You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.14 | শ্রীমতী গান্ধীর হুঁসিয়ারী | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শ্রীমতী গান্ধীর হুঁসিয়ারী

গর্জে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। নেপথ্যে পাক-দোস্তরা করছে ভারতেরর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ! তারা পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাবার মতলব আটছে। ইতিমধ্যেই তুরস্ক কাজে নেমে পড়েছে। উসখুস করছে ইরান। প্রেসিডেন্ট নিকসন চিন্তামগ্ন। তিনিও নাকি পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণের কথা ভাবছেন। নে এতসব পায়তারা? মহা বিপদে পড়েছে পাকিস্তান। ভারত আক্রমণ কনতে এসে পালটা মারে সে জর্জরিত। বাংলাদেশ হাতছাড়া। ঢাকার পাকবাহিনী অন্তিম দিনের অপেক্ষায়। দু-একদিনের মধ্যেই ওদের উপর নেমে আসবে ন্যয়ের শানীত দণ্ড। পশ্চিম পাকিস্তান ক্ষত বিক্ষত। তার দেহ থেকে অঝরে ঝরছে রক্ত। জওয়ানদের আঘাতের বিরাম নেই। নিরুপায় ইয়াহিয়া খান আরিকার কাছে পাঠিয়েছেন আর্তি-সেন্টো এবং সিয়াটো সামরিক জোটের শলীক আমি। তােমাদের মত মুরুব্বী থাকতে আমার পিঠে পড়ছে এলােপাথাড়ি লাথি। হাতে অস্ত্র দাও। দেখি শেষ রক্ষা করতে পারি কিনা। প্রেসিডেন্ট নিকসন তাই চিন্তামগ্ন। শ্ৰীমতী গান্ধীর মর্মবেদী জিজ্ঞাসা-কি উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল সেন্টো -সিয়াটো সামরিক জোট? অবশ্যই কমিউনিজমের সম্প্রসারণ প্রতিরােধের জন্য। কেন মার্কিন অস্ত্রে সাজানাে হয়েছিল পাক-বাহিনী? চীন এবং সােভিয়েট রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহারের জন্য। মার্কিন কর্তৃপক্ষ কি সেদিন ভারতকে দেয় নি প্রতিশ্রুতি-পাকিস্তানকে দেওয়া মার্কিন সমর সম্ভার ব্যবহৃত হবে না ভারত আক্রমণে। কোথায় ছিল ১৯৬৫ সালে এই প্রতিশ্রুতির দাম? কোথায় আজ সামরিক জোটের বিঘােষিত উদ্দেশ্যের রুপায়ণ? যে চীনকে ঠেকাবার জন্য সিয়াটো জোট সেই চীনই তাদের একান্ত দোসর।
আমরা জানি সােজা কথার জবাব দেবেন না প্রেসিডেন্ট নিকশন এবং তার বংশবদরা। প্রতিশ্রুতি খেলাপে মার্কিন কর্তাদের জুড়ি নেই। তারাই না বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীকে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের আগে তারা পাকিস্তান পাঠাবেন না মার্কিন অস্ত্র? তুরস্ক পাঠাচ্ছে কার অস্ত্র? মার্কিন অনুমােদন না থাকলে কি কনে পাকিস্তানে সে পাঠাতে পারে মার্কিন অস্ত্র? প্রেসিডেন্ট নিকসনই বা ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্র দেবার কথা চিন্তা করেছেন কোন যুক্তিতে? এ লড়াইটা কাদের মধ্যে? ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে, ভারত কি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র? সে কি গলাটিপে মেরেছে গণতন্ত্র? স্বজাতির রক্তে লাল করেছে দেশের মাটি? এক কোটি শরণার্থীকে ঠেলে পাঠিয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে? অপরাধী পাকিস্তান। এই উপমহাদেশে অশান্তির জন্য সেই দায়ী। ইয়াহিয়া খানই প্রথম আক্রমণ করেছেন ভারত। গত ৩রা ডিসেম্বর অতিরিক্ত বিমান হানা চালিয়েছেন তিনি। আর রাষ্ট্রসংঘের মার্কিন প্রতিনিধি নির্লজ্জভাবে বলেছেন-ভারত আক্রমণকারী। যেসব আরব রাষ্ট্র মার্কিন তালে নাচছেন তারা একবার ফিরে তাকান পিছনের দিকে। আরব-ইস্রাইল লড়াই এর সময় এই আমেরিকাই কি ইস্রইলকে আগলে রাখেনি? রাষ্ট্রসংঘ ইস্রাইলকে আক্রমণকারী চিহ্নিত করার প্রচেষ্টায় সে কি বাধা দেয় নি? এরা কি ভাবছেন-সেদিনের মার্কিন ভাষ্য মিথ্যা এবং আজকের ভাষ্য সত্য। ক’দিন চলবে এই আত্ম প্রতারণা? সামনে আরবের বিরাট দুর্দিন। তার বিরাট ভূমি ইস্রাইলি দখলে। গায়ের জোরে হারানাে জমি উদ্ধার করতে গেলে যুদ্ধ আনবার্য। তখন তারা দেখবেন মার্কিন ভূমিকা। আজ যে বিশ্বাসঘাতকতা করছে আরব রাষ্ট্রগুলাে সম্ভাব্য বিপদের দিনে তাদের কি প্রত্যাশা ভারতের কাছে? আগের মতই অকুণ্ঠ সমর্থন, না দূরে দাড়িয়ে মজা দেখা? মনে রাখবেন আরব রাষ্ট্রগুলাে -এক মাঘে শিত যায় না। প্রতিবছর ঘুরে ফিরে মাঘ আসে।
প্রেসিডেন্ট নিকসনকে চিনতে বাকি নেই। ১৯৫৪ সালে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনিই কি উদ্যগী হন নি পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন অস্ত্র সাহায্যচুক্তি সম্পাদনে? এখও তার আশা- পাক ভারত উপ মহাদেশে বজায় থাকবে শক্তি সাম্য। পাকিস্তানি বাজারে অক্ষুন্ন রইবে মার্কিন পণ্যের একচেটিয়া অধিকার।এই আশায় ছাই পড়েছে। স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ। ঢাকার অবরুদ্ধ পাক-বাহিনীর সমূল উচ্ছেদের দেরী নেই। একদিকে রাষ্ট্রসংঘ চলছে ডুবন্ত ইয়াহিয়াকে টেনে তােলার মার্কিন পায়তারা এবং অপরদিকে তার হাতে গুঁজে দিচ্ছে সে অস্ত্রশস্ত্র। হয়ত তাতে পিছিয়ে যাবে চুড়ান্ত ফয়সালার দিন। চীনের চিন্তাধারাও চলছে মার্কিন তালে। ওরা একসঙ্গে নেমেছে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হননে। জীইয়ে তােলার ষড়যন্ত্র আটছে পাকিস্তানের স্বেরতন্ত্র এবং নরঘাতি জঙ্গীবাদ। কমিউনিষ্ট বিরােধী সামরিক জোটের পারস্পরিক সাহায্যের ধারা ভারতের বিরুদ্ধে প্রয়ােগ করতে চাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। আর তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। তার বুদ্ধির গােড়ায় ধোয়া দিচ্ছে কমিউনিস্ট বলে কথিত বিপ্লবী চীন। যত খুশি চক্রান্ত করুক নীতিভ্রষ্ট বিদেশী রাষ্ট্রনায়কের দল। ভারতের পঞ্চান্ন কোটি নরনারীর মন ইস্পাতে গড়া। তাদের নায়িকা শ্রীমতী ইন্দীরা গান্ধীর হুসীয়ারী-যত খুশি খােলস বদলাক সামরিক জোটগুলাে। সঙ্গে নিতে পারে তারা চীনকে। কোন ব্ল্যাকমেইলের সামনে নতি স্বীকার করবে না ভারত। পাক জঙ্গীশাহীর কবর সে দেবে। আর এই কবরের উপর ঢালবে যুদ্ধবাজদের তাজা রক্ত। তার উপর স্মারক হিসাবে রাখবে রণক্ষত্রে বিধ্বস্ত চীনা মার্কিন মরনাস্ত্র।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১