ইয়াহিয়াকে বাঁচাবার ষড়যন্ত্র
এক কোটি শরণার্থী স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন গুনছেন। পাক সৈন্যদের হামলা চলছে ভারতীয় এলাকায়। ওদের গােলাবর্ষণে মরছেন এপারের সাধারণ মানুষ। জওয়ানরা হানছে পাল্টা আঘাত। মুকিযযাদ্ধাদের অগ্রগতি অব্যাহত। একটির পর একটি পাক ঘাটির দখল নিচ্ছে তারা। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনী দিশাহারা। সমর উত্তেজনায় কাঁপছে পাকিস্তান। মাঝে মাঝে আসছে সর্বাত্মক লড়াই এর হুমকী। বৃহৎ শক্তিগুলাে চঞ্চল। ওদের মধ্যে ঘটছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া। পাক-দোস্তরা প্রকাশ্যে এবং নেপথ্যে বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধে পরিণত করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় ব্যস্ত। লক্ষ্য তাদের এক শরণার্থী সমস্যা চেপে যাওয়া এবং ইয়াহিয়াকে বাঁচানাে।
স্বস্তি পরিষদের বৈঠক আহ্বানের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বেলজিয়াম। তাকে নাকি সমর্থন দিচ্ছে ইতালী। এ ধরনের কসরতের ভয়ানক বিরােধী সােভিয়েট রাশিয়া। তার মতে, এ পাঁয়তারা সমস্যার মৌল কারণ এড়াবার উৎকট কৌশল। বৃটেন এবং আমেরিকা দুলছে সন্দেহ দোলায়। তাদের ধারণা, হয়ত আশানুরূপ সমর্থন জুটবে না স্বস্তি পরিষদে। সবার উপবে রয়েছে সােভিয়েট ভিটোর ভয়। মুখরক্ষার খাতিরে নিজেরা না এগিয়ে হয়ত বেলজিয়ামকে দিয়ে অবস্থাটা যাচাই করে নিচ্ছে এ দুটি রাষ্ট্র। কোন কোন মহল থেকে উঠছে অদ্ভুত প্রস্তাব—স্বস্তি পরিকল্পনা। তার মধ্যে আছে—শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উপায় উদ্ভাবনের জন্য আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন, সীমান্ত থেকে সব ভাবে পাক-ভারত সৈন্যাপসারণ, মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য দানে ভারতকে বিরত থাকার উপদেশ বর্ষণ এবং বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। নেপথ্যে শান্তি অভিযান চালাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। তিনি চিঠি পাঠিয়েছেন ভারত, পাকিস্তান এবং সােভিয়েট রাশিয়ায়। তার উদ্দেশ্য নাকি পাক-ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধ উত্তেজনা প্রশমন। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির প্রথম পর্যায় সীমান্ত থেকে পাক-ভারত সৈন্যাপসরণ। তারপর শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে কথাবার্তা।
গত আট মাস ধরে চলছে বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার মারণযজ্ঞ। এটা যখন ছিল একতরফা তখন উচ্চবাচ্য করে নি এসব তথাকথিত শান্তিকামীরা। বন্যার স্রোতের মত ভারতে শরণার্থী আগমনেও ঘটে নি তাদের চিত্তচান্ডল। গােটা দুনিয়া চষে বেরিয়েছেন ভারতীয় মন্ত্রীরা। আন্তর্জাতিক সমাজের সুপ্ত বিবেক জেগে ওঠার কোন লক্ষণই দেখা যায় নি। এখন মুক্তিবাহিনীর মারের তীব্রতা বাড়ছে দিন দিন। কঠোর মনােভাব নিয়েছে। ভারত। পাক হামলার মােকাবিলায় পিটুনী দাওয়াই দিয়েছে সে। বাংলাদেশ প্রায় ইয়াহিয়ার হাতছাড়া। নূতন করে দিচ্ছেন তিনি যুদ্ধের হুমকি। এ হুমকি কার্যকর হলে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্বাধীনতা পাবে বাংলাদেশ। সঙ্গে সঙ্গে ডুববে পশ্চিম পাকিস্তান। এই কঠোর সত্য ভালভাবেই জানেন, পাক-দোস্তরা। তাই তাকে রক্ষা করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছেন তারা। এই অপচেষ্টা সার্থক করে তােলার প্রধান উপায় বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধ পরিণত করা। তার জন্য দরকার উভয় রাষ্ট্রকে একই পর্যায়ে টেনে আনা। তা করতে পারলেই ধামাচাপা পড়বে বাংলাদেশ ও শরণার্থী সমস্যা। ইয়াহিয়া খান। পাবেন সঙ্কটের জাল থেকে বেরিয়ে আসার পথ। মরবে বাংলাদেশের জনতা। আর শরণার্থীর বােকা নিয়ে ধুকবে ভারত। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর মারের টেঙ্গো আজ উচ্চগ্রামী। জওয়ানদের পিটুনির চোটে পাকসৈন্যরা অস্থির। ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশে রাখতে হলে প্রয়ােজন ভারতের পিটুনি অভিযানের বিরতি এবং মুক্তি বাহিনীকে কোণঠাসা করার কার্যকর ব্যবস্থা। ইসলামাবাদের পক্ষে যা অসম্ভব তা সম্ভব করতে চাচ্ছেন। তাদের দোস্তরা। স্বস্থি পরিষদকে চাঙ্গ করার তালে আছে বেলজিয়াম। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যার সময় রাষ্ট্রসঙ্ঘের দরজায় ধর্ণা দিয়েছিল অনেকে। তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেক্রেটারী জেনারেল উ থাল্ট। প্রেসিডেন্ট নিকসন কেন চাপ দেন নি ইয়াহিয়ার উপর? ভারতের পাল্টা ব্যবস্থা নেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি হচ্ছেন সক্রিয়। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য কালহরণ। স্বাধীনতর দ্বারপ্রান্তে আসা মুক্তিবাহিনীকে থামাবার কূটকৌশল। বেলজিয়াম প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্যও তাই। কেন বাংলাদেশ সমস্যা সৃষ্টি হল, কে এটা সৃষ্টি করল এবং কেন কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিল সরাসরি এসব প্রশ্নের ধারে কাছে যেতে চাচ্ছে না কেউ। ব্যতিক্রম শুধু সােভিয়েট রাশিয়া। সে-ই হাত দিয়েছে সমস্যার গােড়ায়।
দুঃখ লাগে মিশরের কান্ড-কারখানা দেখে। এতদিন নাকি সে চালিয়েছে গােপন কূটনৈতিক তৎপরতা। ইয়াহিয়ার বিপদের দিনে প্রেসিডেন্ট সাদাত নিয়েছেন প্রকাশ্য তৎপরতা। নিজের চরখায় তেল দিন তিনি। আরর-ইস্রাইল বিরােধ মীমাংসার জন্য করুন আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন। ওরা করবেন প্যালেস্টাইনী উদ্বাস্তুদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উপায় উদ্ভাবন। আরব এবং ইস্রাইল সমভাবে বন্ধ রাখুক যুদ্ধরিততি সীমারেখা থেখে গােলাগুলী বিনিময়। প্যালেস্টাইনী গেরিলাদের সাহায্য দানে বিরত থাকুক মিশর। তারপর শুরু হােক আরব-ইস্রাইল বিরােধ মীমাংসর পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যম। এই পর্যায়গুলাে রূপায়ণের ব্যবস্থা করতে পারলেই ভারতকে উপদেশ দানের নৈতিক অধিকার পাবেন প্রেসিডেন্ট সাদাত। মতলববাজদের চিনে ফেলেছেন নয়াদিল্লী। আট মাস অপেক্ষার পর তারা নিয়েছেন বাস্তব পথ। মুজিবর রহমানের মুক্তির আশা সুদূরপরাহত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছাড়বেন না ইয়াহিয়া খান। তার বদলে তিনি বাংলাদেশের বুকের উপর বসিয়েছেন একটি দালাল সরকার। এ অবস্থায় শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অসম্ভব। সমস্যা সমাধানের একমাত্র খােলা পথ পিটুনি অভিযান এবং মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তিবৃদ্ধি। সময় এবং পরিবেশ ভারতের অনুকূলে। এ সুযােগ হাতছাড়া করা চলবে না। ইয়াহিয়ার উপর সশস্ত্র চাপ বাড়ছে এবং বাড়বে। স্বার্থন্বেষীরা যত খুশী পায়তারা করুন। আসল সমস্যা এড়াবার কোন সুযােগ তাদের দেওয়া হবে না। ঘাতকের হাত আজ দুর্বল। রক্তহীনের দেহে রক্ত সঞ্চারের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে ভারতীয় জনতা দৃঢ়সঙ্কল্প।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩০ নভেম্বর ১৯৭১