মালিক উবাচ
ড: এ এম মালিক নামে যে-ভদ্রলােক শস্ত্রপানি জেনারেল টিক্কা খানের পর পূর্ব বাংলা শারনের ভার পেয়েছেন, তিনি নামে অসাময়িক ব্যক্তি হলেও কাজে সামরিক প্রভুদের বুলি বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। দেখা যাচ্ছে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান লােক বাছতে বিশেষ ভুল করেন নি, কারণ এমন হিজ মাস্টার্স ভয়েস তাে চট করে খুজে পাওয় যায় না। যে লাখ লাখ শরণার্থী ভারতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন তাদের জন্যে এই চক্ষু-চিকিৎসক চোখের জলও ফেলেছেন। বটেই তাে দুপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে কি আর এমন একটা সামান্য সমস্যার মীমাংসা করা যায় না? কিন্তু যত গােল বাধিয়েছে ভারত। তারাই তাে শরণার্থীদের ফিরতে দিতে চায় না। ৮৫ লাখ মানুষের দায়-দায়িত্ব পালনের এমন সুখ সভারত কি সহজে বিসর্জন দিতে চায়? গভর্নর সাহেবের এ-সব কথা মােটেই যে নতুন নয় তা সবাই জানেন। এপ্রিল মাস থেকেই এই ধরনের কথাবার্তা ইসলামাবাদের কাছ থেকে শাে যাচ্ছে। তবে এপ্রিল মাস থেকে বলাটা বােধ হয় ঠিক হল না, কারণ শরণার্থীরা যে আদৌ পূর্ব বাংলা ছেড়ে ভারতে আসছেন, এ-সত্যটা স্বীকার করতেই পাক কর্তাদের বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। তবে সংখ্যাটা ক্রমশ: এমনই বাড়তে লাগল যে শেষ পর্যন্ত তারাও চক্ষুলজ্জার খাতিরে স্বীকার করে ফেলেছেন যে, কয়েক লাখ নরনারী পূর্ব বাংলা ছেড়ে গেছে। স্বয়ং ইয়াহিয়া খানই সেদিন এক ফরাসী পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে কুড়ি লাখ শরণার্থীর কথা স্বীকার করেছেন। আশা করা যায়, আর কিছুদিন সময় পেলে তিনি ৮৫ লাখ শরণার্থীর কথাও স্বীকার করে ফেলতে পরেন।
তবে পূর্ব বাংলাকে সামলাবার ভার জেলারেল ইয়াহিয় খান যার হাতে তুলে দিয়েছেন সেই ড: মালিক এই ধরনের গােলামিতে নতুন বলেই বােধ হয় তিনি সব দিক এখনও ঠিক সামলে উঠতে পারছেন না। তাই শরণার্থীদের ফিরে আসার আহ্বান জানানাের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার দু-একটা বেফাস কথাও বলে ফেলেছেন। শরণার্থীদের সম্পত্তি পূর্ব বাংলায় মীরজাফরদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়েছে তার এই কথা নিশ্চয়ই শরণার্থীদের মনে যথেষ্ট সাহসের সঞ্চার করবে না? তার এই কথাটা বলে ফেলে তিনি নিজেই কি নিজের যুক্তির বিরুদ্ধতা করছেন না? এই কথা বলার পর লােকে যদি ভাবে যে ভারতই শরণার্থীদের ফিরতে দিচ্ছে না এই অভিযােগটা নিছকই বানানাে? তবে বেফাস কথার উধাহরণ এই একটাই নয়। তিনি আবার এ কথাও বলে ফেলেছেন যে, পূর্ব বাংলার বৈষয়িক ব্যবস্থা, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা যােগাযােগ সবই দারুণভাবে বিপর্যস্ত সড়ক ও রেলপথে যােগাযােগ এখনও বিচ্ছিন্ন, তাই জলপথে চীনা ও বৃটিশ যানই একানএকমাত্র ভরসা। খাদ্যভাব মেটাবার জন্যেও সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তবে লােকের কেনার ক্ষমতা নেই। পাকিস্তানের মিত্ররাও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, ড: মালিক যে-ছবিটি একেছেন সেটি ঠিক স্বগের নয়। এই ছবি শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন প্রলুদ্ধ করার পক্ষেও কি যাথেষ্ট আকর্ষণীয়? অথচ এতদিন তাে সরকারিভাবে বিশেস স্বীকারই করা হয় নি যে, ২৫ মার্চের পর পূর্ব বাংলার জনজীবন কোনাে হয়েছে। সেকানে তাে সব কিছুই স্বাভাবিক। চোখের ডাক্তার হলেও ড: মালিক দেখা যাচ্ছে যাথেষ্ট দূরদর্শী। নন, কারণ এই সব কথা বলার জন্যে কি পাকিস্তানের ফৌজী শাসকরা তাকে ঢুকার গদিতে বসিয়েছেন?
তবে ড: মালিক যে শুধু বেফাস বলে ফেলেছেন তাই নয়, তিনি যেন একটু বেশি বেশিই বলছেন। এই সেদিন তিনি ঘটা করে বলেছেন যে, তিনি পূর্ব বাংলার সমস্যা সমাধানের জন্যে আওয়ামি লীগ নেতাদের সঙ্গে আলােচনায় রাজী আছেন। আবার এখন তিনি বলছেন, শরণার্থী সমস্যা ও অন্যান্য প্রসাঙ্গিক ব্যাপারে তিনি ভারতের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলােচনাতেও রাজী। এই সর কথা যখন তিনি বলেন তখন তিনি বােধ হয় ভুলে যান যে, তিনি নেহাৎই একজন শিখন্ডী। বাংলাদেশের মানুষ তাে তা জানেই, এমন কি জনাব ভুট্টো পর্যন্ত এই অসামরিক শাসনের ভাওতাটা গিলতে পারেন নি। ড: মালিকের ভাবখানা এমনই যে,আলােচনার সময় কোনাে একটা সিদ্ধান্তে পৌছানাের অধিকার যেন তার আছে আওয়ামিলীগ নেতারা তথা, বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, কোন ভিত্তিতে কোন্ আলােচনা হতে পারে। সেই ভিত্তি পাকিস্তান সরকার মেনে নেবেন কিনা, তা স্থির করার কোনাে ক্ষমতাই ড: মালিকদের মতাে লােকোর থাকে না, কারণ তারা শুধু নামেই মালিক আসলে গােলাম। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কোনাে আলােচর একমাত্র ইসলামাদেরই হতে পরে এবং তা-ও একমাত্র তাদের ঘােষিত দাবির ভিত্তিতেই। অবশ্য সে আলােচনা না-হলেও ক্ষতি নেই, কারণ আলােচনায় যা পাওয়া যায় নি বা যাবে না মুক্তি বাহিনীন অস্ত্রই সেই পূর্ণ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে। ড: মালিককে ধন্যবাদ, তার বেতার ভাষণে তিনি একথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মুক্তি বাহিনী তাকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১