সিংহলের মনােভাব কি বদলেছে?
সিংহল সরকারের বাংলাদেশ নীতি সুনজরে দেখেন নি ভারতের সাধারণ মানুষ। পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়ার গণহত্যা অভিযানের প্রথম পর্যায়ে এদেশটির কাছে পাকিস্তান পেয়েছিল পরােক্ষ মদত। সৈন্য বােঝাই পাকবিমানগুলাে নামত কলম্বাে বিমানঘাটিতে। জ্বালানী তৈল নিয়ে পাড়ি জমাত বাংলাদেশে। চট্টগ্রামগামী পাক জাহাজগুলােও রসদ নিত সিংহলের বন্দর থেকে। বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের মােকাবলায় এ সুযােগ লুফে নিয়েছিলেন ইসলামাদের জঙ্গী শাসকগােষ্ঠেী জনমতের প্রবল চাপে এ সুবিধা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছিলেন সিংহলী সরকার। তাদের যুক্তিহ চিরাচরিত-বাংলাদেশের লড়াই পাকিস্তানের অভ্যন্তীণ সমস্যা। তাতে মাথা গলাবে না সিংহল। আগের অবস্থা এখন আর নেই। প্রায় পচাশী লক্ষ শরণার্থী এসেছেন ভারতে। গােটা বিশ্বে চলছে আলােড়ন। রাষ্ট্র সঙ্ওে হয়ত উঠবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। এই পরিবর্তিত অবস্থায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্ববণ সিং গিয়েছিলেন সিংহল সফরে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তাতে কতখানি সার্থক হয়েছে তা অবশ্যই বিতর্কসাপেক্ষ।
শ্রীস্বরণ সিং বলছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে পেয়েছেন সিংহলী সরকারের প্রতিশ্রুতি। সৈন্য এবং অস্ত্রবাহী পাক বিমান এবং জাহাজগুলােকে তারা দেবেন না তৈল সংগ্রহের সুবিধা। পাক-সৈন্যরা যদি অসামরিক বেশে কলম্বাে পাড়ি দেয় তবে কি করবেন সিংহলী সরকার? কমাস আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তার বিবরণ দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ইউরােপীয় সাংবাদিকরা। শ্রীস্বরণ সিং কথিত সিংহলী প্রতিশ্রুতির কোন উল্লেখ নেই ভারত-সিংহল যুক্ত ইস্তাহারে। তাতে এই প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব কমে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী বন্দরনায়ক এখনও মনে করেন, বাংলাদেশের সঙ্কট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। তার সমাধানের দায়িত্ব ইমলামাদের। শ্রীমতী বন্দরনায়ক স্বীকার করেছন, ভারতে প্রায় পচাশী লক্ষ শরণার্থীর অবস্থানের গুরুত্ব। এদের প্রত্যাবর্তনের জন্য পাকিস্তানের শাসন সংস্কারের যৌক্তিকতাও তিনি মেনে নিয়েছেন। কেন এত গুলাে শরণার্থী ভারতে এল তার কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন নি সিংহলের প্রধানমন্ত্রী। শাসন সংস্কারের বাস্ত ব-রুপ সম্পর্কেও তিনি নির্বাক। ভারত, সােভিয়েট রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্র স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রধান সত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। এধরনের খােলাখুলি অভিমত দেন নি শ্রীমতী বন্দর নায়ক। এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি সমস্যার বাস্তব রুপ এবং তা সমাধানের সুনির্দিষ্ট উপায়।
খুবই সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছেন সিংহল সরকার। কিছুদিন আগেও সেখানে ঘটেছিল চরমকপন্থীদের বিদ্রোহ। তা দমনের জন্য শ্রীমতী বন্দরনায়ক নিয়েছিলেন বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলাের সাহায্য। যারা তাঁর সাহয্যে এগিয়ে গিয়েছিল ভারত ছিল তাদের অন্যতম। চরমপন্থীদের সামরিক অভ্যুথ্যান সিংহলের ঘরােয়া সমস্যা। এ সমস্যায় নাক গলাবার জন্য শ্রীমতী বন্দরনায়ক আহ্বান করেছিলেন বিদেশী রাষ্ট্রগুলােকে। আজ সিংহল সরকারই বলছেন বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। তাতে নাক গলানাে সিংহল। সরকরের নুসৃত নীতি বিরুদ্ধ। এ ধরনের সুযােগ-সন্ধানী কথাবার্তায় সমস্যা এড়ান চলে, কিন্তু কারও মনে বিশ্বাস সৃষ্টি করা যায় না। সার্বভৌম রাষ্ট্র সিংহল। সে যা ভাল বুঝবে, তাই করবে। কারও কিছু বলার নেই তাতে। প্রতিবেশী নােপালও একসময় নিয়েছিল সিংহলের পথ। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়নি সে। পারিবর্তিত অবস্থায় তার মনােভাবেরও ঘটেছে কিছুটা পরিবর্তন। সিংহলি মনের পরিবর্তন খুবই অস্পষ্ট। অন্তত: যুক্ত ইস্তাহারে নেই তার উল্লেখযােগ্য নিদর্শন। অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে সিংহল-ভারত মকৈক্য গতানুগতিক। প্রতিবেশি রাষ্ট্র সিংহর। তার বন্ধুত্ব অবশ্য কাম্য পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতকে অনুসরণ করবে—এ আশা অবাস্তব। নিজস্ব পথে চলার অধিকার শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নীতির মৌল ভিত্তি। এর জন্য দরকার পরমত সহিষ্ণুতা। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর বার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষেত্র পারস্পারিক সহযােগিতার অভাব হবে না এ দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে। সিংহলের শিল্পায়নে ভারতের ছকোটি টাকা সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি তারই অকাট্য প্রমাণ।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১