খসে পড়েছে চীনের বিপ্লবী মুখােশ
আবার হুঙ্কার ছেড়েছে চীন। এটা যুদ্ধযাত্রার তুর্য নিনাদ নয়, গ্রামের ঝগড়াটে বিধবার রসনা আস্ফালন। পিকিং বলছেন, ভারত আক্রমণকারী। তার সৈন্যদলই প্রথম ঢুকেছে পূর্ব বাংলায়। বিপন্ন করে তুলেছে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব। নয়াদিল্লীই শরণার্থীদের ফিরতে দেন নি স্বদেশে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় ভারতের নাক গলানাে বরদাস্ত করবে না চীন। সঙ্কটকালে তার সত্তর কোটি নরনারী দাঁড়াবেন পাক জনসাধারণের পাশে। পাকিস্তানে যাবে চীনা অস্ত্র। ইয়াহিয়ার হাত জোরদার করবেন পিকিং নেতারা। কি সাংঘাতিক প্রতিজ্ঞা। চৈনিক বিপ্লবী বারুদ জমা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। ভারতীয় বিমানবহর তাতে দিচ্ছে আগুন। পুড়ে ছাই হচ্ছে স্বৈরতন্ত্রের জতুগৃহ। স্বাধীন বাংলাদেশে পাক-বাহিনী পর্যদস্ত। যে কটি পাক সৈন্য আছে সেখানে তাদের আত্মসমর্পণ কিংবা ধ্বংস অনিবার্য। তবু বন্দুক কাঁধে নিচ্ছে না চীন। স্বস্তি পরিষদের তার প্রতিনিধি শুধু করছেন ভারতের বাপান্ত। ঠোকাঠুকি বাধাচ্ছেন সােভিয়েট প্রতিনিধির সঙ্গে। তবে কি যথেষ্ট সঙ্কটের মধ্যে পড়েন নি ইয়াহিয়া খান? যদি না পড়ে থাকেন তবে কেন স্বস্তি পরিষদে চীন করছে।
মাতামাতি? পাক-সৈন্যদের হাতে আছে চৈনিক অস্ত্র। তা নিয়ে তারা ছুটছেন দিল্লী দখলের অভিযানে। এমনি বরাত তাদের, জোয়ানদের আঘাতে চুরমার হয়ে যাচ্ছে চীনা ট্যাঙ্ক। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রাগারে প্রতিদিন জমা হচ্ছে চৈনিক সমর সরঞ্জাম। পাক দুশমনদের হাত থেকে এগুলাে ছিনিয়ে নিচ্ছেন মুক্তিযােদ্ধারা। একবার পিছন ফিরে তাকান মাও সে তুং। গৃহযুদ্ধের সময় তিনিও এমনি করেই দখল করতেন চিয়াং কাইশেকের সৈন্যদলের হাতিয়ার। ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৈপ্লবিক রূপ পরিবর্তনের কি ঘনঘটা। সেদিনের বিপ্লবীরা আজ পৃথিবীর জঘন্যতম প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রাণের দোসর।
অজান্তে পিকিং স্বীকার করেছেন নিজের কৃতকর্মের এক অপ্রকাশিত কাহিনী। তারা একই পর্যায়ে ফেলেছেন। তিব্বতী এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের। গােটা দুনিয়া জানে, গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং পাইকারী হারে নারীধর্ষণ চালিয়ে ইয়াহিয়ার ঘাতকবাহিনী বাংলাদেশে সৃষ্টি করেছিল নিদারুণ সন্ত্রাস। তারই পরিণাম, ভারতে এক কোটি শরণার্থীর আশ্রয় গ্রহণ। তিব্বতেও কি অনুরূপ নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল চীনের বিপ্লবী বাহিনী? সিংকিয়াং থেকে মুসলিম বিতাড়নের মূলেও কি ছিল এমনিতর বিপ্লবী প্রয়াস? পাকিস্তানের জনগণের দুঃখে চোখের জল ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। এই রাষ্ট্রটি যখন ছিল অখণ্ড তখন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বলতে কাদের বােঝাত? তারা অবশ্যই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা। এদের সত্যিকারের প্রতিনিধি শেখ মুজিবর রহমান এবং তার দল আওয়ামীলীগ। এদের পাত্তা দিচ্ছেন না পিকিং নেতারা। বুকে জড়িয়ে ধরছেন পাকিস্তানের জঙ্গী শাসককুলকে এবং তাদের ভাড়াটিয়াদের। এরা কাদের প্রতিনিধি এবং কোন স্বার্থের জিম্মাদার? চীনের কাছে আজ প্রগতিবাদী দুনিয়ার জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা-ইয়াহিয়া এবং মুজিবুরের মধ্যে কে বেশী জনদরদী? মুক্তিবাহিনী এবং পাক-সৈন্যদলের মধ্যে কারা বেশী প্রগিতিবাদী? আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়ার মধ্যে কে বেশী সমাজতন্ত্রী? এসব প্রশ্নের খােলাখুলি জবাব দিতে হবে পিকিংকে। ঘােমটার নীচে খেমটা নাচ আর কতদিন চালাবেন এশিয়ার এই মেকী বিপ্লবীরা?
অন্যের আভ্যন্তরীণ সমস্যায় হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবেন না চীন। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে তার অগাধ বিশ্বাস। বিড়াল তপস্বীর কি চমৎকার নীতিজ্ঞান? ব্রহ্মদেশের বিদ্রোহীদের সামরিক শিক্ষা এবং অস্ত্র মদৎ দিচ্ছে কে? অপরের সমস্যায় নাক গলাতে অনিচ্ছুক এই চীন। সশস্ত্র বিপ্লবের দ্বারা আফ্রো-এশিয়ার গণতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলােকে উচ্ছেদের জন্য দিনের পর দিন উস্কানী দিত কে? অবশ্যই পিকিং-এর সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার। ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টিকে অকাল বিপ্লবের প্রেরণা জুগিয়েছিল কে? সহাবস্থান আদর্শের ভেকধারী এই চীন। ভারত ভােলেনি এই রাষ্ট্রটিকে। সরল বিশ্বাসে একদিন একান্ত সুহৃদ হিসাবে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল ভারত। ১৯৬২ সালে ভারতের পিঠেই ছুরিকাঘাত করেছিলেন এই পিকিং। ঘরের সামনে তাইওয়ান এবং হংকং উদ্ধারে যাদের অনীহা তারাই এখন বাংলাদেশ উদ্ধার নামবেন আসরে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের হাত থেকে এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে ছিনিয়ে নিয়ে ইয়াহিয়াকে দেবেন উপহার। আমরা জানি, বেশীদূর এগুতে পারবেন না তারা। এবার থাবা মেলে দাঁড়িয়ে আছে সােভিয়েট রাশিয়া। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত লড়াই এর সঙ্কটমুহূর্তে ভারত আক্রমণের হুমকী দিয়েছিল চীন। এ ধরনের হুমকী এখনও আসেনি। ইয়াহিয়ার ক্লেদাক্ত হিয়া আজ অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত। তার যশাের দুর্গের পতন সম্পূর্ণ। ভারত এবং বাংলাদেশের সাড়ে বাষট্টি কোটি নরনারীর পদাঘাতে ইসলামাবাদের ঔদ্ধত্বের আসন টলমল। গণতন্ত্রের অগ্রগতি দুর্বার। এগিয়ে আসুন বিপ্লবী পিকিং। রক্ষা করুন মানবদ্রোহীর হৃত মর্যাদা। বাঁচান ইয়াহিয়ার কায়েমী স্বার্থ। আগলান ইসলামাবাদের প্রাক্তন জমিদারী বাংলাদেশ। আমরা জানি, গ্রাম্য বিধবার উচ্চগ্রামী রসনা গর্জায়। কখনই শক্তিমান প্রতিপক্ষের মােকাবিলায় সে পা বাড়ায় না। দুনিয়া বুঝে ফেলেছে বাংলাদেশের বিপ্লব সার্থক। রাহুমুক্ত তার সাড়ে সাত কোটি নরনারী। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জোটের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে রুখতে পারবে না চীন ইতিহাসের অমােঘ বিধান। বাংলাদেশ সমস্যায় তার মতিগতি বিশ্ববাসীর বিরাট কৌতুক। খসে পড়েছে।
বিপ্লবী মুখােস। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থবােধের নগ্ন চেহারা। চীনের বিপ্লবী মােহের জাল ছিন্ন ভিন্ন।ওতে আর ধরা পড়বে না সাচ্চা বিপ্লবের সৈনিকেরা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১