বাংলার বাণী
২৪শে আগস্ট, শুক্রবার, ১৯৭৩, ৭ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
দিল্লী বৈঠক কোন পথে!
দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ভারত-পাকিস্তান বৈঠকের গতি-প্রকৃতির বিস্তারিত বিবরণ জানা না গেলেও অনুমান করা যাচ্ছে যে, আলোচনা বেশ খানিকটা দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আজিজ আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছিলেন। উপমহাদেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তারা আলাপ-আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী অভিমত পোষণ করেছেন উপমহাদেশের মানবিক সমস্যা ও সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্যে বাংলাদেশ যথেষ্ট করেছে এখন পাকিস্তানের পালা। অথচ সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, পাকিস্তান আলোচনায় বাহ্যত তার অনমনীয় মনোভাব অপরিবর্তনীয় রেখেছে। এদিকে এনা জানিয়েছে—বাংলাদেশ ও দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত মানবিক সমস্যাসমূহ সমাধানের সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বাসস বলেছে—পাকিস্তানী পক্ষ গত মঙ্গলবার শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনার আলোকে রাওয়ালপিন্ডির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। তাদের গতিবিধি দেখে মনে হয় পাকিস্তানী আলোচনাকারীরা প্রতিপক্ষের ধৈর্য পরীক্ষার মনোস্তাত্ত্বিক লড়াই চালানোর কৌশল অবলম্বন করেছে। যে কৌশল তারা গত বছর সিমলা বৈঠকেও অবলম্বন করেছিলো। এবারের আলোচনায় এমন আভাসও পাওয়া যাচ্ছে যে, চলতি আলোচনার অচলাবস্থা দূর না হলে তৃতীয় দফায় বসার জন্যে এবারের আলোচনা স্থগিত রাখার কথাও বিবেচিত হতে পারে। এনার মতে, পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতা জনাব আজিজ আহমেদ ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যকার আলোচনার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
ভারত-পাকিস্তান আলোচনার অগ্রগতি মোটেই উল্লেখযোগ্য নয় বলে ধরে নেওয়া যায়। পাকিস্তানের অনমনীয় মনোভাবই এর জন্যে মূলতঃ দায়ী। এমতাবস্থায় ধরে নেওয়া যায় উপমহাদেশের মানবিক সমস্যা সমাধানের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে চলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দী ও পাকিস্তানে আটক বাঙালী এদের ফিরিয়ে দেবার ও ফিরিয়ে নেবার প্রশ্ন সম্পূর্ণ আজ অনিশ্চিত হতে চলেছে। পাকিস্তান যদি সামান্যতম মানবিক গুণের পরিচয় দিতো তাহলে উপমহাদেশের সমস্যাবলীর সমাধান খুঁজে বের করার একটা আগ্রহ প্রকাশ করতো। বিশেষ করে এবারের দিল্লী বৈঠকে—অন্ততঃ যুদ্ধবন্দী ও আটক বাঙালীদের বিনিময়ের প্রশ্নটির নিষ্পত্তি হতো। কিন্তু পাকিস্তান অন্য কোন দরকষাকষির জন্যে দিল্লী বৈঠকে অচল অবস্থা ডেকে আনছে। এতে করে পাকিস্তানের ঘৃণ্য মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটছে। বিশ্বের শান্তিকামী কোটি কোটি মানুষের চোখে সে শান্তির শত্রু বলে বিবেচিত হচ্ছে।
আমরা খুব বড় একটা আশা পোষণ করেছিলাম না যে, দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বৈঠকই সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিয়ে আসবে। তবু প্রশ্ন রেখেছিলাম এবার পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের মনোভাবের একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে বলে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও বলেছেন বাংলাদেশ উপমহাদেশের শান্তির জন্যে অনেক করেছে এবার পাকিস্তানের কিছু করবার পালা। পাকিস্তান তার সেই করণীয় কর্মসাধনে ব্যর্থ হতে চলেছে। পাকিস্তানের বর্তমান নেতৃবৃন্দ যে নীতিজ্ঞান ও আদর্শের দ্বারা উদ্বোধিত তাতে করে তাদের কাছ থেকে কোন মীমাংসার মনোভাবের আশা করা বৃথা। আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদ ও চীনা সম্প্রসারণ নীতি আজ তার গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তার রাষ্ট্রীয় মনোভাবের মধ্যেও পারস্পরিক সহযোগিতা ও শান্তি স্থাপনের কোন উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়। ফলে পাকিস্তান আজ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী ধনিক শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলে কাজ করছে। আমরা আশা করবো পাকিস্তানের সুমতি হোক। অবিলম্বে উপমহাদেশের সমস্যাবলীর একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধানে তারা বাস্তব আগ্রহ প্রকাশ করুক। দিল্লী বৈঠকে আর কিছু না হোক, একটা সমাধানে পৌঁছানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত হোক।
দৃষ্কৃতিকারীদের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করুন
গত ঊনিশ তারিখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মহাসম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে জাতির জনক ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের বর্তমান অবস্থার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে দুঃখ এবং ক্ষোভের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন—‘হয় আমাকে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে হবে নয়ত চরম আঘাত হানতে হবে।’ সেই সঙ্গে তিনি দেশের বর্তমান আইন শৃঙ্খলার অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যে দেশের দু’টি বৃহৎ ছাত্র প্রতিষ্ঠান ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর গ্রুপ) এবং কম্যুনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর এই ডাক শুনে দেশবাসী খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। সবাই মনে করেছেন এরপর থেকে নিশ্চয়ই গুপ্তহত্যা, ডাকাতি ইত্যাদি কমতে শুরু করবে এবং দুষ্কৃতিকারীদের দৌরাত্ম্য সংহত হতে থাকবে।
কিন্তু না। তা’ত হ’লই না, উপরন্তু প্রধানমন্ত্রীর উক্ত ঘোষণার চ্যালেঞ্জ করে যেন সমাজবিরোধী ও দৃষ্কৃতিকারীরা মাঠে নামলেন। আর তার ফলশ্রুতিতে গত ২০ তারিখ থেকে গতকাল পর্যন্ত মাত্র চারদিনে খবরের কাগজগুলোতে প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী গুলি বিনিময়’, ‘পাবনায় প্রকাশ্য দিবালোকে ৩ ব্যক্তি খুন, ‘ঢাকায় ১ জন বুলেট বিদ্ধ’, ‘লৌহজং-এ দেড়শত গ্রেফতার’, ‘খুলনায় দিবালোকে দু’জন নিহত’, ‘স্বামী-স্ত্রী খুন’ ইত্যাদি শিরোনামায় খবর বেরুলো। খবরের কাগজে অপ্রকাশিত এমনিতর আরো কত যে খবর রয়েছে তার হিসাব আমরা ক’জনে করেছি বা ক’জন জানতে পেরেছি? সুতরাং এসব ঘটনাগুলো কি এ কথাই প্রমাণ করছে না দুষ্কৃতিকারীরা সরকারকে চ্যালেঞ্জ প্রদান করে তাদের হীন কর্মকান্ড করে যাচ্ছে?
এমতাবস্থায় আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানার সময় এসে গেছে। এখনো যদি তাদেরকে দৃঢ়হস্তে দমন করার কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে দুষ্কৃতিকারীদের সঙ্গে সঙ্গে দেশের আপামর জনগণও মনে করবেন আসলে সমাজবিরোধীদেরকে দমন করতে সরকার অপারগ। আর জনগণের মনে যদি যেকোন প্রকারে এই ধরনের আশঙ্কা জন্ম নেয় তাহলে তা যে দেশের জন্যে কতখানি ক্ষতিকর সে কথা বলাই বাহুল্য। শুধু তাই নয়, তাহলে দুষ্কৃতিকারীদের নৈরাজ্যই দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। কাজেই সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, আর এতটুকু কালবিলম্ব না করে দুষ্কৃতিকারীদের দমনে চরম আঘাত হানুন। হাজারো সমস্যা আর অভাবের তাড়নায় তিলে তিলে ক্ষয়ে যাওয়া বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো যদি দুষ্কৃতিকারীদের থেকে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন তাহলেও অনেকটা স্বস্তি বোধ করবেন।
অতএব, আমাদের বক্তব্য সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ও যুব প্রতিষ্ঠান সহ রাজনৈতিক দলগুলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলুন। সরকারের প্রতি বক্তব্য আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে দুষ্কৃতিকারীদের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে দেশের আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক করুন, জনগণের মনে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনুন। নইলে দেশের এই দুরবস্থার জন্যে তাঁদেরকেই দায়ী থাকতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক