মস্কো সফরে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আজ (সােমবার) যাচ্ছেন মস্কো সফরে। তার মন হয়ত নৈরাশ্যে ভরা। বাংলাদেশ সমস্যার সন্তোষজনক সমাধানের নেই কোন নিশানা। শরণার্থীর সংখ্যা নব্বই লক্ষের কোঠায় পৌঁছে গেছে। পাশ কাটিয়ে চলছে বৃহৎ শক্তিগুলাে। তারা দিচ্ছেন না ইয়াহিয়ার উপর বাঞ্ছিত চাপ। কেউ কেউ তাঁকে করছেন অর্থ সাহায্য। বাংলাদেশ সমস্যাটা পাক-ভারত বিরােধ বলে চালিয়ে দেবার জন্য কোন কোন মহলে আঁটছে ষড়যন্ত্র। প্রায় দেড় মাস আগে সম্পাদিত হয়েছে ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি। তারপর হয় নি বিশেষ কোন পরিবর্তন। ইসলামাবাদের গােয়ার্তুমী কমে নি একটুও। গ্রাহ্য করছেন না তারা বিশ্ব জনমত। বর্ষার শেষে মুক্তিবাহিনীর উপর পাক সৈন্যরা চালাবে প্রচণ্ড আক্রমণ। তার জন্য প্রস্তুতির নেই কোন ত্রুটি। আরও শরণার্থী আসবেন ভারতে। জলের মত খরচ হচ্ছে টাকা। বাইরের সাহায্য নগণ্য। শরণার্থীদের ফিরে যেতে হবে স্বদেশে। কিন্তু কবে যেতে পারবেন তা বলা নয়াদিল্লীর পক্ষে অসম্ভব। সুরু হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশন। সেখানে হয়ত উঠবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। সমস্যা সমাধানের মিলবে না কোন হদিশ। সােভিয়েট নায়কেরা নিজেরাও ভালভাবে জানেন সে-কথা। তারা ভেবেছিলেন ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তির পর সম্বিত ফিরবে ইসলামাবাদের। কিন্তু তা ফিরে নি। ক্রেমলিনে আফগান বাদশার সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের বক্ততায় আবার হুশিয়ারী দিয়েছেন সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পােদগণী। তিনি দাবী করেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গীশাহীর বর্বর্তার বিরাম নেই। ঘটনার বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থার পুনঃমূল্যায়ন খুবই দরকার। শ্রীমতী গান্ধীর মস্কো সফর একদিন থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব জনমত জাগ্রত করার জন্য চেষ্টার বিরাম ছিল না নয় দিল্লীর। পৃথিবীর প্রায় সবগুলাে রাষ্ট্রের দরজায় আঘাত করেছেন ভারতীয় প্রতিনিধিরা। বহু সরকারি এবং বেসরকারি পর্যবেক্ষক দল এসেছেন ভারতে। নিজেদের চোখে দেখেছেন তাঁরা শরণার্থী শিবিরগুলাে। দুনিয়ার বিবেক আজ আগের চেয়ে বেশী সচেতন। এই বিবেককে সঠিক এবং কার্যকর পথে চালনা করতে পারেন বিভিন্ন দেশের সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক গ্রুপ বাজীতে তারা এত মশগুল যে সত্য জেনেও তা না জানার ভান করছেন প্রতি পদক্ষেপ। জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সম্মেলন নিয়েছেন অসার প্রস্তাব। বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চাইতেও তারা নারাজ। আসামী পাকিস্তানের হাত মােচড়াবার বদলে আমেরিকা মােচড়াচ্ছে ভারতের হাত। অথচ বাংলাদেশ সমস্যা সৃষ্টি করে নি ভারত, করেছে পাকিস্তান। ভারতের অপরাধ, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে সে আশ্রয় দিয়েছে লক্ষ লক্ষ দুর্গত মানুষকে। মানব সেবার উপযুক্ত পুরস্কার পাচ্ছেন নয়াদিল্লী। কল্যাব্রতী সংস্থা বলে পরিচিত রাষ্ট্রসঙ্ঘ। যারা এর সদস্য তারা অনেকেই চেষ্টা করছেন ভারত এবং পাকিস্তানকে সমভাবে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার। বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। অন্যের সেখানে মাথা গলানাে অযৌক্তিক। এইসব বিকৃত বুদ্ধির দল নিয়ে কারবার করছেন নয়াদিল্লী। ওদের বােঝাতে পারছেন না বাংলাদেশ সমস্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছেন ভারতে আগত শরণার্থীরা। ওদের প্রত্যাবর্তনের জন্যই দরকার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। এই সমাধানের অর্থ—জন প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। যদি নব্বই লক্ষ শরণার্থী ভারতে না ঢুকতেন তবে মাথা ব্যথার কোন কারণ ঘটত না নয়াদিল্লীর। গাঁটের পয়সা খরচ হচ্ছে ভারতের, অন্য রাষ্ট্রের নয়। তাই তার মাথা ব্যথা এত বেশী। কঠোর বাস্তবের মুখােমুখী এসে দাঁড়িয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। আন্তর্জাতিক চাপে নতি স্বীকার করবেন ইয়াহিয়া খান সে-আশা নেই বললেই চলে। যে ধরনের চাপ তাদের প্রত্যাশায় ছিল তা আসবে না। কোনদিন। রাষ্ট্রসঙ্ঘে নূতন করে কিছু বলার নেই। বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা যা বলবেন তা ভালােভাবেই জানেন মহামান্য সদস্যরা। গত ছ’মাসে তাদের সরকারগুলাে পেয়েছেন অসংখ্য প্রামাণ্য চিত্র। ভারতীয় মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রদূতরা ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ দেশান্তরে। বলেছেন বাংলাদেশের কাহিনী। বিদেশ মুক্ত বাংলার নাগরিকরাও ছড়িয়েছেন হাজার হাজার প্রচারযন্ত্র। বাংলাদেশের বিদেশী বন্ধুরাও তােলপাড় করেছেন প্রায় গােটা দুনিয়া। পাক দূতাবাসগুলাের বাঙ্গালী কর্মীরা একে একে ছেড়েছেন ইসলামাবাদের আনুগত্য। গােটা বিশ্বের চোখে আঙ্গুল দিয়ে তারা দেখিয়েছেন বাংলাদেশ সমস্যার গভীরতা। তাতেও যদি আসল খবর কারও থেকে থাকে অজানা তবে কোনদিনই তা হবে না তাদের জানা। বাহুবল ছাড়া অন্য কোন পথে পাওয়া যাবে না ইয়াহিয়ার চ্যালেঞ্জের উত্তর। অন্য কেউ তুলে দেবে না মুজিবনগরের হাহে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা। ওটা নিতে হবে ছিনিয়ে। গত ছ’মাসের অচল অবস্থা হয়ত এনেছে শ্ৰীমতী গান্ধীর নূতন উপলব্ধি। এই উপলব্ধি যদি তিনি ভাগ করে দিতে পারেন সােভিয়েট নায়কদের মধ্যে তবেই ঘটবে তার মস্কো সফরের এবং ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তির সার্থকতা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১