You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.10 | ইসলামাবাদে পুতুল সরকার | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইসলামাবাদে পুতুল সরকার

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁ তার সরকারকে নাকি ‘সিভিলাইজ’ করবেনই। ইংরেজী ‘সিভিলাইজেশন’ কথাটির অর্থ হল সভ্যতা। কিন্তু যেহেতু ইসলামাবাদের জঙ্গী নায়করা সভ্যতার বড় ধার ধারেন না সেহেতু কথাটা তারা কিঞ্চিৎ ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করছেন। তাদের সরকার হচ্ছে মিলিটারি জেনারেলদের সরকার এই গঞ্জনা শুনতে শুনতে ইসলামাবাদের খানদের কান ঝালাপালা। তাছাড়া, গত বছরের নির্বাচনের পর থেকেই লারকানায় নবাবপুত্র জুলফিকার আলি ভুট্টো সাহেব গদিতে বসার জন্য বড়ই আনচান করছেন। সুতরাং ইসলামাবাদের সামরিক সরকারের উপর একটা অসামরিক পলেস্তারা লাগাতেই হবে। এই পলেস্তারা লাগাবার কাজটারই সাম্প্রতিক পাকিস্তানি নাম হল ‘সিভিলাইজেশন’।
তারা জঙ্গী সরকারের উপর সিভিলিয়ান ফিনিশ দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খাঁ সাহেব মাণিকজোড় জুটিয়েছেন ভাল। একজন হলেন পূর্ববঙ্গের ঝানু ও বকেয়া পলিটিশিয়ান নুরুল আমিন। এক কালের নামজাদা মুসলিম নেতা সত্তর পার-হয়ে-যাওয়া এই বৃদ্ধের রাজনৈতিক জীবন বলতে গেলে ১৯৫৪ সালেই শেষ হয়ে গেছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রিত্ব করার পর নুরুল আমিন সাহেব ঐ বছর প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে একজন ছাত্রনেতার কাছে হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু পিপলস ডেমােক্র্যাটিক পার্টি নামে একটি পার্টি খাড়া করে গতবছরের নির্বাচনে নুরুল আমিন সাহেব আবার নিজের ভাগ্য পরীক্ষায় নামলেন। এই নির্বাচনে একমাত্র তিনি নিজে ছাড়া তার দলের আর কোন প্রার্থীই জাতীয় অ্যাসেম্বলিতে জয়ী হয়ে আসতে পারলেন না। কিন্তু তবু এই বৃদ্ধের ক্ষমতার লালসা যায় নি। নির্বাচনের রায়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যবাহিনী যখন পূর্ববঙ্গকে শ্মশান করে ছাড়ল তখন নুরুল আমিন সেই শ্মশানে শবভােজী শকুনের মতাে ঝাপিয়ে পড়লেন। নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে ইয়াহিয়া খাঁ সাহেব যখন পূর্ব বাংলায় উপ-নির্বাচনের একটা ভাঁওতা দিতে চাইলেন তখন তার সেই চক্রান্তে মদৎ দেওয়ার জন্য কিছু বিশ্বস্ত দালালের দরকার হল। সবচেয়ে বড় দালাল তিনি পেলেন নুরুল আমিনের মধ্যে। ছয়টি নামসর্বস্ব দক্ষিণপন্থী পার্টির একটি কোয়ালিশন তিনি খাড়া করলেন। যেসব পার্টি নিয়ে কোয়ালিশন তৈরি হয়েছিল তারা সকলে মিলে গতবছর পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির নির্বাচনে মােট ৩১৭ জন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন, এবং তাঁদের মধ্যে একমাত্র নুরুল আমিন ছাড়া আর কেউ জয়ী হন নি। অথচ, ইয়াহিয়ার লােক-দেখানাে উপ-নির্বাচনে ঐ কোয়ালিশনের মােট ৪৬ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে গেলেন। এই কোয়ালিশন যে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের দালালি করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে সে বিষয়েও কোন অস্পষ্টতা রাখা হয় নি। বাঙ্গালী হয়ে বাংলা দেশের জনগণের প্রতি এই বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার পাওয়ার জন্য নুরুল আমিন বড়ই ব্যস্ত। ২৭ অকটোবর অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাকিস্তানে একটি অসামরিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে তিনি ইচ্ছুক। বেইমান নুরুল আমিন এখন তার ইনাম পেয়েছেন। ১৯৫৮ সালের পর পাকিস্তানের এই সর্বপ্রথম অসামরিক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে গিয়ে বসেছেন তিনি। মাণিকজোড়ের দ্বিতীয় জন জুলফিকার আলি ভুট্টো। ২৫ মার্চের ষড়যন্ত্রে যারা ইয়াহিয়ার প্রধানতম দোসর ছিলেন তাদের একজন এই ভুট্টো সাহেব। সেই সুবাদে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবীদার ছিলেন তিনিও। কয়েক দিন আগেও তার দলের লােকরা হুমকি দিয়েছেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী না করলে রক্তবন্যা বয়ে যাবে। নুরুল আমিনের কোয়ালিশনকে তিনি পাত্তাই দিতে চান নি। কিন্তু এখন আবার সুড়সুড় করে তাকে নুরুল আমিনের অধীনে উপ-প্রধানমন্ত্রীর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন আলাে করতে দেখা যাচ্ছে। ইয়াহিয়া খাঁ সাহেব যাই বলুন না কেন, যারা পাকিস্তানের প্রেমে অন্ধ একমাত্র তারা ছাড়া আর কেউ নুরুলভুট্টোর সরকারের মধ্যে প্রকৃত লােকায়ত্ত অসামরিক সরকারের চিহ্নমাত্র দেখতে পাবেন না। প্রথমত লােকদেখান উপ-নির্বাচনের পরও পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ভুট্টো-নুরুলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। ভুট্টোর দলের ছয়জন সহ মােট যে ৫২ জন সদস্য এইসব উপ-নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন তাঁদের ধরেও নুরুল আমিন ও ভুট্টোর পক্ষে ৩১৩ জন সদস্যের জাতীয় পরিষদে ১৩৯ টির বেশী ভােট নেই। নুরুল আমিন যেমন কোন অথেই পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধি নন, ভুট্টো তেমনি কিছুতেই পশ্চিমে পাকিস্তানের প্রতিনিধি নন। তাঁর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা শুধু পাঞ্জাবে ও সিন্ধুতে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্থানে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল সেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকেও ইয়াহিয়া খাঁ সাহেব নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তথাকথিত অসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও সামরিক আইন চালু থাকবে, ইয়াহিয়া খা প্রেসিডেন্ট ও মুখ্য সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে থাকবেন। অর্থাৎ ইসলামাবাদে ক্ষমতার দড়িটা আসলে ধরা থাকবে সামরিক চক্রেরই হাতে। নিজের দেশের ও বিদেশের মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া এই সরকারের অন্য কোন মূল্যই নেই। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবশ্য এখন ইসলামাবাদের এইসব অপকৌশলে কিছুই এসে যায় না। তারা সুনিশ্চিতভাবে ও চিরকালের জন্য ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। নুরুল আমিন এখন তাদের কাছে বেইমানের অন্য নাম ছাড়া আর কিছু নন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১