You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.05 | ঐক্যবদ্ধ জাতির কণ্ঠস্বর | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ঐক্যবদ্ধ জাতির কণ্ঠস্বর

সংসদের দুই কক্ষের সভায় ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় জাতির কণ্ঠস্বর শনিবারে মতাে এখন স্পষ্ট ও তীক্ষভাবে ইতিপূর্বে আর কখনও শােনা যায়নি। জাতির সামনে যে ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ এসেছে, তার জবাবও জাতির প্রতিনিধিরা দিয়েছেন অভূতপূর্ব দৃঢ়তা ও একতার ভাষায়। সংগঠন কংগ্রেস, দুই কন্যুনিষ্ট পার্টি, ডি এম কে, মুসলিম লীগ, সােস্যালিষ্ট পার্টি, ফ্র্যাঙ্ক আন্টনির মতাে নির্দলীয় সদস্যরা সকলেই একযােগে জাতির এই চরম সংকটের মুহুর্তে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের পিছনে নিঃসংশয় সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। দেশে জরুরী অবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির ঘােষণাটি বিনা আলােচনায় ও বিনা প্রতিবাদে অনুমােদন করে সংসদ সদস্যরা শত্রুর হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে মােকাবেলার ঐক্যবদ্ধ জাতির প্রতিজ্ঞাকে সভাকক্ষের মধ্যে প্রতিফলিত করেছেন।
এরই পাশাপাশি আমরা দেখেছি, আমাদের শত্রুদেশের রাষ্ট্রনায়করা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার আগে নিজেদের দেশের দুটি বৃহৎ দলকে নিষিদ্ধ করেছেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে স্বজাতি বলে দাবী করেন, তাদের উপর হত্যার বীভৎস তাণ্ডব চালিয়েছেন, আট মাসের মধ্যে সেই মানুষগুলির মধ্যে গিয়ে একবার দাঁড়াবার সাহসও তাঁদের হয়নি। এই দুই বিপরীত চিত্রের মধ্যে যখন আমরা তুলনা করি, তখন আমাদের এই বিশ্বাস আরও বাড়ে যে, এই যুদ্ধ জয় আমাদের হবেই। কেননা, এই যুদ্ধ ৫৫ কোটি ভারতবাসী ও সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মিলিত যুদ্ধ আর আমাদের প্রতিপক্ষের যুদ্ধ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় ক্ষমতালােভী কুচক্রীর যুদ্ধ।
অতীতে আরও দুবার ভারত বড় রকমের বৈদেশিক আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু ঐ দুবার আমাদের জাতীয় ঐক্য এমন ব্যাপক ও গভীরভাবে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠেনি। তখন আমাদের নিজেদেরই কিছু কিছু অংশের মধ্যে দ্বিধা ও সংশয় ছিল। এবার দীর্ঘ আট মাস ধরে দিনে দিনে দলমতনির্বিশেষে ভারতের সকল মানুষ এক হয়ে শত্রুর সঙ্গে পাঞ্জা কষার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর এই আশায়। সকলেই সায় দেবেন যে, সামনে যে কঠিন দিনগুলি আসছে, তা অতিক্রম করতে জাতির এই ঐক্য ও সংহতি আমাদের সাহায্য করবে। এই সংহতি রক্ষা করা ও তাকে প্রসারিত করাই এখন বড় কাজ। জনসংঘ দলের নেতা শ্ৰীঅটলবিহারী বাজপেয়ী ঠিকই বলেছেন, “আজ আমাদের ছােটখাট জিনিস দূরে সরিয়ে রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের দেশকে জয়ের পথে নিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য এই ঐক্য চাই। কেননা, আধুনিক যুদ্ধে কেবল যারা রণক্ষেত্রে লড়াই করে, তারাই সৈনিক নয়, রণক্ষেত্রে পেছনে থেকে যারা নিয়মিত কাজকর্ম চালু রাখে তারাও সৈনিক। একথা কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার করে না যে, আধুনিক যুদ্ধ ছেলেখেলা নয়। এই যুদ্ধ চালাবার জন্য সমগ্র জাতিকে প্রচণ্ড ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ভারতবর্ষের মতাে সঙ্গতিহীন দেশের পক্ষে এটা যে দুর্বহ বােঝা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু একটা জাতির জীবনে কখনও কখনও সময় আসে ভবিষ্যতের স্বার্থে আজকের দিনের স্বার্থ ত্যাগ করার। ভারতবর্ষের সামনে আজ সেই সময়। জাতির নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করার জন্য, এই উপমহাদেশে শান্তি সুরক্ষিত করার জন্য, শতাব্দীর এক পাদ ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সভ্যতার যে আদর্শ নিয়ে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তার চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য আমাদের জাতিকে এই বােঝা মাথা পেতে নিতেই হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য সুদিনের আশায়, বাংলাদেশের নিরীহ মানুষগুলির রক্তের ঋণ শােধের আশায় এবং হাজার হাজার নারীর সম্ভ্ৰমনাশের প্রতিশােধ নেওয়ার সংকল্পে আমরা দাতে দাত চেপে একটা যুদ্ধের দায় বহন করব, সেই প্রতিশ্রুতিই রয়েছে সংসদে প্রকাশিত সর্বদলীয় ঐক্যের মধ্যে।
এই মুহুর্তে আমাদের কর্তব্য কঠিন ও স্পষ্ট। প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, আমাদের সৈন্যবাহিনীর পিছনে সর্বপ্রকার সমর্থন নিয়ে দাঁড়ান। সমরপ্রয়াস অব্যাহত রাখতেই হবে। তার জন্য প্রয়ােজন উৎপাদন চালু রাখা। কলকারখানা, যানবাহন চলাচল, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যােগাযােগ ব্যবস্থা, হাসপাতাল ও ডাক্তারখানার কাজকর্ম ইত্যাদি কোথাও এতটুকু ঢিলেমি বা গাফিলতি করা শত্রুকে সাহায্য করার সামিল হবে। দ্বিতীয় কর্তব্য হবে অর্ন্তঘাতকদের উপর নজর রাখা। যারা আতঙ্ক ও গুজব ছড়ায়, যারা নাশকতা করে, যারা সংকটের সুযােগ নিয়ে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে, তারা সকলেই এই অন্তর্ঘাতকদের মধ্যে পড়ে। জরুরী অবস্থার ঘােষণার মধ্য দিয়ে ও ভারত রক্ষা বিধানের মধ্য দিয়ে সরকার ও সংসদের হাতে যে প্রভূত ক্ষমতা এল সেটা এই অন্তর্ঘাতকদের খুঁজে বের করার জন্য এবং তাদের দমন করার জন্য ব্যবহার করতে হবে। আর একটি কর্তব্য হল অসামরিক প্রতিরক্ষার নিয়মকানুনগুলি কঠোরভাবে মেনে চলা। বিমান আক্রমণ, নিষ্প্রদীপ, সাময়িকভাবে জল বা বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার জন্যও প্রতিটি গৃহস্থকে যথাসম্ভব তৈরি থাকতে হবে।
এই মুহূর্তে দুর্যোগের যে রাত্রি নিচ্ছদ্র অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে, দুর্জয় সংকল্প ও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা সেই রাত্রি যাপন করব, কেননা, আমরা নিশ্চিত জানি আমাদের সামনে রয়েছে নতুন সূর্যোদয়ের প্রতিশ্রুতি যে সূর্যোদয় নিয়ে আসবে শান্তি ও মুক্তির আস্বাদ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১