প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাবর্তনের পর
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দেশে ফিরছেন। তাঁর তিন সপ্তাহের ইউরােপ এবং আমেরিকা সফর সমাপ্ত। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান এবং শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উপায় খুঁজে বার করা ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। ইয়াহিয়ার উপর তিনি চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক চাপ। প্রেসিডেন্ট নিকসন তার মৌল পাক-নীতি বদলান নি। অনেক আজেবাজে প্রস্তাব নিয়ে ধানাইপানাই করেছিলেন তিনি। সব প্রস্তাবেরই আসল মতলব ছিল ইয়াহিয়াকে আড়াল করে রাখা। পাক-ভারত সীমান্তে সামরিক উত্তেজনার প্রকৃত কারণ সষত্মে এড়িয়ে গেছেন। প্রেসিডেন্ট নিকসন। বেশী দূর এগুতে পারেন নি তিনি। শ্রীমতী গান্ধীর স্পষ্টোক্তি এবং দৃঢ়তার সামনে বারবার পিছিয়ে গেছেন। মুখে বৃটেন যাই বলুক কাজের বেলায় সে নেবে মার্কিন পথ। তার উপর আস্থা রাখা মুস্কিল। ভারতের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে ফ্রান্স। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ণয়ে প্রেসিডেন্ট পপিদুর বক্তব্য খানিকটা স্পষ্ট। তিনি চেয়েছেন সংশ্লিষ্ট জনগণের ইচ্ছা এবং স্বার্থভিত্তিক সমাধান। পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলার উইলি রাষ্টের আন্তরিকতা এবং স্বচ্ছ দৃষ্টি-জঙ্গী প্রশংসার যােগ্য। তিনি স্বীকার করেছেন, পাক ভারত সামরিক উত্তেজনার উৎস বাংলাদেশের উপর নিপীড়ন এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভারত আগমন। এ সমস্যার সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান না হলে শরণার্থীরা ফিরে যাবেন না স্বদেশে, কমবে না পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা। আর এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পাকিস্তানের। তাকেই নিতে হবে প্রথম উদ্যোগ।
বাংলাদেশের সঙ্কট এবং শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টিকর্তা কে—তা অজানা ছিল না ইউরােপ এবং আমেরিকার। পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা ইয়াহিয়ার বর্বরতা এবং অপকৌশলেরই পরিণাম। ইউরােপ এবং আমেরিকা যদি সব দিক থেকে পাকিস্তানকে বর্জন করত তবে একটা সুনিশ্চিত ফল পাওয়া যেত। এপথে তারা পা দেবে না। নৈতিক উপদেশের মাহাত্মে তারা ইয়াহিয়ার সুবুদ্ধি ফিরিয়ে আনার কসরত বিশ্ববাসী। অবশ্য পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণ বন্ধ করেছেন অনেকে। তাতে দমে নি পাকিস্তান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলের সঙ্গে আলােচনা বৈঠকে সে বসবে না। সাফ কথা বলে দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান অসম্ভব। এখন কি করবে ভারত? প্রধানমন্ত্রীর নিজের মােহ ভেঙ্গেছে এক তিনি পশ্চিমী দুনিয়াকেও মােহমুক্ত করেছেন। ইউরােপ এবং আমেরিকার কাছে একথা আজ স্পষ্ট যে, কারও অন্যায় চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না ভারত। নিজের পথ সে বেছে নেবেই। কি সেই পথ? সাত মাস চলে গেছে। শরণার্থীরা কবে স্বদেশে ফিরে যেতে পারবেন—কোন মহল থেকেই মিলছে না তার কোন হদিশ। জনসাধারণের উপর বসেছে কর। এই করের মেয়াদ কত দিন, তা অবশ্যই জানতে চাইবেন করদাতারা। গত ক’মাস ধরেই পাক-ভারত সীমান্ত অগ্নিগর্ভ। প্রতিদিন বেড়ে চলেছে পাকিস্তানি উস্কানী। আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে পাক-জঙ্গী বিমান। উভয় পক্ষের সৈন্যদলের মধ্যে হামেশাই হচ্ছে গুলী বিনিময়। অস্বাভাবিক উত্তেজনার মধ্যে বেশী দিন রাখা চলে না সাধারণ মানুষকে। চোখের সামসে তারা যদি দেখতে না পান বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তবে হাপিয়ে উঠবে মন। গণজাগরণের স্থান নেবে গণনৈরাশ্য। সংসদের আসন্ন অধিবেশনে অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্নের জবাবের জন্য তৈরী থাকতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। গত সাত মাস ধরে চলছ নয়াদিল্লীর কূটনৈতিক তৎপরতা। তার বাস্তব ফলাফল জানার দাবী জানাবেন সংসদ সদস্যরা। শরণার্থীসমস্যা আর বেশী দিন ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন না নয়াদিল্লী। সিদ্ধান্ত তাদের নিতেই হবে। সব পথ প্রায় বন্ধ। একমাত্র ভরসা বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিবাহিনী। নূতন কবে জোরদার হয়ে উঠবে এ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের দাবী। মুক্তিবাহিনীর সংগ্রামী শক্তি বাড়িয়ে তােলার প্রয়ােজন দেখা দেবে পদে পদে। খােলা মন নিয়েই ফিরে আসছেন প্রধানমন্ত্রী এবং খােলা মনেই তাকে নিতে হবে সিদ্ধান্ত। কালক্ষেপের অবকাশ নেই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৩ নভেম্বর ১৯৭১