মুজিবের মুক্তির জন্য সংগ্রাম
বিজয়গৌরবের এই পরমলগ্নে ভারতের ও বাংলাদেশের মানুষ কিছুতেই ভুলতে পারে না যে, আজকের আনন্দ ও আশার শরিক হওয়ার জন্য আমাদের মধ্যে নতুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবর রহমান। উপস্থিত নেই। ঢাকায় যে রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়েই একদিন তিনি বাংলাদেশ থেকে ২৪ বছরের অপশাসনের শৃঙ্খল মােচনের আহ্বান দিয়েছিলেন, সেখানেই তার সেই আহ্বানের সার্থক পরিসমাপ্তি ঘটল। অথচ সেই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে বরণীয় মানুষটিই ছিলেন না। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের কোন এক অজ্ঞাত কারাগারের প্রাচীর ভেদ করে এই শুভসংবাদ তার কাছে পৌছেছে কিনা তাও আমরা জানি না। বাংলাদেশ মুক্ত, কিন্তু সে-দেশের স্রষ্টা আজও নন, এই বেদনা কিছুতেই ভােলায় নয়। অতি সঙ্গতভাবেই বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান, এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের বক্তৃতায় শেখ মুজিবর রহমানকে স্মরণ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী শুক্রবার লােকসভায় বলেছেন যে, বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষকে সাহায্য করার জন্য ভারত গত ৩১ মার্চ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা সে পূরণ করেছে। কিন্তু একথা বলা দরকার যে, বঙ্গবন্ধুকে জল্লাদের কারাগার থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশে না আনা পর্যন্ত ঐ প্রতিশ্রুতির একটা অংশ অপূর্ণ থেকে যাবে। শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার এখন যে চেষ্টা করবেন তাতে ভারতকেই সবচেয়ে বেশী করে সহায়তা দিতে হবে। শেখ মুজিব শুধু যে বাংলাদেশের মানুষের নয়নের মণি অথবা ভােটে নির্বাচিত বৃহত্তম দলের নেতা তাই নয়, তিনি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রতি। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তারা পরস্পরের সংগ্রামের সাথী ও ঘনিষ্ঠ মিত্র। প্রতিবেশী এই বন্ধু রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে মুক্ত করে আনার জন্য ভারতকে সর্বশক্তি প্রয়ােগ করতেই হবে। এটা ভারতের পবিত্র কর্তব্য ও দায়। একথাও বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তি সম্পূর্ণ হওয়ার পর এটাই এখন ভারত সরকারের বৃহত্তম কর্তব্য। সেজন্য এখনই বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একযােগে ভারতের কূটনৈতিক অভিযান আরম্ভ করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ-বিষয়ে এখন কি করবে সেটা ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ সাগ্রহে লক্ষ্য করবে। প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ঠিকই লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য, অন্ততপক্ষে তাঁর সঙ্গে গােপনে আলােচনা জন্য, ইসলামাবাদের উপর চাপ দিত, তাহলে এই যুদ্ধ বাধত না। কিন্তু এখনও আজকের বাস্তব পরিস্থিতির মুখােমুখী দাঁড়িয়েও, কি ওয়াশিংটনে কিছু সুবুদ্ধি জাগবে না? মার্কিন সরকার ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত অর্থ সাহায্য তারা দেবেন। এই ঘােষণার মধ্য দিয়ে সামান্য কিছু বাস্তববুদ্ধির আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট নিবসনের আশেপাশে সৎপরামর্শ দেওয়ার মত কেউ যদি থেকে তাকেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্টকে বলবেন যে, ভারতে ও সদ্যোজাত রাষ্ট্রটিতে আমেরিকা যদি এখনও কিছু শুভেচ্ছার সঞ্চয় রাখতে চায় তাহলে তা করার শ্রেষ্ঠ উপায় হল ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য চেষ্টা করা। নির্বাচিত জননেতাকে মুক্তি দিতে হবে এবং তাকে তার নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার সুযােগ দিতে হবে, ওয়াশিংটন জোর করে একথা বললে ইয়াহিয়া চক্রের সাধ্য নেই সেকথা অমান্য করার।
কূটনৈতিক অভিযান ছাড়াও অন্য যত রকমভাবে ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব তা করতে হবে। লেঃ জেনারেল নিয়াজি সহ পাকিস্তানের ছােটবড় অনেক সেনাপতি এবং ঢাকার পুতুল সরকারের গবর্ণর ডাঃ মালিক সহ অনেক অসামরিক পদাধিকারী এখন ভারতের মধ্যে। তাদের ভিতর অনেকে জঘন্য অপরাধ অপরাধী। শেখ মুজিবর রহমান মুক্ত মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসার আগে এই মানুষগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে অক্ষতদেহে ফিরে যাচ্ছেন, এটা আমরা দেখতে চাই না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১