বাংলাদেশে নবযুগের ডাক
যশহাের শহর মুক্ত হওয়ার পর সেখানে প্রথম জনসভায় বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আমেদ স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই সরকারের নীতিগুলি ঘােষণা করেছেন। যে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তারা এই ঘােষণা করেছেন সেটা লক্ষ্য করে ভারতবর্ষের মানুষ গভীর সন্তে াষৰােধ করবেন। কেননা, তাদের এই ঘােষিত নীতিগুলি ভারতবর্সের মানুষদেরও স্বীকৃত নীতি। ভবিষ্যতে ভারত তার চলার পথে প্রতিবেশি দেশটিকে সহযাত্রীরূপে দেখতে পেলে নিশ্চয়ই গভীরতর আত্মবিশ্বাসের বলে বলিয়ান হবে।
বাংলাদেশ সরকার আগেই ঘােষণা করেছেন, তারা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ অনুসরণ করবেন। প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম শনিবারের জনসভায় যা বলেছেন তা থেকে এটা পরিস্কার যে, তারা তাদের এই আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য তারা সামান্যতম বিলম্ব ও করতে চান না। তিনি জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে কোন সাম্প্রদায়ীক দলকে থাকতে দেওয়া হবে না এবং মুসলিম লীগ, নিজামে ইসলাম, জামাতে ইসলাম ও পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক পার্টিকে নিষিদ্ধ করার জন্য তিনি শিগগিরই অর্ডিন্যান্স জারী করবেন। ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের শুভাকাঙ্খীরা তার এই সিদ্ধান্তকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দিত করবেন। সাম্প্রদায়ীক রাজনীতির বিষময় ফল এই উপমহাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন যাবৎ ভােগ করেছেন, এখনও ভােগ করছেন। ভারতবর্ষে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রাদর্শ ঘােষণা করে সেইবিষাক্ত ইতিহাসের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছি; কিন্তু আমাদের সেই চেষ্টাও পুরােপুরি সফল হয়নি। আমাদের ঐ ব্যর্থতার অন্যত কারণ হল পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সম্পূর্ণ বর্জন করে আমাদের ঘরের পাশেই সেই বহু পুরাতন ক্ষতটিকে জীইয়ে রেখেছিল। ইতিমধ্যে, বাংলাদেশের মানুষ অনেক দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে উপলব্ধি করেছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক এবং গােষক রা ঐশ্লামিক রাষ্ট্রের স্লোগানটি এতকাল ব্যবহার করে এসেছে শুধু পূর্ববঙ্গের বাঙালীকে চিরবঞ্চনার মধ্যে মগ্ন রাখার হীন উদ্দেশ্যে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য গণতন্ত্রী দল বাংলাদেশের মানুষকে যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের মূল্য বুঝতে শিখিয়েছে। ঘৃণ্য হিন্দু বিদ্বেষের পুঁজি ভাঙ্গিয়ে যেসব দল আজকের পূর্ব বাংলায় ও রাজনীতির কারবার চালাবার অভিপ্রায় রেখেছিল দেশের মানুষ জোটের বক্সের মারফৎ তাদের সুনিশ্চিভাবে ও সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ সরকার আজ সেই দলগুলিকে নিষিদ্ধ করলে যে সে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অভিমতেরই উপযুক্ত মর্যাদা দেবেন তাতে সেন্দহ নেই। বাংলাদেশ সরকার যে তাঁদের সূচনাতেই এই ব্যবস্তা নিতে যাচ্ছেন, সেটাও সুলক্ষণ। অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়ীকতা নামক বিষবৃক্ষটির প্রাণশক্তি এতই প্রবল যে, খুব শক্ত হাতেই গােড়াতেই এর জড় না মরলে পরে বিপদে পড়তে হয়। বাংলাদেশের নতুন সরকার যদি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শটিকে একটা দৃঢ় ও অনড় ভিত্তির উপর স্থাপিত করতে পারেন তাহলে বারতবর্ষেও সাম্প্রদায়ীকতাবিরােধী শক্তি বাড়বে।
শনিবারের জনসভায় বাংলাদেশের নেতাদের বক্তব্য থেকে এটও পরিস্কার যে, আশ্রয়প্রার্থীদের সকলকে যথসম্ভব অল্প সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তাঁরা বদ্ধপরিকর। শুধু যে তাঁদের নিজেদের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তাই নয়, যেসব সম্পত্তি তারা ফেলে এসেছেন সেগুলিও পুনরুদ্ধার করে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কাজটা অবশ্যই সহজ হবে না। এইসব পরিত্যক্ত সম্পত্তির কিছু কিছু ইতিমধ্যে হাতছাড়া হয়ে থাকতে পারে। বর্তমান দখলদারদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় এগুলি ফিরিয়ে দেবে না বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বাধ্য করতে হবে। নতুন সরকার যে তাদের সেই দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত সেকথা ঐ সরকারের নেতারা শনিবার যশােহর সভায় স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে, আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাদি করার জন্য ভারত সরকারের পুনর্বাসনমন্ত্রী শ্রী আর কে খাদিলকরের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামানের আলােচনা আরম্ভ হয়েছে। এই আলােচনার ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের আশ্রয়পার্থীদের দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সুষ্ঠু কার্যসূচী তৈরি করা যাবে বলে আশা করা যায়। বহু বাধা ও অসুবিধার মধ্যেও এবং বাংলাদেশ পুনর্গঠণের অন্যান্য জরুরী চাহিদার মধ্যেও আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নটি বাংলাদেশ সরকার যে গভীর আন্তরীকতার সঙ্গে বিবেচনা করেছেন সেটা খুবই আশাপ্রদ।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১