You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.27 | পাক কান্না থামাতে বৃটেন ও আমেরিকা | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পাক কান্না থামাতে বৃটেন ও আমেরিকা

বয়রার মারটা সামান্য। মাত্র তেরটি শেফি ট্যাঙ্ক, তিনটি স্যারাম জেট এবং শ-আড়াই সৈন্য হারিয়েছে পাকিস্তান। তাতেই ইয়াহিয়ার দু-চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। তিনি দিকে দিকে দূত পাঠাচ্ছেন এবং চিঠি লিখছেন। সবার কাছে তার আর্জি ভারতীয় জওয়ানেরা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকেছে। ওদের থামাও। নইলে পাক-ভারত লড়াই বেধে যাবে। বৃটেন ও আমেরিকা পাক-দোস্তের দুর্দশা দেখে ত্রাসে কম্পমান। তাদের মধ্যেও উঠছে গেল গেল রব। মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব উইলিয়ান রােজার্স ডেকে পাঠিয়েছিলেন ওয়াশিংটনের ভারতীয় চার্জ ডি এ্যাফেয়ারসকে। পাক-ভারত সীমান্ত থেকে উভয় পক্ষের সৈন্যাপসারণই চাচ্ছে না, সেখানে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক দল বসাবার স্বপ্নও দেখছে। চীনাদের মতিগতিতে বেশী ভরসা পাচ্ছেন না ইয়াহিয়া খান। মুখে তিনি বলছেন–সংকটকালে পাক সাহায্যে এগিয়ে আসবেন পিকিং। যাদের এগিয়ে আসার কথা, তারা বেশী উচ্চবাচ্য করছেন না। অভিমানে ভেঙ্গে পড়ছেন জঙ্গীচক্র। ওদের মহানায়ক ইয়াহিয়া জানাচ্ছেন—ভারত এবং পাকিস্তান এখন যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন অসম্ভব। এই পর্যায়টা অবশ্যই যুদ্ধের পর্যায়। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন যদি অসম্ভব হয়ে থাকে, তবে বৃহৎ শক্তিগুলাের হাতে-পায়ে ধরে এত কাকুতি-মিনতি করছেন কেন? ওয়াশিংটনে তার দূত বলছেন—পাকভারত সামরিক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য মার্কিন কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা দেবেন, পাকিস্তান তাই মেনে নেবে। ওদের অবস্থাটা শ্মশানযাত্রীদের মত। সবাই একসঙ্গে কাদছে। কিন্তু কান্নার রােলের মধ্যে ধরা পড়ছে। সুরবৈচিত্র এবং তালের ওঠা-নামা অসঙ্গতি।
নাছােড়বান্দা আমেরিক। প্রেসিডেন্ট নিকসনের মুখেন উপর বলে দিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে সীমান্ত থেকে সৈন্য সরাবেন না নয়াদিল্লী। অতর্কিতে ভারত আক্রমণের কোন সুযােগ পাবেন না ইয়াহিয়া খান। দুবার পাকিস্তান করেছে বিশ্বাসঘাতকতা। ঠাণ্ডা মাথায় ভারতের উপর হামলা চালিয়েছে সে। তাকে নিন্দা করা তাে দুরের কথা, বারে বারে মার্কিন কর্তৃপক্ষ এই যুদ্ধবাজদের দিয়েছেন প্রশ্রয়। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া যখন চালাচ্ছিলেন গণহত্যা এবং লক্ষ লক্ষ নরনারীকে ঠেলে পাঠাচ্ছিলেন ভারতে, তখন কোথায় ছিল আমেরিকা? মানবদ্রোহীদের সে কি দেয়নি মারণাস্ত্র? সীমান্ত বরাবর, প্রথম যখন সৈন্য সাজালেন ইয়াহিয়া খান, তখন কি আমেরিকা নিশ্চিন্ত আরামে চোখ বুজে থাকেনি? এই ঘটনার সপ্তাহখানেক পরে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে ভারত। তারপর নড়েছে মার্কিন টনক। এখন ভারত এবং পাকিস্তানকে সে ডেকে বলছে সীমান্ত থেকে সৈন্য সরাও। আগ্রাসী এবং আত্মরক্ষাকারী কি একই পর্যায়ে পড়ে? মার্কিন কর্তৃপক্ষ নিজেই স্বীকার করেছেন—পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনার কারণ বাংলাদেশ সমস্যা এবং ভারতে এক কোটি শরণার্থীর আগমন। গত আট মাসের মধ্যে এ-সমস্যা সমাধানের জন্য কি করেছে আমেরিকা? পাকিস্তানে তার অস্ত্র রপ্তানী এবং বাংলাদেশে গণহত্যা সম্পর্কে তুফীম্ভাব সমস্যার সমাধানের বদলে বাড়িয়েছে জটিলতা। প্রেসিডেন্ট নিকসন হয়ত বুঝতে পারছেন দস্যুদের হাতে তার দেওয়া অস্ত্র আর রুখতে পারছে না মুক্তিযােদ্ধাদের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসন্ন। পাকবাহিনীর কবর রচনা সেখানে প্রায় সমাপ্তির মুখে। মৃত্যুপথ যাত্রীকে বাঁচাতে চচ্ছেন মার্কিন ধুরন্ধররা। বাংলাদেশ এবং শরণার্থী সমস্যা এড়িয়ে তারা বড় করে তুলছেন পাক-ভারত বিরােধ। গত আট মাসের প্রাণান্তকর চেষ্টায় যা পারেননি ইয়াহিয়া খান, তা সম্পূর্ণ করার ভার নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। তার আগে নাচছে বৃটেন। সে-ই না এক সময় বলেছিল—পাকভারত সামরিক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য দরকার বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। কোথায় গেল আজ সেদিনের ঘােষণা? মাসের পর মাস চলেছে হীথ ইয়াহিয়া ফষ্টিনষ্টি। তার পরিণতি জানে না ভারত, জানে না দুনিয়া। ইয়াহিয়া স্পষ্টই বলেছেন মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইসলামাবাদের হবে না কোন শান্তি-বৈঠক। এ-সঙ্কল্পে তিনি এখনও অটল। বাইরে দেখা যাচ্ছে না তার মানসিক নমনীয়তার কোন লক্ষণ। অনর্থক ঘােষণার নীচে কেন খেমটা নাচ নাচছেন প্রেসিডেন্ট নিকসন এবং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী হীথ?
বড় আশা নিয়ে বৃটেন একদিন গড়ে তুলেছিল বাগদাদ সামরিক জোট। ইরাকের নূরী এস সৈয়দ ছিলেন তার পধান খুঁটি। ১৯৫৮ সালের ইরাকী বিপ্লবের পর নূরীর শব জানপথ পরিণত হয়েছিল মাংসপিন্ডে। তা নিয়ে মহােৎসবে মেতেছিল রাস্তার নেড়ী কুত্তার দল। ওতে আবার ভাগ বসিয়েছিল রাজ্যের যত দাঁড়িকাক। বাগদাদ চুক্তি থেকে বাগদাদ পড়েছে খসে। ওর সদর দপ্তর এখন তুরস্কে। নূরীর স্থান নিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। তিনি আবার সেন্টো (বাগদাদ চুক্তির পরবর্তী সংস্করণ) এবং সিয়াটোর শরিক। এই মহামানা দোস্ত কে রক্ষার জন্য আদ-জল খেয়ে লেগেছেন বৃটেন এবং আমেরিকা। মাস চারেক আগে কিসিংগার নয়াদিল্লী এসে শাসিয়ে গিয়েছিলেন পাক-ভারত লড়াই বাধলে চীন যদি হস্তক্ষেপ করে তবে নিরপেক্ষ থাকবে আমেরিকা। এই হুমকির সামনে সাত হাত মাটির নীচে সেধিয়ে যায়নি ভারত। যতই দিন যাচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে—এবার চৈনিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কম। কারণ পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া। মার্কিন প্রশ্রয়েই ইয়হিয়ার স্পর্ধা হয়ে উঠেছে আকাশচুম্বী। বাক্যের চোটে সিন্ধু এবং গঙ্গার জল রক্তে লাল করে ফেলেছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। নয়াদিল্লীর পথ এবং যুক্তি সরল। এক কোটি শরণার্থীর বােঝা নিয়ে অনন্তকাল অপেক্ষা করবে না সে। শান্তির পথে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে ইসলামাবাদ নারাজ। মুক্তিবাহিনী নিয়েছেন সংগ্রামের পথ। তাদের লড়াই জনতার লড়াই—তাদের লড়াই শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের লড়াই। ভারতের সমর্থন তারা পাচ্ছেন এবং পাবেন। তাতে যদি ইয়াহিয়া যুদ্ধ বাধান, তবে প্রত্যাঘাত অনিবার্য। প্রেসিডেন্ট নিকসন এবং প্রধানমন্ত্রী হীথ ক্ষ্যাপা ইয়াহিয়াকে সামলান। বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করুন। যদি না পারেন তবে চেয়ে থাকুন এই উপমহাদেশের দিকে। দেখবেন—আকাশে স্যাবার জেট জ্বলছে এবং মাটিতে হুমড়ি খাচ্ছে তাদের দেওয়া খয়রাতি ট্যাঙ্ক। আর ইয়াহিয়ার ভাগ্যে হয়ত জুটছে নূরী এস সৈয়দের পরিণতি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৭ নভেম্বর ১৯৭১