বিড়াল তপস্বী ইয়াহিয়া খান
ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ চনে না। আলােচনার মাধ্যমে তিনি পাক-ভারত মীমাংসার পক্ষপাতী। তাঁর মতে, যুদ্ধ বাধলে উভয় রাষ্ট্রের জনগণের দুঃখ দুর্দশা বাড়বে। শরণার্থী সমস্যারও হবেনা কোন সমাধান। পাক-ভারত বিরােধের একটা ফয়সালার জন্য যেকোন সময়, যেকোন স্থানে এবং যেকোন নেতার সঙ্গে তিনি শান্তি বৈঠকে রাজী। পাক-প্রেসিডেন্ট এ কথাগুলাে বলেছেন ফরাসী পত্রিকা লা ম’দের প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। এত সুবােধ বালক ইয়াহিয়া খান তা হয়ত ফরাসীরা আগে জানতেন না। এখন হয়ত তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। পাক-ভারত যুদ্ধটা আর হল না। হবেই বা কি করে? ইয়াহিয়া নিজেই বলেছেন, পাকিস্তানের চেয়ে পাঁচগুণ বড় ভারত। তার সমর শক্তিও পাঁচগুণ বেশী। এ অবস্থায় কি করে ভারতের উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে পাকিস্তান? এখন যে উত্তেজনা চলছে তা প্রশমনের জন্য যেকোন সালিশীতে তিনি সম্মত। ইয়াহিয়ার অভিযােগ-পাক-ভারত উত্তেজনার জন্য দায়ী নয়াদিল্লী। আট ডিভিশন সৈন্য দিয়ে তাঁরা ঘিরে রেখেছেন পূর্ব বাংলা। দলে দলে পাঠাচ্ছেন অনুপ্রবেশকারী। ওরা ধ্বংস করছে যােগাযােগ ব্যবস্থা। অসার করে ফেলছে পাক-অর্থনীতি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ সহ্য করা চলে না। বর্তমান সঙ্কটের পরিণতি কি হবে তা নির্ভর করছে নয়াদিল্লীর মতিগতির উপর।
চমৎকার অভিনেতা ইয়াহিয়া খান। ক’সপ্তাহ আগেও তিনি দিয়েছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের হুমকি। সীমান্ত বরাবর তিনিই আগে করেছেন সৈন্য সমাবেশ। একটা কথা ভুলে গেছেন ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তানের চেয়ে পাঁচগুণ বড় এবং পাঁচগুণ শক্তিশালী ভারতের উপর ১৯৬৫ সালে আক্রমণ আরম্ভ করেছিল কে? অবশ্যই এই ক্ষুদে পিঁপড়ে পাকিস্তান। তার ছাম্ব আক্রমণের পাঁচদিন পরে ভারত হেনেছিল প্রত্যাঘাত। ইসলামাবাদের বড় গর্ব-পাঁচগুণ বেশী শক্তিশালী ভারতকে মেরে তক্তা বানিয়েছে পাকিস্তান। এখনও পাক-জঙ্গীশাহী প্রতি বছর পালন করেন বিজয় দিবস। রাষ্ট্রসঙ্ এগিয়ে না এলে অবস্থাটা কি হত? যে গদীতে আজ বসে আছেন ইয়াহিয়া খান সে-গদী গুড়িয়ে যেত। সামরিক জৌলুস বজায় রাখার জন্য জনসাধারণের কাছ থেকে আসল কথা গােপন করে চলেছেন পাক-জঙ্গী নেতারা। পরাজয়ের রূপ দিচ্ছেন বিজয়ে। তা না হলে বজায় থাকে না জনগণের ভারত বিরােধী জঙ্গী মনােভাব এবং কায়েমী স্বার্থের জঙ্গী নেতৃত্ব। আপােষ আলােচনায় অস্বাভাবিক আস্থা দেখিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। এর মধ্যে যদি থেকে থাকে বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা তবে শ্রীমতী গান্ধীর শান্তি প্রস্তাব (বাংলাদেশ সমস্যা সৃস্টি হবার আগে) কেন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি বারবার? কেন দেন নি যুদ্ধ বর্জন চুক্তি সম্পাদনের আহ্বানে কোন সাড়া? কেন জঞ্জালের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করেছিলেন তাসখন্দ দলিল? নয়াদিল্লী এখনও শান্তি বৈঠকে রাজী। কিন্তু তাতে থাকবে না বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। কারণ এ সমস্যা মিটাবার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার এবং ইসলামাবাদের। ঘুষি পাকিয়ে বসে আছেন ইয়াহিয়া খান। দস্যু সর্দারের বদ্ধ মুষ্টির সঙ্গে কে করেবন করমর্দন? আঙ্গুলগুলাে তাে হুমকির মধ্যে ঢাকা।
ইয়াহিয়ার আসল মতলব প্রায় সবারই জানা। তিনি চান বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধে পরিণত করতে। তাই শ্ৰীমতী গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তার এত আগ্রহ- সালিশীর জন্য এত আকুতি। এক সময় তিনি বলতেন- ভারতে আগত শরণার্থীরা আসলে পাক-শরণার্থী নয়। ওরা কলকাতা এবং অন্যান্য শহরের ফুটপাতের বাসিন্দা। পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য তাদের ঝেটিয়ে পাঠান হয়েছে সীমান্তের শিবিরগুলােতে। পরে মতটা একটু পাল্টিয়ে বললেন দু’রকমের শরণার্থী আছে। আসল এবং নকল। আসলদের ফিরিয়ে নেব। নকলরা যথাস্থানে থাকবে। এখন বলছেন-সব শরণার্থীকেই তিনি গ্রহণ করবেন। তার জন্যই দরকার পাক-ভারত আলােচনা। আর মুক্তিবাহিনী? ওরা পূর্ব বাংলায় ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী এবং ভাড়াটিয়া। এদের আস্কারা দিচ্ছেন নয়াদিল্লী। তার জন্যই পাক-ভারত সামরিক উত্তেজনা। বাংলাদেশের শতকরা তেরজন নাগরিক এখন দিন কাটাচ্ছেন ভারতের আশ্রয় শিবিরগুলিতে। এরা কেন এলেন তা খতিয়ে দেখলেই ইয়াহিয়া ধরতে পারতেন নিজের নারকীয় নগ্ন মূর্তি। যে বীভৎসতার কাহিনী জানে বিশ্ববাসী তা জানেন না এই স্বৈরাচারী মানবদ্রোহী। মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সাধনার বলিষ্ঠ প্রকাশ। তাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বেচ্ছাচারী এবং মানবদ্রোহীর পূর্ণ উচ্ছেদ ছাড়া হবে না এ সংগ্রামের বিরতি। রক্ততিলকে শপথ নিয়েছেন বাংলাদেশ সরকার। মারের চোটে একটু একটু করে নির্মম সত্য বুঝতে পারছেন ইয়াহিয়া খান। আগে তিনি বলতেন- মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহী। এখন বলছেনজনগণ চাইলেই তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। এত রক্তপাতের পর স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এসে বাঙালী জনতা মহানুভব পাক সম্রাট ইয়াহিয়ার কাছে দাসখত লিখে দিয়ে মুজিবের মুক্তি চাইবে? বাংলাদেশের হৃদয়ের কতখানি জায়গা জুড়ে বসে আছেন মুজিবুর রহমান তা কি তিনি জানেন না? ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল কি তিনি ভুলে গেছেন? শুধুমাত্র বাংলাদেশ কেন, গােটা দুনিয়া আজ দাবী করছে মুজিবের মুক্তি। ইয়াহিয়া খান বলদর্পিত বধির। তার কানে পৌঁছায় না মানুষের ভাষা। তিনি বুঝেন অস্ত্রের ভাষা। তাই মুক্তিবাহিনী ধরেছে অস্ত্র। খতম করছে পাক-সৈন্য। এ ভাষা যত জোরালাে হবে ইয়াহিয়ার বধিরত্ব তত ঘুচবে। চালাকি দিয়ে ঢাকা যাবেনা আহম্মকী। তিনি যতই ফাঁদ পাতুন না কেন, তাতে পা দেবে না ভারত। বেশী বেয়াদবি করলে অস্ত্রের ভাষায় পাবেন উপযুক্ত জবাব।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২০ অক্টোবর ১৯৭১