আগরতলার বদলা চাই
পাকিস্তানি জঙ্গী বিমান আগরতলায় হানা দিয়েছে। বিমানঘাটিতে এবং আশেপাশের জনপদে নির্বিকারে তারা গােলাগুলী বর্ষণ করেছে। হতাহতের সংখ্যা হয়ত খুব বেশী। বিমান বিধ্বংসী কামানের গােলায় একটি পাক বিমান জখম হয়েছে। আগরতলার ভৌগােলিক অবস্থান দুর্বল। ত্রিপুরার তিনদিক শক্ৰবেষ্টিত। যুদ্ধ বাধলে এখানেই আসবে প্রথম আঘাত। আক্রমণ শুরু হয়েছে কিনা নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। গত বৃহস্পতিবার সারাদিন ধরে চলেছে আগরতলার উপর পাক কামানের গােলাবর্ষণ। এই প্রবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত তার বিরাম ঘটেনি। বাংলাদেশে সঙ্ঘর্ষ আরম্ভের পর ভারতীয় অঞ্চলে শত্রু বিমান গােলাগুলী বর্ষণ এই প্রথম। এর সম্ভাব্য পরিণাম সুদূরপ্রসারী। যুদ্ধের জন্য পাগল ইয়াহিয়া খান। প্রেসিডেন্ট নিকসন দাঁড়িয়েছেন তার পাশে। গণহত্যাকারীদের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগারের আশায় তিনি করছেন হরেক রকমের পাঁয়তারা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মার্কিন গােমস্তা উ থান্টও নিশ্চিন্ত বসে নেই। বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকভারত বিরােধে পরিণত করার অপকৌশলে তিনিও কোমর বেঁধে লেগেছেন। এদের পরােক্ষ উস্কানীতেই বেপরােয়া ইয়াহিয়া খান। তারই পরিণতি, আগরতলার উপর পাক বিমান আক্রমণ। পশ্চিমবাংলার জনসাধারণ সাবধান। যুদ্ধ তাদের ঘরের দরজায়। পাক বিমান আক্রমণের মােকাবিলায় তৈরী থাকুন তাঁরা। জোরদার করে তুলুন অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আজ আতঙ্কের দিন নয়, প্রতিশােধ গ্রহণের দিন। দুচারটি বােমায় দিশাহারা হলে চলবে না। ইস্পাতদৃঢ় মন নিয়ে করতে হবে প্রতিদিনের কাজ। জনসাধারণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিশৃঙ্খলার অর্থ—পাকিস্তানের উদ্দেশ্যসিদ্ধির সুযােগদান। মনে রাখবেন—তিনদিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের দ্বারা বেষ্টিত। সর্বাত্মক অভিযান সুরু হলে পাকবাহিনী বেশীদিন টিকতে পারবে না সেখানে। আন্তর্জাতিক সমাজের মুখ চেয়ে আট মাস অপেক্ষা করেছে ভারত। ওরা থামায়নি ইয়াহিয়ার বেয়াদপী। করেনি এক কোটি শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা। পাক উস্কানী বন্ধের জন্য একটি তর্জনীও তােলেনি কেউ। নয়াদিল্লী যখন নিয়েছেন কঠোর মনােভাব তখনই পাক দোস্ত মহলে উঠেছে মরাকান্না। যতই তীব্র হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর মার ততই বাড়ছে মরাকান্নার রােল। ভারত এবং পাকিস্তানকে একই পর্যায়ে ফেলে আমেরিকা বন্ধ করেছে ভারতে অস্ত্র রপ্তানী। তাতে কিছু আসে যায় না। এদেশে মার্কিন অস্ত্রের আমদানী সামান্য। কিন্তু পাকিস্তানের অবস্থা আলাদা। মার্কিন অস্ত্র এবং তার যন্ত্রাংশের জন্য সে ওয়াশিংটনের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। সরাসরি সেখানে অস্ত্র না পাঠাতে প্রেসিডেন্ট নিকসন প্রতিশ্রুত। তাই সােজা পথে না গিয়ে তৃতীয় রাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানে যাচ্ছে মার্কিন অস্ত্র এবং যন্ত্রাংশ। আর সীমান্ত থেকে ভারতীয় বাহিনী সরাবার জন্য চলছে মার্কিন চাপ। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী অনড়। রাজ্যসভায় তিনি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখের মত জবাব।
চীন, বৃটেন এবং আমেরিকা কি করবে এবং কি না করবে তা বড় কথা নয়। ওরা নীতিভ্রষ্ট। সামরিক এবং সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে তারা পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীকে বাঁচিয়ে রাখতে দৃঢ়সঙ্কল্প। নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং ভুট্টোকে উপপ্রধানমন্ত্রী করে অসামরিক দালাল সরকার প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র আঁটছেন ইয়াহিয়া খান। তার এই অপচেষ্টার প্রধান প্রশ্রয়দাতা আমেরিকা। এক কোটি শরণার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে পাকিস্তান এবং তার দোস্তরা। অসহনীয় হয়ে উঠেছে এদের শয়তানি খেলা। আগরতলার উপর বিমান আক্রমণ এবং কামানের গােলা বর্ষণ ভারত আক্রমণের সামিল। ব্যাপক পাল্টা আঘাতের ইচ্ছা নেই নয়াদিল্লীর। সীমিত আঘাত এখন তাদের বিঘােষিত নীতি। আগরতলার বদলা চাই। পাক ঘটিগুলােতে এখন ভারতীয় বিমান আক্রমণের বাধা নেই। রাষ্ট্রসঙ্ কিম্বা আন্তর্জাতিক সমাজের মুখ চেয়ে থাকা নিরর্থক। স্বার্থান্বেষীরা আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীদের মধ্যে কোন তফাৎ রাখবে না। স্বস্তি পরিষদের দীর্ঘ কলঙ্কিত ইতিহাসে এধরনের ন্যক্কারজনক নজিরের অভাব নেই। পাক আক্রমণের উৎস মুখে ঢুকে পড়ক জওয়ানের দল। তাদের সঙ্গে যাক বিমানবহর। পাক দুশমনরা হাড়ে হাড়ে বুঝুক—ভারতে গণহত্যা চালাবার পৈশাচিক উদ্যমের ভয়াবহ পরিণাম। নিশ্চিহ্ন করতে হবে আগরতলার আশেপাশের পাক ঘাঁটিগুলাে। ইসলামাবাদের দস্যুদের স্থূপীকৃত শবরে আড়ালে গড়ে উঠুক ভারতের প্রতিরক্ষা প্রাচীর। আর দেরী নয়। পাল্টা আঘাত হানুক জওয়ানেরা। ভারতের পঞ্চান্ন কোটি নরনারী তাদের পিছনে। ওদের বজ্রকণ্ঠের দাবী-আগরতলার বদলা চাই। গােটা ভারতের দৃষ্টি আজ আগরতলায়। তার লাঞ্ছনার নির্মম প্রতিশােধ ছাড়া শান্ত হবে না জনমত—শান্তি পাবে না মৃতের অশান্ত আত্মা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১