You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.01 | ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার বিবৃতি শুনে সারাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় - সংগ্রামের নোটবুক

কথামুখ

১ মার্চ ১৯৭১ সােমবার দুপুর ০১-০৫ মি. রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার বিবৃতি শুনে সারাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দলে দলে মানুষ অফিস-আদালত, কল-কারখানা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান বনাম বিশ্ব-একাদশের ক্রিকেট খেলা ফেলে হাজার হাজার দর্শক ‘জয় বাংলা’ বলে রাস্তায় নেমে আসে। শহরের সকল অলিগলি থেকে বিক্ষুব্ধ খণ্ড খণ্ড মিছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পল্টনে এসে জমায়েত হয়। মিছিলকারীদের হাতে বিভিন্ন ধরনের লাঠি ও লােহার রড, মুখে স্লোগান বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে।’ পল্টনের জনসমুদ্রে অন্যতম বক্তা তােফায়েল আহমদ বলেন, “আর ৬ দফা, ১১ দফা নয়, এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে।  মুজিব আগেই ‘ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা অনুমান করেছিলেন। এদিন বেলা সাড়ে চারটায় হােটেল পূর্বাণীতে আয়ােজিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ‘অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ঘােষণা দেন এবং ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালনের আবেদন জানান। হাই কমান্ড গঠন আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি গ্রহণের জন্য মুজিবকে ‘সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়। নীতিনির্ধারণী বিষয়াদি ঠিক করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমেদ, তাজউদ্দিন আহমদ ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে নিয়ে দলীয় হাই কমান্ড গঠন করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ড, কামাল হােসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে করা হয় তার সাহায্যকারী। ইতােপূর্বে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের এবং দলের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের যৌথ সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নেতা’, ১. সৈয়দ  আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কাগজ প্রকাশনা, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৪ 

নজরুল ইসলামকে ‘উপনেতা’, অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ‘চীফ হুইপ’ এবং এ এইচ  এম কামারুজ্জামানকে সংসদীয় দলের সচিব নির্বাচিত করা হয়। প্রাদেশিক পরিষদের নেতা’ নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। অসহযােগ ও পতাকা উত্তোলন অকল্পনীয়ভাবে অসহযােগ আন্দোলন চলতে থাকে। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্সের (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম জনসভায় আনুপূর্বিক ঘটনাবলির বর্ণনা করে মুজিব দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ ৩৫-দফা নির্দেশ জারি করেন। বস্তুত এই নির্দেশাবলির মাধ্যমে মুজিব বাংলাদেশের সর্বময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৩ মার্চ লাহাের প্রস্তাব স্মরণে পাকিস্তান দিবসে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রতিরােধ দিবস পালন করা হয় এবং মুজিবের বাসভবনসহ সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ইয়াহিয়ার সাথে ১৬ মার্চ শুরু হওয়া আলােচনার ‘অগ্রগতি নিষ্ফল বর্ণনা করে ২৪ মার্চ তাজউদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আলােচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়।’ ২৪ মার্চ বিকাল থেকে ২৫ মার্চ রাত ১০টা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সাক্ষাৎ করতে আসা সকলকে মুজিব ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আগত প্রায় প্রত্যেকের সাথে তিনি তার পেছনের ঘরে ১ মিনিট করে কথা বলেন এবং একে একে সকলকে বিদায় দেন। ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা তাকে আত্মগােপনের অনুরােধ করার জবাবে তিনি বলেন: আমাকে নিয়ে তােরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগােপন সম্ভব নয় (আত্মগােপনে তিনি অভ্যস্তও নন)। আমার হয়তাে মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।

২. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০১, পৃষ্ঠা ২৯৯

৩.  মুজিবের নির্দেশে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দীকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহাজান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি আসম আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদুস মাখন -এই চার নেতা মিলে ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। অন্যরা প্রস্তাব করা সত্ত্বেও ১১দফা খ্যাত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে সক্রিয় করা বা অন্যান্য ছাত্র নেতাদের নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার প্রস্তাব গ্রহণ না করে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পর নানা অপকর্মের জন্য এরা চার খলিফা ‘ আখ্যা পেযে উপহাসের পাত্র হন কয়েকজন উৎসাহী ছাত্রলীগ কর্মীর উদ্যোগে নিউমার্কেটের ‘এপােলা থেকে কাপড় কিনে ‘পাক ফ্যাশানের ‘ জনৈক অবাঙালি দর্জিকে দিয়ে একটি পতাকা তৈরি করা হয়। সবুজ জমিনে লাল। বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র খচিত পতাকাটির নকশা করেন শিল্পী শিবনারায়ন দাশ। ২ মার্চ বটতলার ছাত্রসভায় যােগদানকারী একটি মিছিলে স্বত:স্ফূর্তভাবে এটি বহন করা হয় এবং জনতার উৎসাহে মঞ্চে তুলে প্রদর্শন করা হয়। এ আদলেই পরে স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি হয়। আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯

শহরের অবস্থার বর্ণনা শুনে তিনি বলেন : আমার কাছে সব খবর আছে। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছাড়ার পরই আক্রমণ শুরু হবে। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে হানাদাররা আমার জন্য ঢাকা শহরের সকল লােককে হত্যা করবে। আমার জন্য আমার জনগণের জীবন যাক-এটা চাই না।’ মার্চের প্রথম থেকেই মুজিব সশস্ত্র সংগ্রামের সমূহ সম্ভাবনা দেখতে পান এবং ১৯ মার্চ তিনি ও কর্নেল ওসমানী আলােচনা করে এর খুঁটিনাটি দিক প্রস্তুত করেন।’ একথা বলা হলেও বাস্তবে সশস্ত্র সংগ্রাম বা স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে মুজিব বা আওয়ামী লীগের কোনাে প্রস্তুতি ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে পুরনাে ঢাকার একটা বাড়িতে সকলের প্রকত্রিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার বাসভবন থেকে বাইরে আসতে রাজি না হওয়ায় সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায় এবং একইসাথে তার সাথে অন্যান্যদের যােগাযোেগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  এই মুহূর্তে তােমরা আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। আর তােমাদের দায়িত্ব তােমরা পালন করবে। মুজিবের এই শেষ আজ্ঞা শিরােধার্য করে ব্যারিস্টার আমীরউল ইসলাম ও ড. কামাল হােসেন তাদের দলনেতা’ তাজউদ্দিনের বাসায় আসেন। তাজউদ্দিন আত্মগােপনে ইতস্তত করছিলেন। ভগ্ন মনােরথ হয়ে বাড়িতে বসেছিলেন নিজেকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে। পরনে লুঙি, গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে কাপড়ের জুতাে, এক কাধে ঝােলানাে ব্যাগ ও অন্য কাধে একটি রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে এলেন তাজউদ্দিন। শুরু হল অনিশ্চিত যাত্রা। ধানমণ্ডির (তৎকালীন) ১৫ নম্বর সড়কের কাছাকাছি এলে আত্মীয়ের বাসায় থেকে যাওয়ার ইচ্ছায় ড. কামাল গাড়ি থেকে নেমে যান (একক সিদ্ধান্তে এই নেমে যাওয়াতেই তিনি গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানে কারাগারে নীত হন)। তাজউদ্দিন ও আমীর-উল লালমাটিয়ায় রেলওয়ের এককালের চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যায়। অপারেশন সার্চলাইট’ এবং পরদিন কার্ফু ২৭ মার্চ ‘পথই ঠিকানা, পথই গন্তব্যে পৌঁছে দেবে’ ভেবে, উভয়ে রায়ের বাজার দিয়ে নদী পার হয়ে, হেঁটে নবাবগঞ্জ পৌছেন। পরদিন তারা মােটরসাইকেল যােগে পদ্মার পাড়ে, এর পরদিন নৌকায় পদ্মা পার হয়ে ঘােড়ায় চড়ে ফরিদপুর, সেখান থেকে রিক্সা-বাস ও হেঁটে মাগুরা এবং এর পরদিন জিপযােগে তারা সােহরাব হােসেনসহ ঝিনাইদহ পেীছেন; এরপর চুয়াডাঙ্গা হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। চলার পথে পদ্মার পাড়ের আগারগাঁওয়ে রাত্রিযাপনকালে স্বাধীনবাংলা বেতারে স্বাধীনতার ঘােষণা শুনতে পান। মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশাের প্রভৃতি স্থানে প্রতিরােধআন্দোলন দেখতে পান। স্থানে স্থানে তারা বৈঠক করে মনােবল ও সংগ্রাম জোরদার করার প্রয়াস পান। অবস্থাদৃষ্টে তাদের মনে হল, সারা বাংলায় গণযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

৪. আমীর-উল-ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস চতুর্থ খন্ড (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব), গ্রন্থলােক, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ১২৩

দেন। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা এবং একটি বেতারস্টেশন স্থাপনের বিষয় আলােচনা হয়। নেতাদের খােজখবর নেয়ার জন্য একটি ছােট বিমানের ব্যবস্থা করা হয়। যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য জেনারেল (অব.) নগেন্দ্র সিংকে দায়িত্ব দেয়া হয়।  দিল্লিতে বসেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একটি ভাষণ রচনা ও টেপ করা হয়। ৮ এপ্রিল কলকাতা ফিরে এসে তারা দেখতে পান, ততদিনে বেশ কিছু দলীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধি এখানে এসে পৌঁছেছেন। কলকাতা পৌছেই তারা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের আভাস পেলেন। এ-কথা রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল যে, তাজউদ্দিন নিজেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সরকার গঠনের সংবাদে ‘অসন্তুষ্ট’ দলীয় নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের এক বৈঠক ইতােমধ্যে কামারুজ্জামানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সাধারণ অভিমত, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্যই দিল্লি যাওয়া হয়েছে। এত তাড়াহুড়া করে দিল্লি না গিয়ে নেতাদের বিশেষ করে হাইকমান্ডের সদস্যদের আসার জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল। তাছাড়া তাজউদ্দিনের স্ব-উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর পরিচয় দান উচিত হয়নি। শহরের বিভিন্ন স্থানে গ্রুপে-গ্রুপে এ-আলােচনা হচ্ছে যা তাজউদ্দিনের জন্য খুবই বিব্রতকর। তাজউদ্দিন ও আমীর-উল কামারুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করলে তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেন এবং সেজন্য রাতে লর্ড সিনহা রােডে। একটি বৈঠক বসে। শেখ ফজলুল হক মণি তার বক্তৃতায় বলেন : স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দি, বাংলার যুবকেরা বুকের তাজা। রক্ত দিচ্ছে, এখন কোনাে মন্ত্রিসভা গঠন করা চলবে না। মলি মন্ত্রি খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। এই যুদ্ধ পরিচালার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে।”

উপস্থিত প্রায় সকলই শেখ মণির বক্তব্য সমর্থন করেন। বক্তব্যটি যেহেতু তাজউদ্দিনকে উদ্দেশ করে, তাই তাঁর পক্ষে পাল্টা জবাব দেয়া শােভন নয় ভেবে আমীর-উল ইসলাম তাদের দিল্লি যাওয়ার সমর্থনে ও শেখ মণির বক্তব্যের বিপক্ষে যুক্তি পেশ করে বলেন : দিল্লি যাত্রার পূর্বে আমাদের জানা ছিল না কারা বেঁচে আছেন এবং কাকে কোথায় পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় যুক্তি হলাে, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দিন ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলেছেন। দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলার এখতিয়ার তাজউদ্দিন ভাইয়ের রয়েছে। তাছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রাথমিক আলােচনা হয়েছে মাত্র। ভবিষ্যতে আরও আলােচনা হবে। তখন দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হবেন। তৃতীয়ত, আমরা বঙ্গবন্ধুর নিয়ােজিত হাইকমান্ড নিয়ে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের পরিকল্পনা করেছি মাত্র।

১০ আমীর-উল-ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০

আমি আরও বললাম, বাংলাদেশ বারাে ভূঁইয়ার দেশ। বারােটি বিপ্লবী কাউন্সিল গড়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয়। আমাদের অবশ্যই আইনগত সরকার দরকার। কেননা, আইনগত সরকার ছাড়া কোনাে বিদেশী রাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার সুযােগ খুব কমই হয়েছে। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার অধিকার একটি আন্তর্জাতিক নীতি। যে কোনাে জনগােষ্ঠীর, তাদের নির্বাচিত সরকার দ্বারা শাসিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের সে গণতান্ত্রিক অধিকারের অবমাননা করেছে। তাই আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার হরণই হচ্ছে জনগণের অধিকার হরণ। শেখ মণির বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য দুটি যুক্তি দিলাম। শেখ মণির প্রস্তাবিত বিপ্লবী কাউন্সিল যদি বিভিন্ন মতাবলম্বীরা দুইটি, পাঁচটি বা সাতটি গঠন করে তাহলে জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধারা কোনটির আদেশ মেনে চলবে না। কোন্ কাউন্সিলের সাথে বিদেশের সরকার সহযােগিতা করবে? এই ক্ষেত্রে একাধিক কাউন্সিল গঠনের সম্ভাবনাই নয় কি? সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকারই হচ্ছে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আজকে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে অন্য কোনাে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হলে জনগণের মৌলিক অধিকারকে অবমাননা করা হবে। সেটা নিশ্চয়ই আমাদের উদ্দেশ্য নয়।” আমীর-উল ইসলামের বক্তব্যের পর মিজান চৌধুরী ও শেখ মণি ছাড়া উপস্থিত সকলে তাদের পূর্বের মনােভাব পরিবর্তন করেন। কামারুজ্জামান আমীর-উলকে ডেকে শেখ মণির কথা অনুযায়ী বিপ্লবী পরিষদ গঠন করা যায় কিনা পুনঃ জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে আমীর-উল ‘তা করা হলে যুদ্ধ বিপন্ন হবে’ বলায় তিনি আর কোনাে প্রতিবাদ করেননি। সর্বশেষে তাজউদ্দিন বক্তৃতা দেন। উপস্থিত সকলে সরকার গঠন সংক্রান্ত তার বক্তব্য মেনে নেন। একটি বড় বিপর্যায়ের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধ রক্ষা পায়। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী দলীয় নেতৃবৃন্দের খোঁজে ১০ এপ্রিল বিমানযােগে বিভিন্ন অঞ্চল সফরের ব্যবস্থা করা হয়। বিমানটি ছিল খুবই ছােট। ৫/৬টি আসন। তাতে চড়েই তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, শেখ মণি, তােফায়েল আহমেদ, আমীর-উল ও নগেন্দ্র সিং আগরতলা রওনা হন। বিকালে বাগডােগরা বন্দরে বিমান থেকে নেমে জিপে সকলে শিলিগুড়ি যান। শহর থেকে অনেক দূরে সীমান্তের খুব কাছে একটি বাংলােতে গােলক মজুমদার তাদের অভ্যর্থনা জানান। এখানে কোনাে একটি জঙ্গল থেকে গােপন বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দিনের ঐ টেপকৃত ভাষণ প্রচারিত হবে। এ সময় তােফায়েল আহমদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেখ মণি কিছু নির্দেশ সহ তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন। মনসুর আলীও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তার সাথে এ-সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে আমীর-উল আলােচনা করেন। ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে প্রকৃত প্রস্তাবে

১১.  আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪১-৪২

তিনিই প্রধানমন্ত্রী পদের স্বাভাবিক দাবিদার। অপর একটি সূত্রমতে, আনুপূর্বিক ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করে মনসুর আলী অভিমত দেন যে, ‘তাজউদ্দিন আহমদের রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিকতা সঠিক হয়নি। তবু বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীরূপে তাজউদ্দিনকে মেনে নেয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই। আমীর-উলকে তার মত জানিয়ে মনসুর আলী বলেন, তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কোনাে আপত্তি করবেন না। হাই কমান্ডের পাঁচজনের মধ্যে তিনজন সম্মত হওয়ায় ধারণা করা হয়, তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীরূপে মেনে নিতে প্রস্তাবিত উপ-রাষ্ট্রপতি তথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আপত্তি করবেন না। আর চারজন একমত হলে খন্দকার। মােশতাককেও রাজি করানাে সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণ এবার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারের পালা। রেকর্ডকৃত ক্যাসেট গােলক মজুমদারের কাছে দেয়া হল। তিনি তা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে চলে গেলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন শেখ মণি। তিনি আগরতলা গিয়ে জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক করে সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। অন্যথায়, বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।” এরূপ অবস্থায় আবার এগিয়ে এলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তার ভাষায়: আমি সরকার গঠনের পক্ষে পুনরায় যুক্তি দিলাম। আমি বললাম, সরকার গঠন করতে বিলম্ব হলে সংকট আরাে বৃদ্ধি পাবে এবং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া সরকার গঠনের পরিকল্পনা তাে নতুন কিছু নয়। মনসুর ডাই ও কামারুজ্জামান ভাই তাজউদ্দিন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মােশতাক আহমদের তখনাে দেখা নেই। তারা কোথায়, কী অবস্থায় আছেন, সে খবর এখনাে আসেনি। ইতিমধ্যে বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সরকার গঠনে বিলম্ব হলে তাও নস্যাৎ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে ভারত-সরকারকে আমরা আশ্বাস দিয়েছি। তাতে বিলম্ব হলে আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও তারা সন্দেহ পােষণ। করবেন। আমাদের মধ্যে যে কোন্দল রয়েছে কোনাে অবস্থাতেই তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়া উচিত নয়। ভারত সরকারও জানেন, আমাদের বক্তৃতা শিলিগুড়ির এই জঙ্গল থেকে আজ প্রচারিত হবে। আমার এসব কথা শেখ মণি মানতে রাজি নন। বেশি করে বুঝাতে চাইলে শেখ মণি জানান, তারা বঙ্গবন্ধু থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারাে প্রশ্ন তােলা উচিত নয়। এ সময় তাজউদ্দিন ভাই আমাকে বলেন, আমি যেন গোলক মজুমদারকে জানিয়ে দেই যে, প্রধানমন্ত্রীর

১২. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৫ ১০ চিত্তরঞ্জন সূতার এই বেতার-বক্তৃতার প্রচার বন্ধ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ৪২ জন আওয়ামী লীগ ও যুব নেতার স্বাক্ষর সংবলিত একটি প্রতিবাদলিপি পাঠান ডি. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০১) আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৪ – ৪৫

বক্তৃতা আজ প্রচার করা হবে না। এ-ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তাকে যথাসময়ে জানানাে হবে। গােলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে আজ বক্তৃতা প্রচার করা হবে না। একথা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘বিলম্ব করা কি ঠিক হবে?’ তিনি বলেন, যে-মুহূর্তে সবকিছু ঠিক-ঠাক সে-মুহূর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে যে প্রশ্ন দেখা দেবে, তা আমরা ভেবে দেখেছি কিনা। ইতিমধ্যে রেকর্ড-করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে (জঙ্গলে) পৌছে গেছে। আমি গােলক মজুমদারকে বললাম, ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে থাকেন তাহলে প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটিমাত্র সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছিলাম। এই দিন ছিল দশই এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দিন ভাই ও শেখ মণি আছেন। রাত তখন সাড়ে ন’টা। সেই আকাঙিক্ষত মুহুর্ত আসল। প্রথমে আমার কণ্ঠ ভেসে আসল। ঘােষণায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হল। সারা বিশ্ববাসী শুনল স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার-বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল।

পরদিন ১১ এপ্রিল খুব নিচু দিয়ে বিমান উড়িয়ে দু’দেশের সীমান্ত সংলগ্ন বন্দরে নেমে নেমে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের খোঁজ নিতে গিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নানকে পাওয়া যায় এবং সকলে আগরতলা পেীছেন। সীমান্তবর্তী বিমানবন্দরেই তাজউদ্দিন সৈয়দ নজরুলকে একান্তে গতদিনগুলাের ঘটনাবলি অবহিত করেন। তিনি সব জেনে খুশি হন এবং তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মােবারকবাদ জানান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান পদে ওসমানীর দায়িত্ব গ্রহণ ইতােমধ্যে কর্নেল ওসমানী, খন্দকার মােশতাক, এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী সহ অনেক নেতাকর্মী আগরতলা এসে পৌঁছেছেন। সার্কিট হাউস পুরােটা বাংলাদেশীতে পূর্ণ। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং ভিন্ন একটি ঘরে অবস্থান করেন। ওসমানী এরই মধ্যে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরি করে ফেলেছেন। তাকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানাে হল। তিনি এর পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন।

১৪..  ২৫ মার্চ রাতে সৈয়দ নজরুল তার আত্মীয় ডা. আলীম চৌধুরীর বােনের পুরানা পল্টনের বাসায় আসেন। ২৯ মার্চ তাকে পরচুলা, শাড়ি ও বােরকা পরিয়ে অন্য আত্মীয় আহমেদ সাহেবের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি প্রথমে কিশােরগঞ্জে গ্রামের বাড়ি এবং পরে ভারত যান ১৫ আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা  ৪৮

মন্ত্রীসভা চূড়ান্তকরণ ও মুজিবনগরে শপথগ্রহণ। রাতে খাবারের পর নেতৃবৃন্দের বৈঠক শুরু হয়। খন্দকার মােশতাক খুবই মনঃক্ষুন্ন । পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার পদে প্রার্থী হিসেবে তার নাম প্রস্তাবিত ছিল।” নিজেকে তিনি সবসময় সিনিয়র আওয়ামী লীগার ভাবতেন। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। সেটার সম্ভাবনা নেই দেখে তিনি খেদের সাথে বলেন, তাকে যেন মক্কায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং মৃত্যুর পর লাশ যেন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সারারাত ধরে শলাপরামর্শ চলে। অবশেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাওয়ার শর্তে তিনি মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হন। বৈঠকে ইতােমধ্যে নেয়া সকল পদক্ষেপ অনুমােদন দেয়া হয়। এ বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। এই বৈঠকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভবিষ্যৎ। নেতৃবৃন্দ এ বৈঠকে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। ১৭ এপ্রিল দুপুরে মুজিবনগরে মন্ত্রীসভা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্ণনায় : কিছু লােক সেখানে (ছােট একটি মঞ্চে) দৌড়াদৌড়ি করে চেয়ার সাজাচ্ছে, অধিকাংশই হাতল ভাঙা, কাছাকাছি গ্রামের বাড়িগুলাে থেকে যােগাড় করে আনা। জায়গাটিকে ঘিরে রাইফেল আর এলএমজি হাতে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পঁচিশ তিরিশজন সৈন্য, তাদের ঠিক মুক্তিবাহিনীর ছেলে বলে মনে হয় না, খুব সম্ভবত প্রাক্তন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের একটি বিদ্রোহী বাহিনী।…। আশেপাশের গ্রাম থেকে ধেয়ে আসছে বিপুল জনতা। অস্ত্রধারী সেনাদের বৃত্ত ভেদ করে তারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারছে না বলে অনেকেই আমগাছগুলােতে চড়তে শুরু করেছে। মাহবুব উদ্দীন ও তওফিক এলাহী মতান্তরে ইপিআর-এর ৪ উইং-এর একটি সুসজ্জিত দল ক্যাপ্টেন মাহবুবুল হাসানের নেতৃত্বে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘােষণা পত্র ১৭. এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যকারী? (অনুবাদ সােয়দ করিম ও হাফিজুর রশিদ হীরন), শিখা প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৬৬ মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার একটি আমবাগান। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এ স্থানকে ‘মুজিবনগর নামকরণ করেন। পরে এ নামে উপজেলা হয়েছে। এই শপথানুষ্ঠান ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় হওয়ার কথা ছিল। চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করার কথা প্রকাশ হয়ে পড়ায় ১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। এর পর মানচিত্র দেখে মুজিবনগরকে উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ব-পশ্চিম, দ্বিতীয় খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৮৫-৮৭। আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪ ও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ রাইফেলস’ স্মরণিকা ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৭-১৪ স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি ১০ এপ্রিল ১৯৭১ প্রকাশিত হয়। এর পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট ১ পড়ুন

পাঠ করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান। ভাষণ দেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান। দেশী-বিদেশী বহু সাংবাদিক অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই সংবাদ পরিবেশ করে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ায় সহায়তা করেন। ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র প্রকাশ ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের ভাষণ বেতারে প্রচার এবং ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সদস্যদের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ স্বাধীনতা সগ্রামকে একটি ভিত্তির উপর স্থাপন করায়। কিন্তু সরকার গঠনের বিরুদ্ধপক্ষও বসে থাকেনি। তারা তাজউদ্দিনের প্রতি অধিকাংশের সমর্থন নেই’ বলে অপপ্রচার করে। এই অবস্থায় শিলিগুড়ির জঙ্গলে ৫ ও ৬ জুলাই আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ ও দলীয় নেতাদের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সরকারের কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে খােলাখুলিভাবে বিস্তারিত আলােচনার পর মুজিবনগর সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের প্রতি আস্থা ও সমর্থন প্রকাশ করা হয়। এই সমর্থনের উপর ভিত্তি করেই তাজউদ্দিনের নেতৃতে মুজিবনগর সরকার যুদ্ধসহ যাবতীয় কাজ পরিচালনা করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশ শত্রুমুক্ত হয়।

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান