বিশ্বসম্মেলনের আহ্বান
গােটা বিশ্বের সমস্যা বাংলাদেশ। সেখানে ঘটেছে মানবতার চরম অপমান। ইয়াহিয়া কানের বর্বর শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন মুক্তিকামী জনতা। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকা বাস্তব। মুক্তিবাহিনীর লড়াই সেখানে প্রত্যক্ষ। নয়দিল্লীর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাতে দিয়েছেন প্রতিশ্রুতির নব স্বাক্ষর। পঁচিশটি দেশের বেসরকারি প্রতিনিধিরা জড় হয়েছিলেন ভারতের রাজনীতিতে। তাদের বিবেকি সত্তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণ। চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ মানুষের দূর্গতি দেখে স্থির থাকতে পারেন নি জনপ্রতিনিধিরা। ভুলে গিয়েছিলেন তারা জাতি ধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় বৈষম্য। গ্রাহ্য করেন নি নিজেদের শাসককুলের মতামত। জানিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। স্বীকার করেছেন তারা। বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান এ অঞ্চলের পূর্ণ স্বাধীনতা। যারা এ আদর্শ সামনে রেখে লড়ছেন। তারা সত্যিকারের মুক্তিযােদ্ধা–সৈরাচারির নাগপাশ থেকে গণতন্ত্র এবং মানবতা উদ্ধারের বিশ্বস্ত সৈনিক। তাঁদের সংগ্রাম গােটা বিশ্বের বিবেকি মানুষের সংগ্রাম। তাতে মদৎ দেয়া প্রতিটি মানুষের, প্রতিটি রাষ্ট্রের এবং প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংস্থার নৈতিক কর্তব্য। তাই বাংলাদেশকে সামরিক এবং অসামরিক সব রকমের সাহায্যদানের আবেদন জানিয়েছেন দিল্লী সম্মেলন।
শুধুমাত্র সদীচ্ছামূলক প্রস্তাব নিয়েই কর্তব্য শেষ করেন নি দেশ দেশান্তর প্রতিনিধিরা। নিপিড়ণের উৎসমুখ। পাকিস্তান (পশ্চিম)। এখান থেকে ইয়াহিয়া খান চালাচ্ছেন তার বর্বর অভিযান। এই অঞ্চলের সৈন্যরাই ছারখার করছে বাংলাদেশ। তাদের সঙ্গে জুটেছে মুষ্টিমেয় স্থানীয় ভাড়াটিয়া। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। জানেন না আসল খবর। ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকেরা তাদের রেখেছেন অন্ধকারে। বিভিন্ন দেশের শান্তি কামীরা কাবুল ইরান কিংবা দিল্লী থেকে একযােগে যাত্রা করবেন ইসলামাবাদের দিকে। স্থানীয় জনতাকে জানাবেন তারা তাদের শাসকগােষ্ঠির অপকির্তীর কাহিনী। তার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারেও এসব মানবদরদী প্রস্তুত। পশুশক্তির সঙ্গে হবে নৈতিক শক্তির প্রত্যক্ষ মােকাবিলা। বাংলাদেশে যারা ঢুকবেন তাদের হাতে থাকবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারে অনুমতিপত্র। চ্যালেঞ্জ করবেন তারা বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার শাসন। কাজের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন অঞ্চলের সত্যিকার প্রশাসক স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন তারা সম্ভাব্য দুঃখ কষ্ট। আজ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্র দেয় নি স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতী। আন্তর্জাতিক শান্তি অভিযাত্রিরা এ পথে হবেন অগ্রগামী। তাদের স্বীকৃতির রাজনৈতিক মূল্য নেই সত্য, কিন্তু নৈতিক মূল্য অসাধারণ। এর প্রভাব অবশ্যই পড়বে রাষ্ট্রনায়কদের উপর। কূটনৈতিক স্বীকৃতির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অস্বীকার করেননি দিল্লী সম্মেলনের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে এই স্বীকৃতির জন্য অনুরােধ জানিয়েছেন তারা। ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্র। শরণার্থীর চাপে সে পিষ্ট। বাংলাদেশ সমস্যার ত্বরিত সমাধানে অন্যান্য রাষ্ট্রের চেয়ে সে বেশী আগ্রহশীল। স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ছাড়া শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অসম্ভব। জাতীয় স্বার্থের খাতিরে এক্ষেত্রে ভারতকে হতে হবে অগ্রণী। নয়াদিল্লীই প্রথমে দেবেন স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি। তাকে অনুসরণ করবে অন্যান্য রাষ্ট্র। বাস্তব বুদ্ধিতে এটাই স্বাভাবিক। যার ঘাড়ে বােঝা সে যদি পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তবে অন্যান্যরা কেন আসবে তার বােঝা নামাতে? সঙ্গত কারণেই কূটনৈতিক স্বীকৃতির পথ প্রদর্শনের জন্য দিল্লী সম্মেলন অনুরােধ করেছেন ভারতকে। ছ’মাস কেটে গেছে। আর বিলম্ব চলে না। একটা নির্ঘন্ট সময় বেধে দেওয়া অবশ্য কাম্য। এর মধ্যে যদি বাংলাদেশ সমস্যার বাস্তব সমাধানে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে না আসে অন্যান্য রাষ্ট্র তবে নয়াদিল্লী নয়াদিল্লী সিদ্ধান্ত নেবেন দ্বিধাহীন মনে। একথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়া একান্ত দরকার। তাতে সংগ্রাম থামবে না। ওটা চলবে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর বিজয় নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত হয়ে উঠবে। হয়ত শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ব্রিগেড মুক্তি সংগ্রামীদের সাহায্যে নামবেন লড়াইয়ের ময়দানে।
রাষ্ট্রসংগে উঠবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। দিল্লী সম্মেলনের ধাককা লাগবে সেখানে। ভারতীয় এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের হাত হয়ে জোরদার। এই সম্মেলন যদি নয়াদিল্লীর বদলে অপর কোন রাষ্ট্রের রাজধানীতে হত তবে বাড়ত তার প্রচার গুরুত্ব। বলতে পারত না পাকিস্তান নয়াদিল্লী সম্মেলন ভারত সরকারের সাজান। অনুষ্ঠান। পাক প্রচারযন্ত্র যদি একথা বলে তাতে কোন ক্ষতি নেই। পঁচিশটি রাষ্ট্রের খ্যাতিসম্পন্ন নেতারা নয়াদিল্লীর ভাড়াটিয়া -এধরণের প্রচার বিশ্বাস করবেন নাকোন প্রকৃতিস্থ মানুষ। যারা দিল্লী এসেছিলেন তারা বিবেকের তাগিদেই এসেছিলেন। তাদের সম্ভাব্য দুঃখ বরণের প্রস্তুতি স্বেচ্ছামূলক। বিপন্ন মানবতার মুক্তিই এদের একমাত্র কাম্য। স্পেনের গৃহযুদ্ধে দেখা গেছে বিশ্বের আদর্শনিষ্ঠদের আমরণ সংগ্রাম। বাংলাদেশে হয়ত হবে তার পুনরাবৃত্তি। তারা সতর্ক করেছেন রাষ্ট্রসংঘকে। ইসলামাবাদের হাতে এ সংস্থার সাহায্যের ঘটছে অপব্যবহার। যে হত্যাকারী নিপীড়ক এবং গণতন্ত্রের আজন্ম শত্রু সে কখনই হতে পারে না দূর্গতদের সাহায্যকারী। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী ইয়াহিয়া খান। রাষ্ট্রসংঘের পৃষ্ঠপােষকতায় এই দাগী আসামীই হতে চাচ্ছেন ত্রাণকর্তা। বাইরের কোন সাহায্যই যেন যায় এই দানবের হাতে। বাংলাদেশের দূর্গত জনতার দরদী বন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এদের মাধ্যমেই বণ্টন করা উচিত এনসামগ্রী। রেডক্রশ রাজনৈতিক সংস্রব বর্জিত সংস্থা। বাংলাদেশে তাদের সেবাকার্যের অধিকার আন্তর্জাতিক নীতিসম্মত। তারা যদি ত্রাণকার্য চালান বাংলাদেশে তবে আপত্তি থাকতে পারে না কারও। এদের হাতে অনায়াসেই দেওয়া যেতে পারে আর্ত ত্রাণের ভার। কিন্তু ইয়াহিয়ার হাতে কোনমতেই নয়। দিল্লী সম্মেলনের এই হুঁশিয়ারীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ সম্মেলন দিয়েছেন আশার ইঙ্গিত। প্রমাণ করেছেন-মানবতার ফলগু ধারা একেবারে শুকিয়ে যায় নি। তা এখও প্রবহমান।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১