আস্ফালন নয়, চাই কাজ
অগ্নিগর্ভ ভারতের পূর্বে সীমান্ত। হামেশাই এপার এসে পড়ছে পাক গােলাগুলী। মরছেন ভারতীয় নাগরিক। মাঝে মাঝে পাকিস্তানি। সৈন্যরা চড়াও হচ্ছে সীমান্তের গ্রামগুলাের উপর। সব তছনছ করে চলে যাচ্ছে তারা নিজেদের এলাকায়। এসব হানাদারের প্রধান সাকরেদ রজাকরদল। লুঠপাট এবং নারীহরণ তাদের অন্যতম লক্ষ। এদের দৌরাত্নে সীমান্তের অনেক গ্রাম এখন জনশূন্য। নিজেদের বাড়ীঘরে ফিরে যেতেও ভয় পান গ্রামের নিরস্ত্র মানুষগুলাে। এমনি সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে পাক-সৈন্যরা। ভারত দূর্বল রাষ্ট্র নয়। হানাদার বিতাড়নে তার সামর্থ্য প্রশ্নাতীত। জাওয়ানরা নাকি তৈরী। রক্ষীবাহিনীর অতন্দ্র প্রহরার কথা শােনা। গেছে বহুবার। তা সত্বেও পাক-হানাদারদের দুঃসাহর বাড়ছে দিন দিন। মনে হয়, প্রচণ্ড পাল্টা মার পড়ে নি তাদের পিঠে। যদি তপড়ত তবে ভারতীয় এলাকায় হানাদারী চালাবার সখ উবে যেদ দূদনের মধ্যেই। সীমান্ত লঙ্ঘনকারী পাক-সৈন্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবার দাবী উঠেছে অনেক আগেই। নয়াদিল্লীও দিয়েছেন হরেক রকমের আশ্বাস। কার্যক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের প্রতিশ্রুতি রূপায়ণের বিশেষ কোন প্রমাণ। ফলে জনগণের মনে দানা বেধে উঠছে অবিশ্বাস। কমে গেছে সরকারি আস্ফালনের গুরুত্ব।এ ধরনের নিরাশা জাতির নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রপাম হয়ত বুঝেছেন, জনগণের মনােবল অক্ষুন্ন রাখার যৌরিতা। বিহার বণিক সভায় তিনি দিয়েছেন ওজস্বিনী বতাি। তিনি বলেছেন ভারতীয় বাহিনী তৈরী। পাক-হানাদারদের আক্রমণ প্রতিহত করেই ক্ষান্ত হবেন না তারা। ধাওয়া করে নিয়ে যাবে। তাদের পাকিস্তানি এলাকায়। দূবৃত্তরা আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত বন্ধ হবে না অনুসরণ। এ ধরনের নির্দেশ পেয়েছেন জওয়ানরা। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌম মর্যাদায় যখন আঘাত হানে প্রবেশী রাষ্ট্রের হানাদার তখন প্রত্যাঘাত অবশ্য কর্তব্য। তার জন্য বেশী বাগাড়ম্বরের দরকার পড়ে না। নীরবে কাজ হাসিল করাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রকাশ্য আস্ফলনের অর্থ শত্রুর মনে ত্রাসের সৃষ্টি। ইসলামাবদের জঙ্গীশাসকরা এমনই বেপরােয়া যে,শুধু কথায় ফিরবে না তাদের সম্বিত। কথার সঙ্গে চাই কাজের সমন্বয়। কাশ্মীর সীমান্ত নিয়ে অনেক বীরত্বের কাহিনী শুনিয়েছেন কতৃপক্ষ। তাদের কথাবার্তায় মনে হয়েছে সজাগ প্রহরীদের অজান্তে একটা মাছি ঢােকারও সম্ভাবনা নেই সেখানে। কিন্তু কদিন আগেই ভারতীয় এলায় অনুপ্রবেশ করেছে একদল পাকিস্তানি। পরিবারবর্গ নিয়ে ঘর গুছিয়ে বসেছিল তারা। হঠাত টনক নড়েছে সীমান্ত নিরাপত্তার জিম্বাদারদের কেউ বলতে পারছেন না ওরা ঢুকল কোন পথে? কারও নজরেই বা পড়ল না কেন? পুলিশ রাখে না তাদের সংবাদ। এখন পড়েছে হৈ-চৈ। চারদিক থেকে চলছে জিঞ্জাসাবাদ। ওরা ছদ্মবেশী হানাদার, না শরনার্থী তা নিয়ে শুরু হয়েছে অনুসন্ধান। পাকিস্তানি বিমান ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে ফিরে যেতে দেওয়া হবে তাকে। একথা দেশবাসী শুনেছেন বহুবার। কর্যক্ষেত্রে দেখা যায় নি তার কোন প্রতিফলন। প্রায় মাস। দুয়েক আগে শ্রীনগর এবং জম্মুর উপর চককরা দিয়ে গেল পাক গােয়েন্দা বিমান। কোন বাধা গেল না তারা প্রতিশ্রুতি দিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ভবিষ্যতে আর ঘটবে না এমনতর ঘটনা। মাত্র কগিন আগে কাশ্মীরেই হয়েছে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ভারদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছ পাক জঙ্গি বিমান। আচ্ছা ধােলাই খেলে জঙ্গী পনার সাহস দেখাতে পারত না পাকিস্তান।
সাধারণ মানুষ আজ ত্যক্ত বিরক্ত। আস্ফালনের বদলে তারা চান কাজ।মন্ত্রীরা যা বলেন কার্যক্ষেত্রে ঘটে যদি তার ব্যতিক্রম তবে বাড়ে না তাদের মনােবল। আসে নৈরাশ্য এবং সরকারি আশ্বাসের প্রতি নিদারুণ ঔদাসীন্য। গত সাড়ে পাঁচ মাস ধরেই পূর্ব সীমান্তে চলছে পাক-দৌরাত্ন। নির্মম প্রতিশােধ নেন নি কর্তৃপক্ষ। সীমান্তরক্ষীর দিয়েছেন কেবল গতানুগতিক বাধা। কোন কোন স্থানে তাও দেন নি তারা। স্থানীয় অধিবাসীরাই করেছন এ ধরনের অভিযােগ। হানাদররা খুশীমত ঢুকবে ভারতীয় এলাকায় এবং তাড়া খেলেই পালিয়ে যাবে নিজেদের ঘাচিতে। সেখানে পা দিয়েই তারা নিশ্চিত। ওরা জানে নয়াদিল্লী ভয়ানক রকমের ভদ্র। পররাজ্যে ঢুকে কখনই ঠেঙ্গাবে না আক্রমণকারীদের। ইসলামাদের প্রচারযন্ত্রেরভয় তাদের সাংঘাতিক। হানাদারদের পিছু ধাওয়া করে পাক এলাকায় ঢুকলেই মরাকন্না সুরু করবেন ইয়াহিয়া খান। তার দোস্তরা তুলবেন সােরগােল। তাই নয়াদিল্লী মার খেয়েও নীরবে তা হজম করে নেন অক্রোশে। এটা তাদের দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। পাকিস্তান জানে ভারতের দূর্বলতা। তাই তার স্পর্ধা আকাশচুম্বী। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম স্পষ্ট কথা বলতে অভ্যস্ত। বিহার বণিকসভায় তার ভাষণ এই স্পষ্টোক্তির প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কিন্তু স্পষ্ট কথা এবং স্পষ্ট কাজ-দুটি আলাদা জিনিস। প্রতিরক্ষার প্রশেন স্পষ্ট কথার চেয়ে বেশী দরকার স্পষ্ট কাজ। স্পষ্ট কথায় শত্রুর হাতে তুলে দেয় প্রচারের হাতিয়র। আর স্পষ্ট কাজে ভাঙ্গে তার বিষ দাঁত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে বীরত্বব্যঞ্জক এহ অঙ্গীকার পেয়েছেন দেশবাসী। আর দরকার নেই সেগুলাের। কাজের দ্বারা প্রমাণ করুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী তার কথা এবং কাজ অভিন্ন। তাতে নেই কোন ফারাক। তবেই শায়েস্তা হবে পাকিস্তান।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১