অসামরিক প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতি চাই
পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে বৃহত্তম কলকাতা অঞ্চলে অসামরিক প্রতিরক্ষার প্রস্তুতিতে এখনও যথেষ্ট ঢিলেমি রয়েছে। ইতিমধ্যে যদিও বার-কয়েক বিমান আক্রমণের সংকেতজ্ঞাপক সাইরেন বাজাবার ও নিষ্প্রদীপের মহড়া হয়ে গেছে, তাহলেও শহরের মানুষ এখন পর্যন্ত এই সব মহড়ার উপর প্রয়ােজনীয় গুরুত্ব আরােপ করছেন না এবং সেই সরকারি সংগঠনও নজরে পড়ছে না যা মানুষকে অসামরিক প্রতিরক্ষা সম্পর্কে সচেতন করে তলতে সাহয্য করে। প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার শ্রীপ্রণবকুমার সেন রােটারি ক্লাবের সভায় সঠিকভাবেই আক্ষেপ করেছেন যে, সে বিষয়ে অধিকাংশ মানুষ অত্যন্ত বেশী মাত্রায় অনবহিত রয়েছেন। তিনি এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, শত্রুপক্ষ শহরের উপর ভারী বােমা ও নাপাম বােমা ফেলতে পারে।
এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তান যদি কলকাতার উপর হাওয়াই হানাদারি চালাবার দুঃসাহস দেখায়, তাহলে সে উপযুক্ত জবাব পাবে। হানাদারদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার ক্ষমতা ভারত রাখে। কিন্তু পাল্টা মার খাওয়ার ভয়ে পাকিস্তান হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, এমন মনে করার কারণ নেই। বরং এ-কথাই ধরে নেওয়া উচিত যে, মরিয়া হয়ে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকরা যেকোন আত্মঘাতী অ্যাডভেঞ্চারেও নামতে পারেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের পূর্ব খণ্ডে বিশেষ কিছু যুদ্ধ হয়নি এবং এই খণ্ডে পাকিস্তানি বিমানের দৌরাত্ম বিশেষ দেখা যায়নি। কিন্তু ১৯৬৫ সালে যা হয়নি, এবারও তা হবে না মনে করার কারণ নেই। বরং এবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে পূর্ব সীমান্তেই তার আচ বেশী করে লাগবে। তামিল-দেওয়া নাশকবাহিনীকে যেভাবে আমাদের দেশের যােগাযােগ ব্যবস্থা নষ্ট করার চেষ্টা করছে তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, সুযােগ-সুবিধামত তারা এদেশের জনসাধারণের উপর অতর্কিত হানাদারি চালিয়ে আতঙ্ক ছড়াবার চেষ্টায় কসুর করবে না। এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যেস স্বল্পতম ঝুকিতে বৃহত্তম ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি বিমান ঘন বসতিগুলিতে বােমা ফেলে প্রাণ ও সম্পত্তি নষ্ট করার চেষ্টা করবে, গুরুত্বপূর্ণ পথ, সেতু, জল সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভৃতি ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। অন্তত পাকিস্তানের এই ধরনের নষ্টামির জন্য যে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে হবে তাতে সন্দেহ নেই। এ-বিষয়ে আমরা যত কম প্রস্তুত থাকব, পাকিস্তান ততই সহজে তার কাজ হাসিল করে নেবে।
অসামরিক প্রতিরক্ষা সম্পর্কে প্রচার ইতিমধ্যে অন্তত শহর এলাকায় যথেষ্টই হয়েছে। সংবাদপত্র ও বেতারের মধ্য দিয়ে অন্তত কলকাতা শহরের মানুষ মােটামুটিভাবে জেনে গেছেন, অসামরিক প্রতিরক্ষায় তাদের এসব বিষয়ে অবহিত করার চেষ্টা হয়েছে। তবু যদি শহরবাসীরা নির্দেশগুলি যথাযথভাবে পালন করে না থাকেন, তাহলে গলদটা কোথায় হচ্ছে সেটা ভালভাবে খোঁজ করে দেখতে হবে। অনেকের ধারণ, নির্দেশগুলির মধ্যেই গলদ রয়েছে এবং সেগুলি সরকারি ব্যবস্থার দুর্বলতার পরিচায়ক। যেমন, সাইরেন বাজাবার মহড়ার সময় বিপদের সংকেতধ্বনি শােনা মাত্র রাস্তার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে হবে, এই নির্দেশ অবাস্তব। সাইরেনের আওয়াজ শােনা মাত্র নিছক সহড়ার খাতিরে ছেলে-বুড়াে, মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে সব পথচারী কলকাতার জনাকীর্ণ পথের উপর ধূলিশয্যা গ্রহণ করবেন, এটা আশা করতে পারেন সেই সব গজদন্তমিনারবাসী আমলা যাদের কলকাতর রাস্তায় হেটে বেড়াতে হয় না। ট্রেঞ্চে আশ্রয় নেওয়ার কথা রলা হয়েছে। কিন্তু কোথায় ট্রেঞ্চ? আদৌ কি ট্রেঞ্চ খোড়া হবে? মানুষ যদি সরকারি প্রস্তুতির মধ্যেই দুর্বলতা দেখতে পায়, তাহলে স্বভাবতই নিজেরা ততটা গরজ বােধ করে না। আসলে, অসামরিক প্রতিরক্ষার সংগঠনটিই এখন পর্যন্ত ঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। ১৯৬৫ সালে যাদের নিয়ােগ হয়েছিল, তাদের অনেককেই এখন পাওয়া যাবে না। তাঁদের বদলে নতুন লােক নিয়ােগ করা হয়নি, নতুন করে তালিম দেওয়ারও ব্যবস্থা হয়নি। এখন পর্যন্ত অসামরিক প্রতিরক্ষার সংগঠন কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে। রাস্তার আলােতে তুলি লাগান হবে কিনা, জল সরবরাহ লাগলে সেই আগুন নেভাবার ব্যবস্থা কি হবে, সেসব বিষয়ে এখন যথেষ্ট পরিমাণ দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। অসামরিক প্রতিরক্ষায় সরকার কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন তার উপর অবশ্য প্রস্তুতি অনেকটা নির্ভর করছে। কিন্তু প্রয়ােজনটা যে জরুরী, এই চেতনার পরিচয় সরকারি কর্তৃপক্ষকেই বেশী করে নিতে হবে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ নভেম্বর ১৯৭১