বাংলাদেশ-চ্যালেঞ্জ এবং সুযােগ
স্বাধীনতা অর্জন এবং নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উচ্ছাস কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারকে কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন হতে হবে—সেই বাস্তব হল দেশের পুনর্গঠনের বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাঙলাদেশের মানুষ যেহেতু রক্তঝরা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নিয়েছেন, যেহেতু সুসজ্জিত সভাঘরে ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্বারা তারা এই স্বাধীনতা পান নি, তাই তাঁদের কর্তব্য আরাে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঔপনিবেশিক সরকারের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বাঙলাদেশের সরকার সিভিল সার্ভিসের কোনাে স্টিল ফ্রেম’ পাচ্ছেন না। ২৫ মার্চের আগে পর্যন্ত ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসনের যেকাঠামাে ছিল গত আট মাসে তা প্রায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। মুক্তি সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে জ্বলে-স্থলে-আকাশে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের সগ্রামের সময়ও বাঙলাদেশের ব্যাপক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্দর, বিমানঘাটি, রেলপথ, সড়ক, সব কিছুরই মেরামতির প্রয়ােজন দেখা দেবে এখনই। কারণ যােগাযােগ ব্যবস্থা ঠিক না থাকলে গােটা দেশের প্রাণ-প্রবাহই স্তব্ধ হয়ে আসবে।
এই পটভূমিতে একটি নতুন রাষ্ট্র ও সরকারের পত্তন যে মােটেই সহজ কাজ নয় তা ব্যাখ্যা করে বােঝাবার দরকার নেই। মুদ্রা, ডাক টিকিট থেকে সুরু করে সব কিছুই নতুন করে চালু করতে হবে। কল-কারখানা বাঙলাদেশে এমনিতেই খুব বেশি ছিল না, গত আট মাসের মধ্যে সেগুলােও পুরাে চালু থাকে নি। এখন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠার কথাও ভাবতে সুরু করতে হবে। সুখের বিষয়, খাদ্যশস্যের উৎপাদন ঐ নৈরাজ্যের মধ্যেও আশাপ্রদ। তার কারণ, মুক্তি সংগ্রামের সুরুতেই বাঙলাদেশের নেতারা চাষীদের পাটের বদলে ধান চাষের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবু এখানেও আত্মপ্রসাদের খুব জায়গা থাকবে না, কারণ ভবিষ্যতে পাটের জমিতে আবার পাটের চাষ সুরু করতে হবে, সুতরাং ধানের ফলন বৃদ্ধির জন্যে চাষবাসের আধুনিকতম ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী হতে হবে এখন থেকেই। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ব্যাপারেও মনােযােগ দিতে হবে, কারণ এ ব্যাপারে বাঙলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে যথেষ্ট। নতুন সরকার কাজ সুরু করার পর প্রথমেই যে-বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হবেন, তা হল যে। এক কোটি মানুষ গত আট মাসে দেশ ছেড়ে চলে এসেছে। তাদের বাঙলাদেশে প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। যে-কোনাে দক্ষ ও প্রতিষ্ঠিত সরকারের পক্ষেই এটা একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ, নতুন সরকারের পক্ষে তাে বটেই।
সুতরাং বাঙলাদেশ সরকারকে গােড়া বেঁধে কাজে নামাতে হবে। বাঙলাদেশের অস্থায়ী সরকার ইতিপূর্বেই একটা উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। পরিবর্তিত অবস্থায় তার কিছু পরিবর্তন হতে পারে। সেই পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্যে দরকার জনদরদী ও দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা। প্রকাশ, বাঙলাদেশ সরকারের অনুরােধে ভারত সরকারে কিছু অভিজ্ঞ অফিসার নতুন প্রশাসন ব্যবস্থায় পত্তনে বাঙলাদেশ সরকারকে সাহায্য করবেন। অন্যান্য ব্যাপারেও যেমন মুদ্রা ও ডাক টিকিট ছাপা, ভারতের সাহায্যের দরকার হবে। প্রথম দিকে অর্থ সাহায্যও (ঋণ হিসেবে) দিতে হতে পারে ভারতকে। বাঙলাদেশের ব্যাপারে ভারতের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে, ঐতিহাসিক এবং ভৌগােলিক কারণেই ভারতের ওপর এই দায়িত্ব এসে পড়েছে। বাঙলাদেশ ভারতের সর্বপ্রকার সাহায্য নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। ১৯৪৯ সালে চীনে ক্যুনিস্ট সরকারের পত্তনের পর সােভিয়েট রাশিয়ার ব্যাপক সাহায্য না পেলে চীনও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারত না।
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা লাভের যেমন কতকগুলি অসুবিধে আছে, তেমনই সুবিধেও কম নেই। স্লেটের সব লেখা মুছে ফেলে নতুন করে কাজ শুরু করার সুযােগ সব স্বাধীন দেশ পায় না। পুরানাে কোনাে কোনাে ব্যবস্থা নতুন সরকারের ঘাড়ে এসে যে চাপছে না সেটা এক হিসেবে শাপে বর হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাঙলাদেশের সরকারকে এই সুযােগের পূর্ণ সদ্বব্যবহার করে নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে নতুন রাষ্ট্রকে। সে জন্যে প্রস্তুতির প্রয়ােজন এখন থেকেই। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচারে দীর্ঘ দিন নিষ্পেষিত হয়েছে বাঙলাদেশের মানুষ। নতুন জীবনের স্বাদ লাভের জন্যে তারা যে অধীর, এ-কথা ভুললে চলবে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১