You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.08 | কালােবাজারীদের কি সত্যিই শায়েস্তা করা হবে? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

কালােবাজারীদের কি সত্যিই শায়েস্তা করা হবে?

অতএব আমাদের পশ্চিম বাংলা সরকার নড়ে-চড়ে বসেছেন এবং নতুন হাতিয়ার নিয়ে মুনাফাশিকারী ও চোরাকারবারীদের সংহারের জন্যে অভিযান শুরু করতে চলেছেন। যেসব কুলােক এতদিন বলতেন আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের শায়েস্তা করার জন্যে তৈরী হয়েছে তাঁদের অতঃপর নিশ্চয়ই মুখ বন্ধ হবে। আমাদের রাজ্যপাল শ্রীঅ্যান্টনি ল্যান্সলট ডায়াস শুধু রাইটার্স বিল্ডিংয়ের চুনাে-পশুটিদের সম্পর্কেই কড়া হতে জানেন, এমন কথাও আর বলা চলবে না। আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন যদিও কয়েক মাস আগেই তৈরি হয়েছে এবং জিনিসপত্রের দামও চড়তে শুরু করেছে বেশ কিছুদিন ধরেই, তবু যে রাজ্য সরকার এই অত্যন্ত বিলম্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে চলেছেন সেজন্য সাধারণ মানুষ অবশ্যই কৃতজ্ঞ। অবশ্য শুধু সরকারকে দুষেই বা লাভ কী? আকাশ-ছোঁয়া দামের ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠলেও যে সব আগুনখেকো রাজনৈতিক দল কথায় কথায় সগ্রামের জন্যে রাস্তায় নেমে পড়ে তারা এ বিষয়ে প্রায় কোনাে উচ্চবাচ্যই করে নি। শেষ পর্যন্ত যুব কংগ্রেস ও ছাত্র পরিষদের কর্মীরা আসরে নেমে চড়া দামের প্রশ্নটাকে বড় করে তুলে ধরতে পেরেছেন। যুব কংগ্রেসস ও ছাত্র পরিষদের চরমপত্রের সঙ্গে সরকারি উদ্যোগের অবশ্যই যােগ আছে, তবে শুধু সরকারি ঘােষণাতেই অসাধু ব্যবসায়ীদের হৃৎকম্প উপস্থিত হবে এমন ধারণা পােষণ করা হয়ত ভুল।
কারণ স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকির কোনাে অভাব হয় নি, অভাব হয়েছে শুধু কার্যক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের। অসাধু ব্যবসায়ীদের নিকটতম ল্যাম্পপােষ্টে কোনােদিন সকালে উঠে কেউ নিকটতম ল্যাম্পপােষ্টগুলােতে কালােবাজারীদের সারি সারি মৃতদেহ ঝুলতে দেখেছে বলে শােনা যায় নি। তার কারণ নিশ্চয়ই এই নয় যে, দেশে ল্যাম্পপােষ্পের অভাব ছিল অথবা কালােবাজারীদের মধ্যে রাতারাতি গান্ধীপন্থায় হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। দু চারজন চুনাে-পুঁটির গায়ে হাত পড়লেও রাঘব বােয়ালদের কেশও ছােয়া যায় নি। তা যদি যেত, তবে কালাে টাকার পাহাড় গােটা দেশের অর্থনীতিটাকেই বিপর্যস্ত-প্রায় করে তুলতে পারত না। আর সরকার এতদিন শুধু আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনের আশাতেই বসেছিলেন এমনও মনে করা চলে না কারণ তার আগেও পি-ডি অ্যাক্ট নামে একটা বিচারে ফাটকে পােরা যেত। তা ছাড়া, বিনা বিচারের ব্যবস্থাটাই বা কেন? যেসব অসাধু ব্যবসায়ী রােগীর ওষুধ থেকে শুরু করে শিশুর খাদ্য পর্যন্ত, সব কিছু নিয়েই মুনাফাবাজী চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে প্রমাণপত্রই কি সরকারের হাতে নেই? আমরা মনে করি বিনা বিচারের চেয়ে বিচারটা বেশি জরুরী, সেই বিচার হওয়া দরকার প্রকাশ্য আদালতে এবং বিচারের পর শাস্তিটাও এমন কঠোর হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা শিকারে মত্ত হওয়ার আগে সন্ত্রস্ত হয়।
বন্যা, শরণার্থী আগমন প্রভৃতি কারণের ফলে পশ্চিম বাংলার জিনিসপত্রের জোগান কমায় এবং চাহিদা বেড়ে যাওয়ার যেসব ব্যবসায়ী এই সঙ্কটের অন্যায় সুযােগ নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার সত্যিই কড়া ব্যবস্থা নেবেন, এটাই আমরা আশা করব। আর সেই ব্যবস্থা যাতে সত্যিই রাঘব-বােয়ালদের দুষ্টচক্রে গিয়ে ঘা দিতে পারে তার জন্যেও আহ্বান জানাবাে। এই কঠোরতা এখন অরাে বেশি প্রয়ােজন এই জন্যে যে, দেশে এখন একটা অঘােষিত জরুরী অবস্থা চলছে, সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে শত্রুসৈন্য এবং দেশের মধ্যে নাশকরাও অত্যন্ত তৎপর। এই অবস্থায় মুনাফাবাজীও এক ধরনের নাশকতামূলক কাজ। এত এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। যেসব নীতিহীন ব্যবসায়ী পশ্চিম বাংলার এই সঙ্কটের জন্যে দায়ী তারা অনেকেই রাজ্য সরকারের নাগালের বাইরে। গত ২৪ বছরে এই রাজ্যের উন্নতির বছর এমনই যে, চাল-গম তাে বটেই, এমন কি ডাল-সরষের তেলম, আলু থেকে শুরু করে মশলা পর্যন্ত সব কিছুরই একটা বড় অংশের জোগানের জন্যে আমরা অন্যান্য রাজ্যের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং অন্যান্য রাজ্যের অসাধু ব্যবসায়ীরা যদি জিনিসপত্রের দাম চড়ায় অথবা কৃত্রিম সঙ্কটের সৃষ্টি করে তবে পশ্চিম বাংলা সরকারের একার কিছু করার থাকে না। সে জন্যে প্রয়ােজন সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সহযােগিতা অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ। প্রথমােক্ত পথে বাধা অসম্ভব নয়, বিশেষতঃ এই রাজ্যে যখন কেন্দ্রীয় শাসনই চালু রয়েছে। কিন্তু চড়া দাম সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের মতাে জগদ্দলকে নাড়া দেওয়া বড়ই কঠিন কাজ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ নভেম্বর ১৯৭১