প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সম্ভাব্য মস্কো সফর
আগামী বছর মে মাসে প্রেসিডেন্ট নিকসন যাবেন মস্কো সফরে। তার আগেই তিনি সেরে ফেলবেন পিকিং নেতাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনা। কিসিংগার করছেন তার চীন সফরের বন্দোবস্ত। ফিনিশিং টাচটা বাকী। ওটা ঠিকঠাক হতে আর দেরি নেই। প্রেসিডেন্ট নিকসনের সম্ভাব্য মস্কো এবং পিকিং সফর সাম্প্রতিককালের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ঘটনা। এ দুটি সফরের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নিকসন হয়ত হবেন নির্বাচনপ্রার্থী। তার জন্য দরকার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির। মস্কো পিকিং সফর পরিকল্পনার গােড়ায় হয়ত রয়েছে এ ধরণের গােপন উদ্দেশ্য। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সময়টা খারাপ। লেজে গােবরে একাকার হয়েছেন। তিনি ভিয়েৎনামে। লড়াই সম্প্রসারিত করেছিলেন কম্বােডিয়ায়। মার খেয়ে ফিরে এসেছেন। ফল যা পাওয়া গেছে তা সামান্য। দক্ষিণ ভিয়েৎনামের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি প্রহসন। মার্কিন মর্যাদার উপর এসেছে বড় রকমের আঘাত। বাংলাদেশ নিয়ে করতে গিয়েছিলেন তিনি চালাকী। গােপনে অস্ত্র পাঠাচ্ছিলেন পাকিস্তানে। ধরা পড়েছেন হাতেনাতে। স্বদেশে উঠেছে কঠোর সমালােচনা। দ্বিতীয়বার নির্বাচনপ্রার্থী হতে হলে জাতির বিরূপ মনােভাবের পরিবর্তন প্রয়ােজন। প্রেসিডেন্ট নিকসন এখন শান্তির দূত সাজতে ইচ্ছুক। তার ধারণা, মস্কো এবং পিকিং সফর তাঁকে দেবে শান্তিকামীর সার্টিফিকেট। তাতে নরম হবে মার্কিন জনমত।
পিকিং এ তিনি যখন যাবেন তখন হয়ত সেখানে পাবেন নরমপন্থী নেতাদের। তাঁদের সঙ্গে আলােচনার গতি হয়ত থাকবে অব্যাহত। কিন্তু মৌল নীতি কিছুতেই ছাড়বে না চীন। তাইওয়ানের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কোন মতেই স্বীকার করবেন না পিকিং নেতারা। নরমপন্থী এবং চরমপন্থী সব নেতাই এ সম্পর্কে একমত। রাষ্ট্রসঙ্ঘে উঠেছে চীনা প্রসঙ্গ। তাকে বিশ্বসংস্থার এবং নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ দিতে আপত্তি নেই আমেরিকার। কিন্তু তাইওয়ান? রাষ্ট্রসঙ্ থেকে তাকে বহিষ্কারে মার্কিন কর্তৃপক্ষ নারাজ। এই বহিষ্কার ছাড়া চীন কিছুতেই যাবে না রাষ্ট্রসংঘে। এখন চলছে সাধারণ পরিষদের (রাষ্ট্রসঙ্ঘের) অধিবেশন। চীনা প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্কের সময় মার্কিন মনােভাবের উপর অনেকাংশে নির্ভর করবে নিকসনের পিকিং সফরের সাফল্য এবং অসাফল্য। ভিয়েৎনামের প্রশ্নে হয়ত প্রেসিডেন্ট নিকসন পাবেন চীনের খানিকটা অনুকূল মনােভাব। সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগর্ণি সম্প্রতি হ্যানয় সফর করে এসেছেন। ভিয়েৎনামী সংগ্রামে সােভিয়েট সাহায্যের প্রতিশ্রুতি উদার। হ্যানয়ও আগের চেয়ে মস্কোর প্রতিশ্রুতির উপর বেশি আস্থাবান। উত্তর ভিয়েৎনামের প্রত্যক্ষ শত্রু আমেরিকা। এই শত্রুর সঙ্গে পিকিং নেতাদের গলাগলিভাব অবশ্য সুনজরে দেখবে না হ্যানয়। যেকোন আন্তর্জাতিক প্রশ্নে নাকচোখ বুজে চীনকে সমর্থন করতে পারছে না উত্তর ভিয়েৎনাম। বাংলাদেশ সমস্যা তার প্রমাণ। এখানে চীন এবং উত্তর ভিয়েৎনাম ভিন্ন পথের যাত্রী। পিকিং দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সংগ্রাম পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। আর হ্যানয়ের কাছে ওটা মুক্তি সংগ্রাম। পিকিং এবং হ্যানয়ের ছাড়াছাড়ির সম্ভাবনা অবশ্যই জোগাবে প্রেসিডেন্ট নিকসনের আত্মতুষ্টি। উত্তর ভিয়েৎনাম থেকে চীন একটু সরে দাঁড়ালে সেখানে দেখা দেবে সােভিয়েট রাশিয়া। ফলে সমস্যাটা থেকেই যাবে। এর একটা ফয়সালার জন্য নিকসনের মস্কো সফরও আবশ্যক।
অন্তত: দুটি ক্ষেত্রে আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়া দাঁড়িয়ে আছে মুখােমুখী। একটি ভিয়েৎনাম এবং অপরটি পশ্চিম এশিয়া। ভিয়েৎনামে যারা যুদ্ধরত তাদের একটির পিছনে রয়েছে সােভিয়েট রাশিয়া এবং অপরটির পিছনে আমেরিকা। পশ্চিম এশিয়ায়ও অনুরূপ অবস্থা। মস্কোর আশ্রিত সংযুক্ত আরব রিপাবলিক এবং মার্কিন আশ্রিত ইস্রাইল। প্রেসিডেন্ট নিকসনের সম্ভাব্য মস্কো আলােচনায় এ দুটি অঞ্চলের সমস্যা অবশ্যই পাবে প্রাধান্য। তার উপর আছে ইউরােপের শান্তি এবং অস্ত্র হ্রাসের কূট প্রশ্ন। পশ্চিম জার্মানী নিয়েছে সামরিক উত্তেজনা প্রশমনের পথ। পূর্ব ইউরােপের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সে আগ্রহী সাম্প্রতিককালে কয়েকটি শান্তিকামী চুক্তিতে গােটা ইউরােপকে দিয়েছে সে স্বস্তির প্রতিশ্রুতি। পশ্চিম ইউরােপের অন্যান্য রাষ্ট্রও এ উদ্যমের উৎসাহদাতা। কিন্তু বাগড়া দিচ্ছে বৃটেন। ন্যাটো এবং ওয়ারশ চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে যখন চলছে সৈন্য হ্রাসের বাঞ্ছিত আলােচনার উদ্যোগ পর্ব তখন বৃটেন বহিষ্কার করল শতাধিক সােভিয়েট কুটনীতিবীদ এবং ব্যবসায়ীকে সােভিয়েট রাশিয়া নিয়েছে প্রতিশােধ। এখন দেখা যাচ্ছে বৃটিশ হঠকারিতায় সমর্থন নেই আমেরিকার কিম্বা অপর কোন ইউরােপীয় রাষ্ট্রের। ফলে বৃটিশ সরকার পড়ে গেছেন বেকায়দায়। তাঁরা আস্তে আস্তে পিছু হটছেন। প্রেসিডেন্ট নিকসনের বিশ্বাস তার মস্কো সফরের আগেই ইউরােপীয় শান্তি উদ্যমের প্রাথমিক পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে। তিনি সাফল্যের গৌরব নিয়ে মস্কো থেকে ফিরতে পারবেন স্বদেশে। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্টের পদপ্রাপ্তির সম্ভাবনার পথও তাতে হবে সুগম। তবে পিকিং এবং মস্কোর পথ বহুদূর। পাড়ি না জমান পর্যন্ত বিশ্বাস নেই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ অক্টোবর ১৯৭১