সংবাদ
২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিব কর্তৃক সার্বভৌম পার্লামেন্ট দাবী :
বিজয়-উল্লাসে মুখরিত ঢাকা নগরী
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
গতকাল (রবিবার) শেখ মুজিবর রহমানকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন উপলক্ষে সমগ্র ঢাকা নগরী যেন বিজয় উল্লাসে মুখর হইয়া ওঠে। উৎসব-মুখর পরিবেশে রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক সমাবেশে লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবর রহমান ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সহিত একযোগে হস্ত উত্তোলিত করিয়া ১১-দফার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার বজ্রদৃঢ় শপথ গ্রহণ করে।
লাখো কণ্ঠে শপথ উচ্চারণ করিয়া বলা হয়, ১১ দফার প্রশ্নে কোন আপোষ নাই, ১১ দফার সংগ্রাম চলবে চলবে।
গোলটেবিল বৈঠকের পূর্বাহ্নে শেখ মুজিবর রহমানকে ছাত্র জনতার রায় জানাইয়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এই জনসভার আয়োজন করা হয়।
সভায় জনাব শেখ মুজিবর রহমান ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ও সংগ্রামী জনগণকে আশ্বাস প্রদান করিয়া বলেন যে, ১১-দফা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে শরীক হইবেন।
তিনি তাঁহার বক্তৃতার সার্বজনীন প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সার্বভৌম পার্লামেন্ট গঠনের দাবী জানান এবং বলেন যে, সংখ্যা সাম্যের বিলোপ করিয়া জনসংখ্যার অনুপাতে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
তিনি বলেন, তিনি ‘পিণ্ডি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়া এই দাবী পেশ করিবেন। বর্তমান শাসনতন্ত্র বাতিল ও নূতন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবীতে পূর্বাহ্নে সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ সাহেব বলেন যে, শাসনতন্ত্র সংশোধন করিয়া অথবা নূতন শাসনতন্ত্র রচনা করিয়া এই দাবী সন্নিবেশিত করা যাইতে পারে।
শেখ মুজিবর রহমান ১১-দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ও দেশরক্ষা ব্যবস্থার স্বয়ং সম্পূর্ণতার দাবীর পুনরুক্তি করেন এবং এক ইউনিট বাতিল পূর্বক পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রদেশসমূহের পুনরুজ্জীবন দাবী করেন।
পূর্ব-পশ্চিমে ঐক্য
শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করিয়া বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ১২ কোটি শোষিত জনগণকে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত এই ঐক্যবদ্ধ গণ- সংগ্রাম অব্যাহত রাখিতে হইবে।
শেখ সাহেব আরও বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের মজলুম জনগণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ জনতার ভাই। তাঁহারা একে অন্যকে ভালবাসেন। ১২ কোটি মানুষ। সাধারণ শক্তি হইতেছে ২০/২২ ধনিক পরিবার। এই গুটিকতক শিল্পপতি পরিবারই দেশের সমগ্র সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগ পকেটস্থ করিয়াছেন। তিনি আরও বলেন যে, এই কায়েমী স্বার্থই নিজেদের স্বার্থে পাকিস্থানের উভয় অংশের জনগণকে পরস্পর হইতে বিছিন্ন করিয়া রাখিতে চায়।
শেখ মুজিব বাঙ্গালী অবাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে জনগণের সকল অংশকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, পাকিস্তানের জনগণ শুধু মুষ্টিমেয় ধনিক আর আমলার সুখের জন্য স্বাধীনতার সংগ্রাম করেন নাই। তিনি পূঁজিপতিদিগকে শ্রমিকদের সুখ সুবিধার প্রতি নজর দেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন। তিনি আরও বলেন যে, দুনিয়ার হাওয়াই আজ অন্যরকম। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করা হইতে থাকিলে এবং মুনাফা লালসা কিছুটা সংযত না হইলে আগামীতে কলকারখানা বাজেয়াপ্ত হইয়া যাইবে।
শেখ মুজিব আইয়ুবশাহীর গত ১০ বৎসরের নির্মম শাসন শোষণের বিশেষভাবে সম্প্রতি দেশব্যাপী গণহত্যার ও অত্যাচারের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি সম্প্রতি গুলীবর্ষণের ঘটনাসমূহ সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠান এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বর্গের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবী করেন। তিনি গভর্ণর মোনায়েম খানের আশু অপসারণ দাবী করেন।
হুলিয়া প্রত্যাহারের দাবী
শেখ মুজিব দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে জারীকৃত হুলিয়াসমূহ প্রত্যাহারের দাবী জানাইয়া বলেন, এই সব নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকের নামে ১৫/২০ বৎসর যাবত হুলিয়া জারী রহিয়াছে। শেখ মুজিব তাঁহার দীর্ঘ কারাজীবনের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলিয়া ধরেন।
শেখ মুজিব সাহিত্য সংস্কৃতির উপর হামলা ও সাম্প্রদায়িকতা মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করিয়া বেতারে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশনের দাবী জানান। তিনি বলেন, সাহিত্য সংস্কৃতি ও জ্ঞানের কোন সীমারেখা নাই। আমরা সেক্সপীয়ার, গ্যাটে, মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং এর বই পড়িব, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যও পড়িব। শেখ মুজিবর রহমান ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বান অনুযায়ী প্রতিটি মহল্লায় ও গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার আহ্বান জানান। তিনি এই সব কমিটিকে শান্তি রক্ষা করারও আহ্বান জানান।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯