ইয়াহিয়া-বিরােধী বিক্ষোভ। ভারত ধ্বংসের জেহাদে যাদের চাঙ্গা করে তােলা হয়েছিল তারা বুঝতে পারছে না চৌদ্দ দিনের মধ্যে কি অঘটন ঘটে গেল? ধর্মীয় আফিমে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছিল ধর্মান্ধদের। ভারতের কামানের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেছে তাদের। দেখেছে, ভারত ধ্বংসের বদলে ধ্বংস হতে চলেছে পাকিস্তান। তাই পরাজিত নায়কের প্রতি সােচ্চার হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ। ওরা দাবী জানাচ্ছে ইয়াহিয়ার পদত্যাগ।
জঙ্গীচক্রের বদলে যদি শাসন ক্ষমতা যায় মােল্লাতন্ত্রীদের হাতে তবে কি রক্ষা পাবে পাকিস্তান? ডুবন্ততরীর হাল কি ধরতে পারবেন জুলফিকার আলী ভুট্টো? মাথায় জওয়ান এবং মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড ঠাটি পড়ার পর এই হাজার বছর লড়নেওয়ালারও কিছুটা কান্ডজ্ঞান ফিরেছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে অস্ত্রসংবরণের সংবাদ শােনার পর তিনি নাকি বলেছেন- এ অবস্থায় যুদ্ধ চালান বাতুলতা। পাকিস্তানকে বাঁচাবার জন্য দরকার অবিলম্বে অসামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা। তারই পরিণাম প্রধানমন্ত্রী পদে ভুট্টোর নিয়ােগ। তাতে কি লড়নেওয়ালারা পাবে আশ্বাস? বহু কেরামতি জানেন এই সিন্ধি নেতা। বারে বারে ভােল পাল্টাতে তিনি ওস্তাদ। ধাপ্পা দিতেও সমান পটু। দুদিন আগেই তিনি বলেছেন- চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক চুক্তি আশু প্রয়ােজন। এটা হয়তাে সিয়াটো এবং সেন্টো গােষ্ঠীকে ব্ল্যাকমেইল। ভারত-ধ্বংসী লড়াই-এ ওরা যখন এগিয়ে এলাে না তখন চীনের দ্বারস্থ হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এই প্রচারে স্বান্তনা পাবে লড়নেওয়ালারা। ওরা ভাববে- কেউ সঙ্গে ছিল না বলেই এ যাত্রায় হেরে গেল পাকিস্তান। সামনের লড়াই-এ সহযােগী হবে চীন। রাতারাতি একেবারে কিস্তিমাৎ। হয়ত ইয়াহিয়ার খেল খতম এবং ভুট্টোর খেলের আরম্ভ। মাঝখান থেকে বুড়াে বয়সে ছিটকে পড়লেন নুরুল আমিন। তিনি ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই কেরিয়ার শেষ করলেন- গদীর নাগাল আর পেলেন না।
ভয়ানক আশাবাদী ভুট্টো। বাংলাদেশের আশা তিনি ছাড়েন নি। প্রদানমন্ত্রীর তক্তে বসার পরই উজিরে আজম কথাবার্তা চালাবেন বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের সঙ্গে। ভুট্টো ভুলে গেছেন- বিদ্রোহীরা এখন স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের সরকার। তারা কেন কথাবার্তা বলতে যাবেন পাকজঙ্গীশাহীর গােলাম ভুট্টোর সঙ্গে? বাংলাদেশের নেতারা কি জানেন না- ভুট্টো লােকদেখান শাে- বয়। আসল ক্ষমতার জিম্মাদার জঙ্গীচক্র। সেখানে এক ইয়াহিয়া যাবেন এবং আর এক নতুন ইয়াহিয়া আসবেন। বাংলাদেশের বারুদ জমা করেছিলেন ইয়াহিয়া আর তাতে আগুন দিয়েছেন ভুট্টো। গণহত্যার জন্য সমভাবে দায়ী সিন্ধুর এই শয়তান। হয়ত তলে তলে তিনি মতলব আটছেন- বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের সঙ্গে করবেন আলােচনা। তার সর্তে রাজী না হলে তিনি পাবেন না মুক্তি। ভুলে যাবেন না ভুট্টো সাহেব আগুন নিয়ে খেলতে গিয়ে আঙ্গুল পুড়িয়েছেন ইয়াহিয়া খান। বেশী বাড়াবাড়ি করলে তাঁকে (ভুট্টোকে) যেতে হবে জাহান্নমে। তাসের তুরুপ পাকিস্তানের হাতে নয়, ভারত এবং বাংলাদেশের হাতে। নয়াদিল্লী সাবধান। বিশ্বাস নেই ভুট্টোকে। অস্ত্রসম্বরণ সাময়িক। শান্তির পথ বহুদূরে। বিজিত পাকভূমি ছেড়ে দেবার আগে কাশ্মীরের ফয়সালা চাই। এ রাজ্যের কিছুটা অংশ বেআইনীভাবে দখল করে রেখেছে পাকিস্তান। ফেরত দিতে হবে ভারতের বেদখল ভূমি। তা না হলে গােটা কাশ্মীরের জন্য পাকিস্তানে বাজবে রণভেরী। এ সুযােগ আর দেওয়া হবেনা যুদ্ধবাজদের। দুর্যোগ শেষ হয়নি। স্বস্তি পরিষদে আরও জল ঘােলা করবে চীন এবং আমেরিকা। তালে তালে নাচবেন ভুট্টো। এই নর্তন থামাবার জন্যই দরকার মুজিবের মুক্তি এবং স্থায়ী শান্তির শর্ত হিসাবে কাশ্মীরের বেদখল ভূমিখণ্ডের উপর ভারতের পূর্ণ কতৃত্ব স্থাপন। যতদিন এ শর্তে রাজী হবে না পাকিস্তান ততদিন ফিরে পাবে না সে হাতছাড়া পশ্চিমের ভূভাগ। বাংলাদেশের প্রশ্নই আসেনা। ওটা এখন স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভুট্টোর কবরের জমিনটুকুও মিলবে না সেখানে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১