বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদ
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমাবেশ, শােভাযাত্রা, লবিং ও সভা ইত্যাদি আয়ােজনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবাসী বাঙালীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া এবং বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার সুমহান লক্ষ্যে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকেই। এই তাগিদে সাড়া দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ মহিলা সমিতির কিছু উৎসাহী নেতা ও কর্মী বিলাত-প্রবাসী লেখক, কবি, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীকে সংগঠিত করে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার। উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই সময়ে লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার্থে অবস্থানকারী তৎকালীন ঢাকা। মিউজিয়ামের পরিচালক ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এনামুল হক এই উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত হন। লন্ডন ডব্লিউ-সি-১ এ অবস্থিত টেভিস্টক প্লেসের ৫৯ নং সেমুর হাউজে মিসেস মুন্নী রহমানের বাসভবনে উক্ত সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠনের উদ্যোগে এক সভা আহ্বান করা হয়। উক্ত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ (Bangladesh Peoples’ Cultural Society) নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা এবং তার কার্যালয় হিসেবে ৫৯ নং সেমুর হাউসে মিসেস মুন্নী রহমানের বাসভবনকে ব্যবহারের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা এবং মহিলা সমিতির নেত্রী মিসেস মুন্নী রহমান। অপরিসীম সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী বিলাতের বাঙালি মহিলাদের নেতৃত্বদানকারী সদাহাস্যময় সকলের মুন্নী আপা আজ আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তিনি লন্ডনে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহে …….. রাজেউন)। মিসেস মুন্নী রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ মুক্তিযুদ্ধকালে বিলাতের প্রবাসীদের সংগঠিত করার ব্যাপারে এবং প্রেরণা যােগাতে এক বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সকল কর্মকাণ্ডেও চালিকা শক্তি হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার স্বামী বিশিষ্ট আইনজীবী ও তৎকালীন লন্ডনের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ব্যারিষ্টার লুৎফর রহমান। শাহজাহান এর সার্বক্ষণিক উৎসাহে মিসেস মুন্নী রহমান মুক্তিযুদ্ধ সময়ের নয় মাস অক্লান্ত শ্রম করে একজন প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। লস মুন্নী রহমান স্বাধীনতা উত্তরকালে লন্ডনে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব মছেন এবং তিনি লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেন্টারের দায়িত্ব বহুদিন যাবৎ অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পরিচালনা করেন। তার অকাল মৃত্যুতে বিলাতের প্রবাসীরা তাদের বলিষ্ঠ সংগঠককে হারিয়েছে।
৫৯ নং সেমুর হাউজের সভায় বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের পরিচালনার । এনামুল হককে (জাতীয় যাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক) সভাপতি ও মিসেস মন রহমানকে সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত করে গঠিত ১৯ সদস্যবিশিষ্ট সংসদের অপর সদস্যরা ছিলেনঃ সহ-সভাপতি (৩ জন) শফিকুর রহমান, ফজলে লােহানী (বিশিষ্ট টিভি ব্যক্তিত এ মরহুম) ও শহিদুদ দাহার (নরথাপন), যুগ্ম সচিব (২ জন) মাহমুদ হাসান ও জাকিউদ্দিন আহম্মদ, সাংগঠনিক সম্পাদক-বুলবুল মাহমুদ (বর্তমানে ব্যারিষ্টার ও বৃটিশ সিভিল সার্ভিসে কর্মরত); কোষাধ্যক্ষ-আনিস আহম্মদ (লন্ডনে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও বর্তমানে সম্পাদক); সদস্যবৃন্দ-লুলু বিলকিস বানু, জেবুন্নেসা খায়ের। আহমদ হােসেন জোয়ারদার, আবদুর রউফ (শিল্পী ও বাংলাদেশ ফিল্ম এন্ড আর্কাইভের ও চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ডি এফ পির সাবেক পরিচালক), এম, এ রউফ (বর্তমানে লন্ডনে চাটার্ড একাউন্টটেন্ট), মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, এ কে এম, নজরুল ইসলাম (লন্ডনে বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী), এ রাজ্জাক সৈয়দ, জিয়াউর রহমান খান (বর্তমানে ব্যরিষ্টার ও সংসদ সদস্য) এবং ড. হুজ্জত আলী প্রামানিক (বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। ১৯৭১ সালের জুন মাসে প্রচারিত বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের এক প্রতিবেদনে উক্ত সংসদের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলীর বিবরণ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে জানা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন, বাংলাদেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতি বিদেশে প্রচার ও পৃথিবীর সকল স্বাধীনতাকামী জনগােষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই সংসদ গঠন করা হয়। এই সংগঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসী জনগণের মধ্যে মনােবল সৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ এবং বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার অঙ্গিকার করে। উপরােক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণ-সংস্কৃতি সংসদ বিভিন্ন সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্যনাট্য প্রচার ও বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়ােজন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদ প্রযােজিত অনুষ্ঠানাদির মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিপ্লবী আলেখ্য “অস্ত্র হাতে তুলে নাও” নামক নৃত্যনাট্য বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। লন্ডন, মাচেষ্টার, বার্মিংহাম সহ বিলাতে বিভিন্ন শহরে আমন্ত্রণক্রমে ভক্ত নৃত্যনাট্যটি মঞ্চায়িত করা হয় এবং প্রবাসী মুক্তিকামী জনগণের প্রশংসা লাভ করে।
অত্র হাতে তুলে নাও” নৃত্যনাট্যটি রচনা ও সুরারােপ করেন বাংলাদেশ গণ-সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি এনামুল হক। আগস্ট মাসে রচিত নৃত্যনাট্যটি প্রথম লন্ডনে মঞ্চায়িত হয় সে। মাসে। নৃত্যনাট্যটি পরিচালনা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন মিসেস মুন্নী রহমান ও মি মঞ্জু হাফিজ। নৃত্যনাট্যের কিষাণ ও কিষাণীর মুখ্য নৃত্যাভিনয়ে অংশ গ্রহণ করেন যথা
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান – ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন