ইয়াহিয়ার মুখে শয়তানি বুলি
ফুটো নৌকোয় পা দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। শর্ত সাপেক্ষে তিনি রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব গ্রহণে রাজী। কি তার শর্ত? পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্তে বসাতে হবে বিশ্বসভার পর্যবেক্ষকদল। নইলে তিনি সৈন্যাপসরণ করবেন। না। এই নির্বোধ জেনারেল অবশ্যই খবর পেয়েছেন, তার পূর্ব সীমান্ত অবলুপ্ত। এখানে যে সীমান্ত গড়ে উঠেছে তা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। সেখানে পাকিস্তানের কোন এক্তিয়ার নেই। আর এ সীমান্তে তার সৈন্যবাহিনীর অপসারণের প্রশ্নই আসে না। মারের চোটে তারা আগেই অপসারিত এবং ঢাকায় কোণঠাসা। এখান থেকেও তাদের সমূল উচ্ছেদ আসন্ন। আর দু-চারদিন অপেক্ষা করুন ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশে তার ঘাতক বাহিনীর একটিকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাদের তিনি করবেন অপসারণ এবং রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষকদলই বা বসবেন কাদের জমিতে? ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন, ভারী চালাক তিনি। আশা ছিল, যুদ্ধের আগে বন্ধু-বান্ধবদের দ্বারা ভারতের উপর চাপ দিয়ে যা তিনি চাননি, তা পাবেন রণক্ষেত্রে। অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়েছেন ভারতের উপর। প্রথম পাল্টা ধাক্কা আসাতেই চোখে দেখছেন সরষের ফুল। বাংলাদেশ হাতছাড়া। যা ছিল একদিন তার জমিদারী তা আজ স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। যে নিরস্ত জনতা ছিল তার ঘাতক বাহিনীর শিকার তারাই অস্ত্র হাতে করছে ঘাতকদের তাড়া। ইয়াহিয়া খােয়াব দেখছেন। আকাশে বানাচ্ছেন সুখের প্রাসাদ। রাষ্ট্রসংঘের মুরুব্বীরা হৃত বাংলাদেশ পুনরুদ্ধার করে তাঁকে দেবেন উপহার। কোথায় আজ জঙ্গীশাহীর আস্ফালন? ওরা কথায় কথায় বলতেন-একজন পাকিস্তানি সৈন্য কমপক্ষে দশরন ভারতীয় জওয়ানের সমান। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করবেন তারা পশ্চিমের রণক্ষেত্রে, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি মুজিবর রহমানকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে নয়। বিস্তৃত রণাঙ্গন তিনি পেয়েছেন। মাত্র সপ্তাহখানেকের লড়াইয়ের পর পূর্ব রণাঙ্গন প্রায় খতম। আগামী সপ্তাহে হয়ত সেখানে লড়াই-এর জন্য একটি পাক সেনাও দেখা যাবে না। যারা এখনও প্রাণে বেঁচে আছে তাদের অধিকাংশ মরবে এবং বুদ্ধিমানরা আত্মসমর্পণ করবে। পশ্চিম রণাঙ্গনে অবশ্যই প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। ইতিমধ্যে জওয়ানদের বেপরােয়া মারের চোটে অনেকের রণসাধ মিটেছে। পাক নৌবহরের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে। ওটা আর জোড়া লাগছে না। জঙ্গী বিমানগুলাে মাটিতে থুবরে পড়ছে আর উঠছে না। এ দৃশ্য প্রতিদিন দেখছেন ইয়াহিয়া খান। তবু দেমাগ কমছে না। খোলা হয়েছে যার নাক তিনি দিচ্ছেন শর্ত? জঙ্গীশাহী করেছেন ভারত আক্রমণ ! রুখে দাঁড়িয়েছে জওয়ানরা। নয়াদিল্লী তাে সৈন্যাপসারণ করতে বলেননি ইয়াহিয়া খানকে। তারা তাে চাননি রাষ্ট্রসংঘের সাহায্য? যদি হিম্মত থাকে জঙ্গীচক্র বলুন-যুদ্ধ করে হয় বাঁচব, নয় মরব। একথা বলার মত বুকের পাটা এবং তা কার্যকর করার সাহস যদি থেকে থাকে তার তবে ধাপ্পাবাজী ছাড়ন। বাঘের চামড়ায় ঢাকা এই শিয়ালগুলাের অবস্থা কাহিল। পায়েরতলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। দোস্তদের কাঁধে ভর দিয়ে আর সামাল দিতে পারছেন না। চোখের সামনে ভেসে উঠছে স্পষ্ট ছবি—ভারতীয় সীমান্ত থেকে সৈন্যাপসারণের সুযােগ পাবেন না ইসলামাবাদ। এ কাজটা ভারতীয় জওয়ানরাই করে দেবে।
ভারতের বক্তব্য অতি স্পষ্ট। বাংলাদেশ তার মিত্র রাষ্ট্র। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযােগে উচ্ছেদ করবে সে পাক হানাদারদের। তাদের কাজ প্রায় সমাপ্ত। এরপর আসবে পশ্চিম রণাঙ্গনের চরম ফয়সালার দিন। কোথায় এখন হাজার বছরের লড়নেওয়ালা জুলফিকার আলি ভুট্টো। তার সাধের করাচী ভারতীয় নৌবহরের কামানের গােলায় জর্জরিত। তার সাবভূমি সিন্ধুর বুকের ভিতর ঢুকে গেছে জওয়ানেরা। ভুট্টো কেন আসছেন না রণক্ষেত্রে? স্বদেশকে চিরশত্রু ভারতের দয়ার উপর ছেড়ে দিয়ে কেন নিউইয়র্কে গেছেন। গলাবাজী করতে?হাজার বছরের যুদ্ধের সাধ কি চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই মিটছে? কোথায় বিশ্বাসঘাতক নুরুল আমিন? তাঁর স্বদেশ আজ পাক দস্যু মুক্ত। স্বাধীন জন্মভূমিতে ফিরে না এসে কেন আশ্রয় নিয়েছেন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে?ফিরে আসুন বাংলাদেশে। দেখুন মাতৃভূমির পায়ে আবার দাসত্বের শৃঙ্খল পরাতে পারেন কিনা? এই সব কাপুরুষের দল ইয়াহিয়ার পার্শ্বচর। এদের নিয়ে করবেন তিনি রণজয়। এখনও সময় আছে। শয়তানি জারিজুরির দিন আর নেই। স্বেচ্ছায় এবং বিনাসর্তে অস্ত্র ছাড়ন ইয়াহিয়া খান। জওয়ানদের শাণিত অস্ত্রের সামনে পাঠাবেন না স্বদেশের তাজা প্রাণগুলােকে। অনিবার্যকে স্বীকার করুন।
বাংলাদেশ গেছে। ওটা আর তাঁর হাতে ফিরবে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষ দেখেছে নূতন সূর্যের আবির্ভাব। ওদের দৃষ্টি পূবে। মুমুর্ষ জঙ্গীশাহী। তার অন্তিম যাত্রা ঠেকাতে পারবে না কেউ। প্রত্যাঘাতের প্রাথমিক তীব্রতা দেখে যদি সম্বিত না ফেরে ইয়াহিয়া খানের তবে তার উপরও প্রযােজ্য হবে জেনারেল মানেকশর হুশিয়ারী-আত্মসমর্পণ কিম্বা মৃত্যু-দুটির মধ্যে বেছে নাও একটি সেদিনের দেরী নেই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১