নীরব কূটনৈতিক তৎপরতা
অনেকের ধারণা, আরব নেতারা বগাড়ম্বরে এবং চোখা চোখা শব্দ ব্যবহারে ওস্তাদ। কথার সংযম এবং মৌনতা তাদের অভ্যাসের বাইরে। এই চলতি ধারণা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন মিশরের প্রেসিডেন্ট সাদাত। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে দুনিয়ার অনেক রাষ্ট্রনেতাই কথা বলেছেন। কেউ স্পষ্ট, কেই অস্পষ্ট এবং কেউ দুর্বোধ্য। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সাদাত নির্বাক। তিনি নাকি পাকিস্তানের সঙ্গে চালাচ্ছেন নীরব কূটনৈতিক তৎপরতা। ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশ সমস্যার একটা সন্তোষজনক সমাধান করিয়ে ফেলাই নাকি তার উদ্দেশ্য। কথা বললে নাকি সব পন্ড হয়ে যাবে। প্রেসিডেন্ট সাদাতের নীরব কূটনৈতিক তৎপরতার ফল কি হল তা এখন বলে ফেলাই ভাল। আট মাস তাে হয়ে গেল। আর কতদিন অপেক্ষা করবে ভারত, এক কোটি শরণার্থী এবং বাংলাদেশের সংগ্রামের জনত।
সাংবাদিকদের অনেক সাধ্যসাধনার পর কথা বলেছেন জনৈক মিশরীয় সরকারি মুখপাত্র। তার মতে, বর্তমানে যে সঙ্কট চলছে তর অবসানের জন্য মিশন সমভাবেই ভারত এবং পাকিস্তানকে সাহায্য করতে উৎসুক। তার বিশ্বাস, সুবুদ্ধির উদয় হলেই উত্তেজনা কমবে। শরণার্থী সমস্যার সমধানও হয়ে যাবে। ভারত এবং পাকিস্ত নি—উভয়ের বন্ধু মিশন। এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি এবং সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবেন মিশরীয় সরকার। চমৎকার সদুপদেশ দিয়েছেন মিশর সরকারের প্রতিনিধি। ১৯৫৬ সালে বৃটেন এবং ফ্রান্স সমভাবেই ছিল ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র। তারা যখন সুয়েজ আক্রমণ করল তখন অন্যায়কারীকে নীরবতার আড়ালে প্রশ্রয় দেয় নি ভারত। বন্ধু পাকিস্তানের পাত্তা পাওয়া যায় নি সেদিন। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে মিশর নিয়েছিল রিপাব্লিকানদের পক্ষ। আর রাজতন্ত্রীদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল সৌদী আরব। মিশরীয় বাহিনী যখন ইয়েমেনে জীবন-মরণ সংগ্রামে রত তখন বৃটিশ ইঙ্গিতে ইয়েমেনে রাজতন্ত্রীদের দেওয়া বুলেটে হয়ত অনেক মিশরীয় সৈন্যরই জান খতম হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইস্রাইল লড়াই-এর সময় ইস্রাইলী সমর্থক ইউরােপীয় রাষ্ট্রগুলােকে তৈল বন্ধ করেছিল তৈলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্রগুলাে। ইরান সেদিন ইউরােপ তৈল সরবরাহ বন্ধ করা তাে দুরের কথা, বরং সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়েছিল। ইরানের শাহকে নাসের বলতেন, বিশ্বাসঘাতক। এই বিশ্বাসঘাতক ইরানের দোস্ত পাকিস্তান। আর পাকিস্তানি দোস্তীর দাবীদার মিশরের সরকারি মুখপাত্র। পৃথিবীর যে কোন প্রাণের শােষিত জনগণের দাবী সমর্থনে মার্কিন সাহায্য বরবাদ করতেও রাজী ছিলেন নাসের। কঙ্গোর শহীদ লুমুদ্বার সমর্থক স্ট্যানলীভিলের বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে গিয়ে মার্কিন সাহায্য। এই সাহয্যের লােভে পাকিস্তানকে চটাতে তিনি অনিচ্ছুক। তাই শ্যাম এবং কুল—এই দুটিকে রক্ষার জন্য তিনি নিয়েছেন নীরব কূটনৈতিক তৎপরতার আশ্রয়। ভাবছেন মহাজনের কথা—বােবার শত্রু নেই। ইস্রাইলের সঙ্গে মিশরের চলছে জমির বিরােধ সঙ্গে আছে প্যালেস্টাইনী শরনার্থী সমস্যা। এখন চলছে অচল অবস্থা। ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে ইস্রাইল। অধিকৃত আরব এলাকা ছেড়ে দেবার ইচ্ছা নেই তার। উভয়পক্ষ থেকেই ক্রমাগত চলছে যুদ্ধের হুমকী। আরবের সমর্থনে প্রেসিডেন্ট সাদাত চাচ্ছেন গােটা বিশ্বের সমর্থন। অবশ্যই ভারত পেয়েছে তার আর্জি। মিশর বলছে ইস্রাইল দোষী। গায়ের জোরে সে দখল নিয়েছে আরব ভূমি। ভিটেছাড়া করেছে লক্ষ লক্ষ আরব নরনারী। পশ্চিম এশিয়ার শান্তি এবং ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠার জন্যই দরকার ইস্রাইলের প্রতি জোরাল ধিক্কার দিতে পারছেন না। মুখে কুলুপ এটে বসে আছেন। তার সরকারি মুখপাত্র শুনাচ্ছেন প্রেম এবং শান্তির অমৃত বাণী। আরব-ইস্রাইল বিরােধ মীমাংসার উপায় হিসাবে এই বাণীগুলােই যদি ভারত বর্ষণ করে মিশরাে উপর তবে প্রেসিডেন্ট সাদাতের প্রতিক্রিয়া কেমনতর হবে?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ নভেম্বর ১৯৭১